অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

আমাদের গল্প, আমাদের বীজতলা

পর্ব ১

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৮, ২০১৭

যাপিতজীবন বাস্তবতায় কিম্বা পেষণের অনৈতিক সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে ভাবতেই হয় একটি শিল্পের ছবি। ছিপছিপে একটি নদীর হাওয়া ঝিরঝির আনন্দে ছুটে এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাবে আমাদের শিশুটির গাল। মায়েদের মুখে উচ্চারিত হবে, কল্যাণ হোক। যেন দায় আছে কোথাও, মানুষের; সুন্দর ও তার পারিপার্শ্বিক নিয়ে বেঁচে থাকার।
সাহিত্য মানুষের সৌন্দযর্যকে উন্মোচিত করে অপসুন্দরের কালো দেয়াল ভেঙে। চোখ যতটা আঁধার দেখতে পায়, সাহিত্যের মানস-আয়না ধরে তার বিপরীত আলো। এর রকমের প্রকাশ সাহিত্যের। কালিক রাষ্ট্রযন্ত্রের কালশিটে পিঠে নিয়ে এই আমাদের যাপিত বাস্তবতা। মুহূর্তের লাগাম টেনে কেউ কেউ ব্যক্তিগত চেতনায় শুদ্ধতম চিন্তায় দাঁড়াতে পারে প্রতিকূল ¯্রােত অভিমুখে। তাদের বুকে জেগে থাকে জীবনানন্দের সাতটি তারার তিমির, তারা ভিজে ওঠে নদী নক্ষত্রের জলে। তারা জ্ঞাত থাকে যে, মানুষের সমাজ একটি ধারাবাহিক গতি নিয়ে এগোয়। সাহিত্যসূত্রে সেই গতিকেই চিহ্নিত করা জরুরি। পেছন ফিরে যদি দাঁড়াই, পরিষ্কার হয়ে উঠবে আমাদের অগ্রজ শব্দশিল্পীদের পারস্পরিক ভাবনার জগৎ। এরই প্রেক্ষিতে সমসাময়িক সাহিত্যচর্চা ও তার বিষয়-প্রকরণ কিম্বা বৈচিত্র নিয়ে সমমনস্ক সতীর্থদের সঙ্গে যাপিত সাহিত্যের রূপরেখা বিষয়ক আলোচনায় প্রায়ই মুখর হয়ে উঠি আমরা।
এই সময়কে বুঝতে হলে সাম্প্রতিক সাহিত্যের পাঠ জরুরি, পারস্পরিক ভাবনার যোগাযোগও। কিন্তু যে যোগাযোগের বিশুদ্ধতার জায়গায় লেখকেরা কী দাঁড়াতে পারেন একই মতে? বিশ্বস্ততার ঐকমত্যেই তো চেনা যায় একজন লেখকের স্বরূপ। ষাটের দশকের মুখপত্র ‘কণ্ঠস্বর’কে কেন্দ্র করে কয়েকজন তরুণ আমাদের সাহিত্যে একটি বাঁকবদল ঘটিয়েছিলেন। আজ সে কেবল ইতিহাস। শহর ঢাকা কিম্বা মফস্বলেও চর্চা হয়েছে, হচ্ছে, সাহিত্যের। চিন্তার ঘনিষ্ঠতা কতটা আছে সে চর্চায়, সহজেই চোখে পড়ে আমাদের।
সাম্প্রতিক সাহিত্যের পঠন-পাঠন যাদের প্রাত্যহিকতায় রয়েছে, তাদের কাছে আজিজ সুপার মার্কেট একটি পরিচিত নাম। এ মার্কেটটি কেন্দ্র করে এ সময়ের সাহিত্যের একটি গতি-প্রকৃতি আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের তাড়না কিম্বা সতীর্থ লেখকদের সঙ্গে খুচরো কিছু আড্ডা দিতে দিতে সন্ধের হাওয়ায় উড়িয়ে দিই সারাদিনের ভারবাহী জীবন-বাস্তবতা। কিন্তু যদি জানতে চাওয়া হয়, আমাদের সমকালীন সাহিত্যের অতিসাম্প্রতিক চেহারা কি?
পূর্বসুরিদের শিল্পবোধ থেকে আমরা কি রকম দূরত্ব তৈরি করেছি আমাদের চর্চায় আমাদের সময়কে ধারণ করে? এই যে বেড়ে ওঠা কয়েকজন স্পর্শকাতর মানুষের, যারা রাষ্ট্রীয় পেষণে কিম্বা দৈনন্দিন সামাজিক কাঠামোয় মুহূর্তে মুহূর্তে আহত হয়। আবার শুদ্ধতম চিন্তার নৈকট্যে বারবার উচ্চারণ করে, শেষপর্যন্ত শিল্পই সুন্দর। মানুষ সুন্দর। দেশ সুন্দর। সৌন্দর্যের যে অর্থ তারা বিশ্বাস করে, তারা চায় সমকালীন বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে তাদের লেখালেখি কিম্বা বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক কাতরতা।
বিশ্বাস রাখা দরকার যে, আগে মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে হবে। এরপর তার শিল্পচর্চা। সৌন্দর্যকে চিনে নেয়ার প্রেরণা তো মানুষ পায় সৌন্দর্যেরই ভেতর। আমাদের সময়টাকে চিনে নেয়া, এই সময়ের আধুনিকতার আয়নায় নিজেদের কাজকে তুলে ধরতে এবং আমাদের সাম্প্রতিক লেখালেখির বিষয় নিয়ে প্রথম দশকের কয়েকজন কথাকার এক সন্ধেয় আজিজ মার্কেটে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে কথা বলি সাহিত্য নিয়ে। আমাদের সে আড্ডার বিচ্ছিন্ন কথোপকথন এ লেখাটির আসল আয়োজন। মনে রাখতে হবে, বয়স ও অভিজ্ঞতায় আমরা এখনও হাঁটি হাঁটি পা পা। ছাড়া ছাড়া ভাবে, এক বক্তব্যের সঙ্গে আরেক বক্তব্যের কোনও সম্পৃক্ততা না রেখেই আমরা কথা বলে গেছি। যেরকম কথা বলি প্রতি সন্ধেয়, এরকম দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে। এবং আড্ডা থেমেও গেছে আকস্মিক, কোনও আগামাথা না টেনেই। আমিসহ চাখানায় মিলে গেছিলাম যারা, একে একে, তাদের কারও কারও সেঅর্থে লেখক-দর্শন তৈরি হয়নি, চর্চা কিন্তু চলছে। সেদিন জুটে গেছিল, রাহাদ আবির, শিমুল বাশার, মাজুল হাসান, মোর্শেদ শেখ, কামরুল আহসান ও সজিব দে।
প্রকৃত সত্য এই রকম, আমরা আসলে বুঝে নিতে চাচ্ছিলাম সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যকে। এই মুহূর্তে আমরা কি লিখছি, কেন লিখছি কিম্বা ভাষার ভাষার বিচারে আমাদের কর্তব্য কি। যে যে বিষয় আমাদের ভাবনায় নাড়া দ্যায়, তা-ই। রাষ্ট্রের থাবার নিচে বেড়ে ওঠা এক একটি ধবল প্রাণ সময়ের বেড়ি ডিঙিয়ে দূর সময়ের দিকে যাত্রার যে ইশারা টের পায়, বলি যে, একটি ভূখ-ের যাপিত সমাজচিত্র কিন্তু এটাই। অগ্রজদের থেকে নিয়ে নয়, তাদের ধারাবাহিকতায় নির্মাণ করতে চাই এমন কিছু যা একান্তভাবে আমাদের। বাংলাদেশের। আমাদের প্রত্যেকের গলায় ঝুলছে, দূরত্ব বজায় রাখুন নির্দেশিত সাইনবোর্ড। আমরা পালাচ্ছি পরস্পরের কাছ থেকে, যেন সারা বাংলাদেশ ৫ টন লেখা মালবাহী কোনও ট্রাক তেড়ে আসছে আমাদের দিকে। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষই চূড়ান্ত সভ্যতা। মানবিক আত্মা না থাকলে সভ্যতার কাঠামো সূচারু হয় না, ইতিহাস বলে না এ রকম কথা। আমরা আত্মার কাছে নত হতে চাই, বাহ্যিক মোড়কে নয়।  যে রকম মোড়কে তরুণ মেধাবীদের বন্দি করে ফেলছে আজকের কতিপয় সুবিধাভোগী বড় কাগজের সম্পাদক কিম্বা তাদের অনুগামী ছোট কাগজের মোড়ল সম্পাদকেরা। ভাবলে হাসি পায়, এ সকল গুরুজিরা প্রায় প্রায়ই পাঁচ তরুণ দশ তরুণ শিরোনাম দিয়ে কবিতা পাঠের আয়োজন করে। আবার কখনও কখনও প্রমোদ বিহারে সওয়ার হয়ে বেড়াতে যায় কোথাও। তাদের এ প্রমোদ উৎসবে প্রতিক্রিয়াশীলদের উপস্থিতি আমাদের শঙ্কিত করে। তবে সময় আসছে ধেয়ে, খারাপ সময়?
না, আসবে না। যারা চিন্তা করে, যারা সৎ, তারা সাহিত্যের কোনও বলয়ে নেই। তারা খোয়াব দ্যাখে খোয়াবনগরের। তাই এখনও তারা লিখছে। ভাবছে শিল্পের নানা মাত্রায়। এই মুহূর্তে এটাই জরুরি। কোনও বৃত্তের ভেতর না দাঁড়িয়ে উচ্চকিত হয়ে ওঠাই এখন আমাদের কর্তব্য।
যারা চিন্তায়-কর্মে ধ্যানে যথার্থই লেখক, খুব ব্যক্তিগত জায়গা থেকে তারা একে অন্যের প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। বাঙালি সমাজের পারিবারিক গ্রন্থি যে রকম। পরস্পরের এই নৈকট্য নিশ্চয়ই একটা বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে দেবে। প্রতিক্রিয়াশীল কিম্বা মাথা বিগড়ে যাওয়া লেখকদের খুব সহজেই চিনে নিয়ে নিজেদের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠব আমরা।
অতি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে যে লিখিয়ে গোষ্ঠি শিল্পচর্চা করছে, তারা কেউ কেউ উপলব্ধি করছে, একটা আলাদা কিছু করতে হবে। গতানগতিকের বাইরে গিয়ে, আর দশজন যেভাবে কওে কিম্বা করতে চায়, ঠিক সেপথে না গিয়ে একটু ভিন্নপথে এরা হাঁটতে চাইছে। সাহিত্যের ধারাবাহিক একটা ভাষা আছে। অনেক মহৎ লেখক থেকে আরম্ভ করে লেখক নামের লেখকেরা সে পথেই এগিয়েছেন। আর পাঠকের রুচিবোধও তৈরি হয়ে গেছে ওই বিশেষ একটি ছকে। তারা চিন্তা করছে স্বদেশের মাটিতেই দাঁড়িয়ে শেকড়ের রসে সঞ্চিত হয়ে কোনও রকমের আড়ম্বরতার ভেতর না গিয়ে খুবই আটপোড়ে বয়ানে সাহিত্যের ভাষা নির্মাণ করা জরুরি। ইতিহাস সাক্ষ্য দ্যায়, প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে পারে, উচ্চকিত গলায় নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে, তরুণ কণ্ঠস্বরই। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় আমাদেও সমাজরাষ্ট্র অনেক আগেই সংক্রমিত। এ সময় সাহিত্য করতে এসে চোখে পড়ছে পুঁজিবাদী সাহিত্য-প্রতিষ্ঠানগুলো কি উপায়ে সাহিত্যকে মোড়কের ভেতর বন্দি করে ফেলছে। এই ফাঁদে আটকে পড়ছে অনেক তরুণ প্রতিভা। আমাদের চোখের সামনেই আমরা দেখি ব্যবসায়িক সাহিত্য। যা কোনোঅর্থেই সাহিত্যের সৌন্দর্য ধারণ করে না। এরকমই মনে হতে লাগল আমাদের। প্রতিষ্ঠান চাইলে গুমত ছেপে কোনও রাম-শ্যামকে বড় লেখক বানিয়ে ছাড়ে। আর এতে করে সাহিত্যের পাঠক পড়েন বিভ্রান্তিতে।

চলবে...