উড়োচিঠি

নাহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮

ঘুম থেকে উঠেই হইচই ফেলে দেয়া ঘটনাটির কথা জানতে পারলো মাসুদ।
কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ঘটেছিল এটা। হুট করে সকল শিক্ষকের নামে একযোগে কিছু ক্ষ্যাপাটে কথাবার্তাসম্বলিত একটি চিঠি এসে পৌঁছেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা যে একটা মহান আদর্শের নাম, শুধু পেশা নয়, এইখানে যে জীবনের সকল বৈষয়িক ও ব্যক্তিস্বার্থ সম্পর্কিত চিন্তাভাবনাগুলোকে বিসর্জন দিয়ে আসতে হয়- এ জাতীয় উচ্চমার্গীয় চাল চাবানো কথার ফুলঝুরিতে সমাজের অবক্ষয় আর স্খলনের দায়ে সবাইকে উহ্যভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করে শেষে কিছুটা হুমকির সুর মিশিয়ে শেষ হয়েছিল সেই অনাকাঙ্ক্ষিত চিঠিটি।

প্রশাসনিক পর্যায়ে রীতিমতো হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল। উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রক্টর, রেজিস্ট্রারসহ প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে লম্বাটেবিল বৈঠক শেষে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্তকমিটি গঠন করে তবেই থেমেছিল প্রশাসন। কিন্ত প্রেরকের ঠিকানায় দেশের অপর প্রান্তের নামোল্লেখ থাকায় ও সরেজমিনে গিয়ে ওই নামে কাউকে না পাওয়ায় এবং সময়ের তীব্র গুরুত্বমোচন শক্তিতে বিষয়টা আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাস্তায় কাঁটা চামচ দিয়ে উপড়ে ফেলা চোখসমেত এক শিক্ষকের লাশ পাওয়া গেল তার কয়েকদিন পর। তখনও সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় এর সাথে অন্য কিছুর যোগাযোগ থাকতে পারে সেটা ভাবেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খুন হওয়া এখানে ঐতিহ্য পরম্পরার একটা ব্যাপার। তারই ধারাবাহিকতার অনিবার্য ফল হিসেবে নিয়েই এটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে চেয়েছিল সবাই যতক্ষণ না এর একটা নতুন মাত্রা হিসেবে ঠিক তার পরদিনই আবার একযোগে সকল শিক্ষকদের নামে সেই ভয়ঙ্কর উড়োচিঠি এসে পৌঁছল।

এবারের চিঠিটির ভাষায় এমন এক ধরনের ধোঁয়াশার জাল বিস্তার করা ছিল যে, চিঠির প্রেরকই খুনি কীনা সেটা নিয়ে সবার মনে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়ে গেল। মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসানো হলো। সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরা চলতে থাকলো। সন্দেহভাজন দুই ছাত্র এবং এক স্থানীয় ছেলেকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠানো হলো। উড়োচিঠির পুনরায় আগমনবার্তাটি আলোর বেগে ছড়িয়ে পড়ল। ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের হর্তাকর্তারা এসে পৌঁছল। গোটা দেশেই ব্যাপারটা নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেল। নানারকমের গল্প রটে গেল চারদিকে। সবাই একইসাথে প্রবল ভীতি আর কৌতূহলের সাথে ঘটনার ঘনঘটা প্রত্যক্ষ করতে লাগলো।

অন্য সবার মতো মাসুদও দুটো চিঠি পেল। প্রথমবার চিঠিটা আসার পর মাসুদ কিছুটা অবাক হয়েছিল। এ ধরনের একটি কাজ যে বা যারা করেছে মনে মনে তাদের ওপর কিছুটা খুশিই হয়েছিল ও। যদিও ও নিজে একজন শিক্ষক, তবু নিজ সম্প্রদায়ের ওপর এরকম বিমূর্ত দায় চাপিয়ে তাদের সচেতন করে তোলার একটা প্রচেষ্টা মনে করেছিল এটাকে ও। মাসুদ নিজেও ছাত্রজীবনে শিক্ষকদের সাথে ভেতরে ভেতরে একটা তীব্র বিরোধ অনুভব করতো এবং উত্তরকালে সে বিরোধের নিষ্পত্তির তাগিদ থেকেই নিজে শিক্ষক হবার একটা দুরন্ত স্বপ্ন জেগে উঠেছিল ওর ভেতর। স্বপ্নটা ওর সত্যিও হয়েছে বটে তবে চোখ উপড়ে ফেলে শিক্ষক খুন হবার পর দ্বিতীয় চিঠিটা যখন এসে পৌঁছল তখন রীতিমতো হাতপা ওর কাঁপছিল।

প্রত্যেক শিক্ষকই যার যার মতো করে সতর্কতা অবলম্বন করে চলাফেরা শুরু করলেন। কিন্ত সবাইকে চূড়ান্ত ত্রাসের দ্বারপ্রান্তে ছুড়ে ফেলে তারপরদিনই আরও এক শিক্ষককে গলাকাটা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রেনের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা গেল। এই ঘটনাটি মাসুদকে প্রবলভাবে নাড়া দিল। যত যা-ই হোক, সমাজের গভীর থেকে উত্থিত পচনে যত কিছুই আক্রান্ত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াক না কেন, নিজের শিক্ষকতা নিয়ে মাসুদের কিছুটা অতিরিক্ত গৌরব ছিল। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এই দুঃখের দরিয়াতে কি সে এইজন্য ভেসেছিল? শিক্ষকদের ওপর এরকমভাবে চড়াও হয়ে যারা সমাজ বদলাতে চায় তাদের প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা অনুভব করল ও। সমস্ত আত্মাভিমান একেবারে গোড়া থেকে সর্বোচ্চ রিখটার স্কেলে কেঁপে উঠল ওর। টানা দুইরাত জেগে অসহনীয় মোহগ্রস্থ চিন্তার দাবানলে পুড়ে, পচে যাওয়া সমাজের অভিশপ্ত ক্লেদের পাঁকে জড়িয়ে, ইতিহাসের তিতিক্ষার পরাজয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে রক্তাক্ত এই জনপদের বাস্তবতা অত্যন্ত নগ্ন ভাষায় রূপ দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখল মাসুদ।

পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসভায় প্রত্যেক শিক্ষক থমথমে মুখ নিয়ে হাজির হলেন। পিনপতন নীরবতায় মাসুদ প্রথমে প্রবন্ধটি পাঠ করল। এরপর ব্যাখ্যায় বর্ষীয়ান একজন অধ্যাপক অত্যন্ত কদর্য ভাষায় নিজেদের ও শিক্ষকশ্রেণিকে হেয়প্রতিপন্ন করে বক্তব্য দিলেন। সবশেষে উপাচার্যসহ প্রথম সারির শিক্ষকদের যৌথ নামে দেশের প্রত্যেকটি জাতীয় পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশ করার প্রস্তাব উত্থাপিত হলো এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, উপস্থিত সবাই-ই এতে সম্মতি জ্ঞাপন করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলেন। এরপর রাতারাতি চেহারা পালটে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের। ছাত্র শিক্ষক মিলে সারাদিন মিছিল, শ্লোগান আর প্রতিবাদ কর্মসূচি চলল। শিক্ষক খুনের বিরুদ্ধে নয় শুধু, সমাজের সকল অন্যায়, অত্যাচার আর অপশক্তির বিপক্ষে জোরদার কর্মসূচি শুরু হলো। প্রত্যেক শিক্ষক এসব সিদ্ধান্তে ও কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন ও অংশগ্রহণ করলেন। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের মাঝের ফাটল রেখাটিও যেন ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকল। নতুন করে জন্ম নেয়া এক প্রচন্ড উত্থানশক্তি যেন পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙেচুড়ে নতুন রূপ দিতে থাকলো। চলমান কয়েকটি জাতীয় ইস্যুতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনবরত চিৎকার উঠতে থাকলো।

অনেক কর্মক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সৎ মানুষগুলো যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করল। দেখা গেল, একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে অনেক ক্ষেত্রই ধাবিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। রাজনৈতিক মহল ও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকেও সাধারণের হৃদস্পন্দন বুঝে কিছু সত্যিকার অর্থেই কার্যকরী ভূমিকা পালন করা হলো। এরকম যখন বাস্তবতা, মাস দুই পরে হঠাৎই একদিন মাসুদ একটা অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার করল। সেই তার পর থেকে আর কোনও শিক্ষকই খুন হয়নি, তৃতীয় চিঠিটিও আসেনি এখনো। তার মানে কি খুনিরা ভয় পেয়ে গেল? নাহ, যারা এরকমভাবে কাজ করে, তারা ভীত নয় নিশ্চয়ই। তাহলে তাদের মাথার ভেতরে এখন কি চলছে?

সন্ধ্যার পরে অমীমাংসিত এসব ব্যাপার নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল মাসুদ। হঠাৎ এর উত্তর পাওয়ার মতো একজন মানুষ পেয়ে গেল সে। ড. লিংকন। বাঘা স্কলার, একজন সামাজিক মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক। ওনার বাসার সামনেই দেখা হলো তার সাথে, ড. লিংকন মাসুদকে পছন্দ করেন, ওর আগ্রহ আর তেজ দেখে নিজের যৌবনের কথা মনে হয় তার, মাসুদকে ওনার পড়ার ঘরে রেখে তিনি চলে যান ভেতরে। মাসুদ বই ভালবাসে, শেলফে সাজানো সারি সারি বই দেখতে দেখতে হঠাৎই কিছু হলুদ খাম চোখে পড়ে গেল ওর। খটকা লাগলো। পেছনে ফিরে দেখে নিল কেউ আছে কীনা, কেউ না থাকলেও দরজার ওপরে সিসি ক্যামেরা দেখে স্বাভাবিক হয়ে বসল ও।

স্যার আসার পরে প্রাসঙ্গিক কথোপকথনের শুরুতেই এই খুনগুলো আর না হওয়া এবং আর কোনও চিঠি না আসা সম্পর্কে একটা অপরাধ মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা জানতে চাইলো ও। তিনি বললেন, যারাই এটা করে থাকুক না কেন তারা ভয় পেয়েছে এমনটা আমি ভাবি না। তবে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে তারাও হয়তো কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছে, অথবা হয়তো তারা আরও বড় কোনওি প্লানিং এ আছে, এর বাইরে আর কোনও এক্সট্রিম কার্যক্রম তাদের দেখা যাচ্ছে না। যেহেতু সঠিক করে বলা মুশকিল হবে যে, তাদের পরবর্তী অস্তিত্বের ম্যাসেজটা আমরা কিভাবে পাবো।

এরপর মাথা ঝুকিয়ে চশমার ওপর দিয়ে মাসুদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন, তবে আমার মনে হয় না তারা রাতারাতি এ রকম তিরোহিত হয়ে যাবে। মাসুদের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো। আর সাথে সাথে মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত অনুভব করল। তারপর সবকিছু অন্ধকার। পরদিন সকালে শহরের রেললাইনের পাশে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেতলে যাওয়া মাথায় মাসুদকে পড়ে থাকতে দেখা গেল। সেদিন দুপুরে হলুদ খামে করে আবার সবার নামে একটি উড়োচিঠি এলো...