একুশ নিয়ে লেখা কবিতাটি

রফি হক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৮

একুশ নিয়ে লেখা কবিতাটি ১৯৮২ সালের। আমি তখন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এখন আমার লেখক বা শিল্পী নাম ‘রফি হক’। এ নামেই পরিচিত। তখন আমি ‘রফিকুল হক রফিক’ নামে লিখতাম। ’৮২ সালে আমি ছন্দ মিলিয়ে ছড়া কবিতা লিখতাম। `৮০ সালের এক বর্ষণমুখর দুপুরে জীবনে প্রথম ছন্দ মিলিয়ে ছড়া লিখেছিলাম বৃষ্টি নিয়ে। তার দুটি লাইন মনে আছে, টিনের চালে বৃষ্টি/কী যে অনাসৃষ্টি.../যায় যতদূর দৃষ্টি/ বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি। খুবই দুর্বল নিরীহ ধরণের ছড়া। কিন্তু লিখে ফেলতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছিল। অন্তরের কোথাও একটা মিহিন সুখ অনুভব করেছিলাম। চোখ বন্ধ করলে তা এখনও অনুভব করি।

তখন কুষ্টিয়া থেকে ডাকে লেখা পাঠাতাম ঢাকাতে। কিশোর বাংলা, দৈনিক বাংলা, সংবাদের খেলাঘর ও ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরে পাতায় সেগুলি ছাপা হতো। ‘একুশ তুমি’ লেখাটি কলেজে আমার এক সহপাঠির (নামটি ভুলে গেছি) ওপর জিদ করে লিখেছিলাম। সহপাঠিটি প্রায় প্রায় কবিতা লিখে এনে ক্লাসে সহপাঠিনীদের বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়তো। শাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরে সে আসতো। একটি অফ হোয়াইট কাশ্মিরি শাল লম্বা হয়ে কাঁধ থেকে হাঁটু অব্দি ঝুলে থাকতো তার। সহপাঠিনীদের সম্মুখে তার কবিতা পড়বার মুদ্রাভঙ্গিটি বেশ ছিল। আমার কাছে বিষয়টি খুব গায়ে পড়া ধরণের লাগতো। হয়তো চিকন ঈর্ষাও হতো। কারণ সহপাঠিনীদের কাছ থেকে সে আলগা খাতির পেত। সে জানতো আমি লিখি। এ-ও জানত যে, আমি মুখচোরা ও লাজুক প্রকৃতির। একসময় আমার কাছে এসে বলতো, ‘তুমি পারবে এরকম লিখতে?’

এমনই একবার বলেছিল আমায়। আমার গায়ে লেগেছিল কথাটি। তারপর আমি এই লেখাটি সহপাঠিটির ওপর জিদ করেই লিখেছিলাম। লেখাটি আহামরি কিছু নয়। ও পর্যন্তই। আমাদের কলেজে বাংলা প্রফেসর ধীর আলি মিঞাঁ— তিনি একদিন শুনলেন। প্রশংসা করলেন। আরেক অধ্যাপক— আবু জাফর, খুব নাম করা গীতিকার, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যুমনা নদীর তীরে’, কিংবা ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম...’ গানের রচয়িতা আবু জাফর স্যার, তিনি বিখ্যাত ফরিদা পারভীন খালার স্বামী, আমার অনেকগুলি লেখা পড়লেন। খুব খুশি হয়ে বুকে টেনে নিয়ে বলেন, তুমি কিন্তু গান লিখতে পারো। আমার আরেকজন প্রিয় অধ্যাপক ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। ইংরেজি পড়াতেন। প্রফেসর আব্দুল কাদের চাচা। তাকে খুব ভয় পেতাম। তিনি অত্যন্ত সুদর্শন ছিলেন। কড়া এবং মেজাজি। কিন্তু তিনি আমার ওই কাঁচা বয়সের লেখা পছন্দ করতেন। অপার স্নেহ করতেন আমায়। রাজু আহমেদ স্মৃতি সংসদের লালিম ভাইয়েরা তো ছিলেনই। কিন্তু তখন একটু বড় হচ্ছি। বোধের বিষয়গুলি আসছে একটু একটু করে। আগের মতো আর আড্ডা দেই না। এই সময়ে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলেন, সঙ্গী ছিলেন— আমার মা।

আমার খুব মনে পড়ে— মা আমাকে কাপড়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে শার্ট-ট্রাউজারের কাপড় কিনে দিচ্ছেন। দর্জ্জির দোকানে নিয়ে গিয়ে মাপ দিয়ে জামা-কাপড় তৈরির অর্ডার দিচ্ছেন। বই বিচিত্রা থেকে আমার আনন্দমেলা দেশ পত্রিকা কিনে দিচ্ছেন। আমরা তখন নিতান্তই দরিদ্র। মা তবু টাকা বাঁচিয়ে আমার জন্য অনেক কিছু করতেন। আর তিনি যে কী খুশিই হতেন— তা এখনও চোখে ভাসে। আমি আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের এক বিধবা নারীর কথা বলছি। চল্লিশ বছর আগের এক মফস্বল শহরের কথা বলছি। এখন যা সহজ, তখন তা কল্পনাও করা যেত না!

অনেক কথা বলে ফেললাম। আমার এই নিচের লেখাটি বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮২’ পেয়েছিল। তখন সারা বাংলাদেশের সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো তথ্য মন্ত্রণালয়। তরুণ নবীন লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য। আমি কবিতায় জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছিলাম। ঢাকাতে খুব সুন্দর একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কারটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে কাদের স্যারের উদ্যোগে আমাকে ছোট একটি সংবর্ধনা দিয়েছিল ওই সময়। স্যার, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আমি আপনাকে ভীষণভাবে স্মরণ করি।

পুরস্কারটি পাবার পর, কুষ্টিয়াতে ফিরে আমি আমার সেই কবি সহপাঠির কাছে গিয়ে বলেছিলাম, ‘আমিও লিখতে পারি বন্ধু...’! এরপর থেকে আমি আর সেভাবে লিখিনি কবিতা বা ছড়া। আমি মনোযোগী হয়েছিলাম ছবি আঁকাআঁকি নিয়ে। আমি ঠিকই করে ফেলেছিলাম, আমি শিল্পী হবো। তখনও আমার মা আমার ছায়াসঙ্গী ছিলেন। আজ মা নেই। আমার সকল অনুভূতি প্রকাশের আশ্রয় ছিলেন তিনি। মা তোমাকে খুব মনে করি। অনেক ভালোবাসি। এই তো আমি দেখতে পারছি, তুমি ছলছল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছো!

কৃতজ্ঞ লন্ডন প্রবাসী অনুজ কবি কাজী রাহনুমা নূরের কাছে। ও আমার একটা কবিতা চেয়েছে, আবৃত্তি করবে বলে। রাহনুমা না চাইলে এ লেখা এবং এ সংক্রান্ত স্মৃতিগুলি অধরাই থেকে যেত হয়তো! লেখাটি পড়তে অনুরোধ করি। খুব সরল লেখা—

একুশ তুমি

একুশ তুমি কৃষ্ণচূড়া
রক্ত পলাশ ফুল,
একুশ তুমি মিষ্টি বোনের
রঙিন দুটি দুল।

একুশ তুমি রক্তে লেখা
জাতির ইতিহাস,
একুশ তুমি বাংলাদেশের
শ্যামল সবুজ ঘাস।

একুশ তুমি স্নেহময়ী
বাংলা মায়ের চোখ,
একুশ তুমি মায়ের বুকের
গহীন কালো শোক।

একুশ তুমি বাংলা মায়ের
মুখের মধুর ভাষা,
একুশ তুমি মিষ্টি বোনের
গভীর ভালোবাসা।

একুশ তুমি রক্তে মাখা
বীর শহীদের স্মৃতি,
একুশ তুমি আমার মায়ের
মিহিন গাঢ় প্রীতি।

একুশ তুমি বিজয় সূচি
সুখ স্বপনের বাণ,
একুশ তুমি আমার ভায়ের
রক্তে রাঙা গান।