আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৮

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
আজ শীত এলেই লক্ষ্য করি, কোথায় যেন ওর শরীরে হতশ্রীর রূপ লেগে রয়েছে। আগের সেই দেমাগ, সৌন্দর্য, রহস্যময়তা কোনোকিছুই যেন আর নেই। গাছের পাতায় পাতায় ধুলো লেগে থাকে, প্রকৃতিও কেমন বিবর্ণ। ভোরের শিশিরও যেন জোর হারিয়ে ফেলেছে। আমার সেই আলাভোলা শৈশবের দিনে সকালে লেপ থেকে বেরুলেই টের পেতাম শিশিরের অস্তিত্ব। কথা বলতে গেলেই নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসত বাষ্প। শীত যে কী, শরীরমনেও সাক্ষাৎপ্রমাণ থাকত। তারপর কী শুধু গরম কাপড়চোপড়! ঠোঁটে-মুখে ক্রিম-স্নো না মেখে ঘরের বাইরে যেতে পারতাম না। শরীর চড়চড় করত। হাতপা-ও রাখতে হতো মোজাবন্ধ। মুখের বাষ্প নিয়ে আমরা বাচ্চারা খেলতাম।
নানাবাড়ির পুবদিকে ছিল বিশাল বড় এক দেয়াল। সিমেন্ট বাঁধানো গাছসমান দেয়াল। বড় বড় আমগাছগুলো ছিল আরো বড় আর ঝাকড়া। ফলে রোদের ছিটেফোঁটাও প্রবেশ করতে পারত না বাড়ির ভেতর। আমরা রোদ পোহাতে বাড়ির বাইরে পুবদিকের খোলা চত্বরে গিয়ে বসে থাকতাম। রোদ কি সহজে পাওয়া যেত! বড় দুর্লভ ছিল সে রোদ। আদিগন্ত প্রান্তর, সামনের সবকিছু ঢাকা থাকত কুয়াশায়। ধীরে ধীরে কুয়াশা কাটতে থাকত আর একটু একটু করে স্পষ্ট হতে থাকত সূর্যের আলো। ক্রমশ দৃশ্যমান হতো দূরের ল্যান্ডস্কেপ! এরমধ্যেই দেখো, কখন কৃষাণেরা পৌঁছ গেছে মাঠে মাঠে। এত কুয়াশা এত শীত কাউকেই ঘরে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
সেই বাইরের চত্বরে বসে আমাদের আরো একটা রীতি ছিল, আগুন জ্বালিয়ে গরম তাপ নেয়ার। আগুনকে ঘিরে তার চারপাশে আমরা সবাই গোল হয়ে বসতাম। কোথা থেকে খড় পাতা এসব জোগাড় হয়ে যেত! নাসিম মামাদের বাড়ি থেকে কালামামা আসতেন লুঙির মধ্যে মুড়ি নিয়ে। লুঙি ভাঁজ করে তার মধ্যে মুড়ি রাখতেন, সঙ্গে থাকত পাটালিগুড়। এক মুঠো মুড়ি মুখে গুঁজে দিয়ে পাটালিগুড়ে একটা কামড় বসাতেন। না না, ভুল বললাম, শীতের সকালে লুঙির ভাঁজে মুড়ি আর পাটালিগুড় নিয়ে আগুন পোহাতে আসত বাচ্চু ভাই, সেটা আমাদের দাদার বাড়িতে। আমাদের নানাবাড়িতে এ রেওয়াজটা ছিল না। পাটালিগুড় থাকবে কী, খেঁজুর গাছই তো চোখে পড়তো না। খেঁজুর গাছ, তাল গাছ, কাঁঠাল গাছ এসব কোন গাছই চোখে পড়ত না নানাবাড়ির প্রাকৃতিক পরিবেশে। দাদাবাড়ির সঙ্গে আমার নানাবাড়ির প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ল্যান্ডস্কেপ, গাছগাছড়া, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি সবকিছুতেই চোখে পড়তো ভিন্নতা, এমনকি শীতের প্রকৃতিতেও টের পাওয়া যেত ভিন্নচারিত্র্য।
শীতে আমাদের দাদাবাড়িতে গাছগাছড়া যেন উপচে পড়তে চাইতো। বাড়ির উঠোনে উঠোনে চাষ হতো দারা। বাঁশের টাল দিয়ে বোনা হতো শিম গাছ। সেই শিম গাছের ডগা এসে উঁকিঁঝুঁকি মারতো আমাদের ঘরের জানালায়। রোজ সকালে শিশির এসে ধুয়ে দিয়ে যেত সেইসব গাছগাছড়া, বাড়িয়ে যেত সবজির স্বাদ। আজো চোখে ভাসে শিমসহ মাঠে মাঠে ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম আর মুলার সবুজতা। তখন খাওয়াদাওয়াতেও এক নতুন ফুর্তি নতুন আমোদ! ক্ষেত বা টাল থেকে শিম বা মুলা অথবা ফুলকপি তুলে দাও না চড়িয়ে রান্নায় কই মাছের সঙ্গে কী শোল মাছের সঙ্গে কী হোক না পুটি ট্যাংরার সঙ্গে মানিকজোড়। তারপর দেখো সালুনের কী সোয়াদ কী টেস্ট! অমৃত বললেও ভুল বলা হবে! জীবনের সেই রঙিন উৎসব আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ মেলা তো কাল নাটক, পরশু কোন বিয়ে বা মুসলমানি একটার পর একটা লেগেই থাকত। সিদ্ধেশ্বরীতে ছিল এক পাহাড়, তার গায়ে ছিল বিশাল এক বটবৃক্ষ, সেটাকে ঘিরে প্রতিবছর বেশ বড়সড় মেলা হতো। বাইমাইলের কাসেম কটন মিলস লিমিটেড-র দু’রাতব্যাপী নাটকের জন্য যেন পুরো গাজীপুরের মানুষই অপেক্ষায় থাকত সারা বছর। একরাতে হতো সামাজিক নাটক আরেক রাতে ঐতিহাসিক। একটা নাটকের নাম কেবল স্মৃতিতে গভীরভাবে গেঁথে রয়েছে, আবীর ছড়ানো মুর্শিদাবাদ। মেয়ের চরিত্র ছেলে দিয়ে করানোর রেওয়াজ তখন উঠে গেছে। নাটক হওয়ার দশবারোদিন আগে থেকেই ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে মহিলাশিল্পীরা এসে রিহার্সেল করে যেত! সে নিয়েও গ্রাম্যযুবাদের মধ্যে ভিন্নতর উত্তেজনা! শুধু কি এই বাইমাইল! প্রতিটি গ্রামের যুবক সম্প্রদায়ই শীতে নাটক নামানোর জন্য মাসব্যাপী মেতে থাকত রিহার্সেলে।
আর একটু সেকেলে যুগের মুরুব্বিরা যারা তখনো বেঁচেছিলেন, তাদের এই যাত্রা থিয়েটারে ঠিক পোষাতো না। কী যে সব হয় না আজকালকার যাত্রা নাটকে! কিসের সব প্রিন্সেসরা আসে, দেখো তাদের ঝুমুর ঝুমুর নাচ! ঠিকই চাদ্দরমুড়ি দিয়ে মুখটা লুকিয়ে দেখে আসা হতো সে-নাচ। কিন্তু, পরের দিনই ওসবের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে হেঁকে উঠতেন কমলারাণীর বনবাস নামানোর জন্য! তখন রূপবান পালার যুগ কেবল শেষ হয়েছে, শীত মানে আজ এ পাড়ায় তো, কাল সে পাড়ায়, পরশু সেই গ্রামে কমলারাণীর বনবাস! গ্রামের মানুষ সারারাত জেগে জেগে দেখতো সেই যাত্রাপালা! কমলারাণীর পাটটা কিন্তু তখনো ট্র্যাডেশনালি চালাচ্ছে ছেলে অভিনেতা। কী ছিল রূপবান-এ আর কী ছিল কমলারাণীর বনবাসে? সেসব নিয়ে নৃতাত্বিক বিশ্লেষণ করতেই পারেন কোন নন্দনতাত্বিক! সেই হারিকেনযুগে সেসবই ছিল বিনোদনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন! কবির গান, গাজীর গানও হতো। কাশিমপুর জমিদার বাড়ির মাঠে আসতো সার্কাস পার্টি! যতদিন সার্কাস পার্টি থাকত শুধু মস্ত বড় হাতীর দাপটই থাকত না গ্রামে, বরং চার পাঁচ ইউনিয়ন জুড়ে কী যেন এক বিশালত্বের আহ্বান, এসো হৃদয় বাঁধো একসঙ্গে একটা কুহকী মন্ত্র আকাশে বাতাসে আমন্ত্রণ ছড়াতেই থাকত!
বাড়িতে বাড়িতে চলতো পিঠেপুলির আয়োজন! শীত এলে পিঠে যেন বানাতেই হবে। সে অভাবী পরিবারই হোক আর স্বচ্ছল কী বনেদি পরিবার! পিঠে না বানালে যেন মাবোনঝিদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যেত। ঘরে ঘরে তো ঢেঁকি ছিলই। রান্নাঘরের ভেতরের অপরিহার্য পার্ট ছিল এই ঢেঁকি! তাতে আউলা চাল গুঁড়ো করে মেতে উঠো পিঠে বানাতে! তাও কী আবার এক রকমের পিঠা! চিতুই, ভাপা, পাটিসাপটা, দুধকলি, সিদ্ধকলি, পূন্যপুরী, দুধপিঠা, কুলি পিঠা আরো কত কত যে নাম আছে পিঠার, ভেদ আছে স্বাদেরÑবলে শেষ করা যাবে না। তাল নিয়েও পিঠে বানানোর বেতাল কা- হতো। আত্মীয়স্বজন যে যেখানে থাকত শহরে কী অন্য ডিস্ট্রিক্টে, আমন্ত্রণ করলেও আসত না করলেও এসে হাজির হতো বাড়িতে! সে এক আত্মীয়তার কুটুম্বিতার স্বর্ণযুগ ছিল বটে! খাঁটপালংক না থাক, হৃদয়ের জমিন এত বড় ছিল যে, যতই আসুক মেহমান, থাকার জায়গা ঠিকই হয়ে যেত, আজকের মতো বাইরের দেয়ালে কেউ সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখতো না, মেহমানের গাড়ি বাইরে রাখুন! আর বাইরেও থাকত না পুলিশের তর্জনিগর্জনি!
প্রতি বছর আমার দাদার বাড়ির গ্রামে শীত পড়া মাত্রই ফরিদপুরের গাছিরা এসে হাজির হতো। তারা আসে মানে গ্রামের ভেতর আরেকটা হৈ চৈ বাধা! নানা রকমের আয়োজন হওয়া। যা নানাবাড়িতে ছিল না। কীভাবে থাকবে, একটা খেুঁজর গাছ খুঁজলেও তো পাওয়া যেত না! আমাদের দাদার বাড়ির আইলে আইলে ছিল খেঁজুর গাছ। পাশের বাড়ির মাস্তান খাঁ চাচাদেরতো দুই বিঘা জমির ওপরই ছিল খেঁজুর বাগান। এত বড় খেঁজুর বাগান হোল গাজীপুর ডিস্ট্রিক্টেই ছিল কিনা সন্দেহ। বিকেলবেলা গাছি এসে প্রতিটি খেঁজুর গাছে চড়ে একটা জায়গা চাঁছাছুলা করে সেখান থেকে রস বেরুনোর ব্যবস্থা করত। তারপর সেখানে সূক্ষ্ম এক নলি বসিয়ে নলি দিয়ে যেখানে রস গড়িয়ে পড়ত, তার নিচে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যেত মাটির একটা গড়া। সারারাত চুইয়ে চুইয়ে রস পড়ে জমা হতে থাকত। সকালবেলা গাছি এসে প্রতিটি গাছ থেকে রসে ভরা গড়াগুলো তুলে নিত। কলসির পর কলসি রস ভরে নিয়ে ফিরে যেত ঢেরায়। তারপর বিশাল বড় চ্যাপ্টা এক স্টিলের পাত্রে ঢেলে ঝাল দেওয়া হতো সে রস। তিন চার ঘণ্টার মধ্যেই সেই কাঁচা রস ধীরে ধীরে পরিণত হতো চৌরসে। সেই চৌরসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত গ্রামের চারদিক। মৌমাছিরা নতুন আনন্দে শুরু করে দিত মাতামাতি! সেই চৌরস থেকেই পরে বিশেষ কায়দায় তৈরি হতো পাটালি গুঁড়!

চলবে...