অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

গল্পহীনতার গল্প

পর্ব ৩

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১০, ২০১৮

রবিউল করিম সম্পাদিক কথাসাহিত্যের কাগজ ব্যাস এ ‘আমাদের গল্প, আমাদের বীজতলা’ শিরোনামে লেখাটি ছাপা হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর দু’তিন মাস আগে লেখাটি তৈরি হয়। সে সময়ে কবি ছিল অসংখ্য, কিন্তু গল্প লিখিয়েদের খুব অভাব ছিল। যা এখনও আছে। সেই সময়ের চালচিত্র ও উচ্ছ্বাস পাঠকদের উদ্দেশে... আজ প্রকাশিত হলো চতুর্থ পর্ব

মাজুল হাসান: আমার পূর্বসূরি যারা আছেন, তারা কি রকম লিখেছেন আর আমরা তাদের থেকে আলাদা লিখছি, কী লিখছি না, যদি লিখে থাকি তবে নতুন কি ধরনের ফর্ম বা ভাষার কাজ আমরা করছি, এ বিষয়ে কিছু কথা বলা যায়। আমাদের অনেকের ধারণা এ রকম আছে, সাহিত্য ব্যাকরণ মেনে চলে না। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে, অবশ্যই সাহিত্য একটা ব্যাকরণ মেনে চলে প্রকাশের সুবিধার জন্যে। মানিক, ওয়ালীউল্লাহ কিংবা হাসান আজিজুল হকের কথা আমি বলব না। কেননা, তারা দুজন অনেক বেশি পরীক্ষিত। আমি বলতে চাই বাংলাদেশের আশি ও নব্বইয়ের দশক এবং এর পরবর্তী দকশ নিয়ে। যখন কীনা পরীক্ষামূলক লেখা শুরু হলো। ফর্ম নিয়ে ভাবা হলো। মিথিক্যাল ব্যাপারগুলো ইনক্লুড হওয়া শুরু হলো। আমরা অদিতি ফাল্গুনীর লেখায় দেখি, বেদ-উপনিষদের বিষয়-আশয় তিনি নিয়ে আসছেন। সেগুলোকে নতুনভাবে ভেঙে আবার আলাদা একটা চেহারা দিচ্ছেন। জাকির তালুকদারও ওই কাজটিই করছেন। সাদ কামালী একটু আলাদা রাস্তায় হাঁটছেন। একটা বিষয়কে নাড়া দেয়ার জন্যে, যত বেশি ভাবে একটা ঘা চুলকে দিয়ে রক্তাক্ত করা যায়, সে-ই বিষয়টিই তুলে ধলছেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে মিথিক্যাল বা ফর্মের ক্ষেত্রে যে ভাঙচুর হয়েছে আমরা হয়তো সেরকম একটা জায়গায় যাচ্ছি বা আছি। আমার যত বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাপার থাকুক, গল্পের ক্ষেত্রে কিন্তু পাঠকের সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ করতেই হবে। তবে কথা হচ্ছে, বিষয়বস্তু কী হবে, না হবে। যেহেতু আমার দশকটি শূন্য, তো আমি শূন্যের কথাই বলব। আমি কিন্তু সত্যিই এক শূন্য সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি উপস্থাপন করব আমাকে, এবং আমার সময়কে। এরপর সেটি লেখা হয়ে উঠল কীনা, এর বিচার সময়ের পাঠক করবেন।
কিন্তু গল্পকে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজেক্ট বানিয়ে ফেলার চেয়ে আরও ভালো দিক তাদের ছিল। আমার অগ্রজরা হয়তো এটি সচেতনভাবে করেননি। এর আবার কিছু উপকারও আমরা পেয়েছি। অনেক ফর্মের সঙ্গে চিন্তার সঙ্গে আমরা যুক্ত হতে পেরেছি। ফর্ম বিষয়ে আমার পরামর্শ হচ্ছে, গল্পের যে মূলকথা সেটাকে যেন ফর্ম বাধাগ্রস্থ না করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকতেই পারে কিন্তু আমার বক্তব্য পরিষ্কার করতে হবে। পূর্বসূরি গল্প লেখকেরা ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন বলেই কিন্তু আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গাটা তৈরি অবস্থায় পেয়েছি। আমার সময়ের গল্পকার বন্ধুদের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হবে, ওইসব ভাঙচুরকে ধারণ করে আমাদেও গল্পের সাবলীল গতিটা ধরে রাখতে হবে, সহজবোধ্য উপায়ে তুলে ধরা।

রাহাদ আবির: চমৎকার বলেছেন মাজুল হাসান। সত্যিই আমার সময়টা বেঁচে থাকার জন্যে অনুকূলে না। আত্মহত্যাপ্রবণতাও কখনও কখনও কাজ করে। আবার মনে হয়, কেন করব কিম্বা কেন করব না। এরকম দ্বিধা-সংকোচের সময় এটা। এইসব গল্পটল্প লিখে কিম্বা সংসার যাপনে বেঁচে থেকে লাভটাই বা কি? সুমন প্রবাহনের আত্মহত্যাও কিন্তু এর বাইরে না। অগ্রজদের লেখালেখি থেকে আমাদের লেখালেখি এগোচ্ছে কিনা, এ বিষয়ে বলা যায়, সময়ই আসলে সেটার বিচার করে দ্যায়। দেখা যাচ্ছে, বিশ বছর পরে আমাদের ভেতর যারা এখন লিখছে, কয়েকজন বাদ পড়ে যাবে। এটা কিন্তু সময়েরই বিচার। আমরা এখন পড়ছি তাদের লেখাই, যারা ওই সময়ের বিচারে উর্ত্তীণ।

আবু তাহের সরফরাজ: একটা গল্প যখন তুই বলিস, বিষয়কে তখন কী উপায়ে তার ভেতর তুলে আনিস?

রাহাদ আবির: বিষয় নির্বাচনে আমি মনে করি, যে ঘটনা আমাকে নাড়া দিচ্ছে, তা পাঠককেও অবশ্যই নাড়া দেবে। কেননা আমার আর পাঠকের কাছে ওই ঘটনার গ্রহণযোগ্যতা সমান। প্রথম গল্প লেখার সময় এরকম সঙ্কটে পড়েছিলাম। কি গল্প লিখব? কি নিয়ে? ঘটনা তো কতই চারপাশে ঘটে, কিন্তু এর মধ্যে লেখার মতো একটু আলাদা রকমের ঘটনা তো চাই। ভাবলাম, আমার বোধয় দেখার চোখ নেই। শরৎবাবু কত কী নিয়ে লিখেছেন। কত বৈচিত্র্য তার লেখায়। সে সময়ে খুব শরৎ পড়তাম। আর সেসব তো এমনি এমনি হয়নি, উনি কত ঘুরেছেন! বেড়িয়েছেন। বোহেমিয়ান জীবনযাপন করেছেন। সন্ন্যাসী হয়েছেন। তার মানে গল্প লিখতে হলে আমাকেও ঘুরতে হবে। বেশি বেশি মানুষের সাথে মিশতে হবে। জীবনকে বুঝতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে এর মধ্যে একদিন মায়ের মুখে শুনলাম, আমার ফুফুর পরিচিত কোনও এক মহিলা নাকি আত্মহত্যা করেছেন। পারিবারিক কোন্দলের জের ধরে। ব্যাপারটা খুব লেখার মতো একটা ঘটনা মনে হলো। সেদিনই ফুপুর বাড়িতে চলে যাই। কিছুক্ষণ কথাটথা বলেই সেই প্রসঙ্গ। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। একটা-দুটো জবাব দেয়ার পরেই ফুপু চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ এগুলো জিগাইতাছস ক্যান? এইসব জাইনা তুই কি করবি? আমি আমতা আমতা করি, নাহ এমনিই। এর দুদিন পর সন্ধেয় মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ফুপুর বাড়ি গেছিলি?
কী মুশকিল রে বাবা! গল্পের প্লট খোঁজা তো কম হ্যাপা না। ভেবে দেখলাম, মা-ফুপুর এরকম আচরণই স্বাভাবিক। যে আমি সাধারণত ফুপুর বাড়ি যাই না, সেই আমি সেদিন অনেকক্ষণ থেকে ওই ঘটনা জানতে চেয়েছি। এতে মা-ফুপুর আমার প্রতি অন্যরকম সন্দেহ হওয়াই তো স্বাভাবিক। অতএব আমি বুঝে নিলাম, এইভাবে ঘি উঠবে না। গল্প লিখতে হলে চারপাশের যেসব ঘটে, ওসব নিয়েই নিজের কল্পনার ভেতর ভাঙচুর করে তবে গল্প বানাতে হয়। অবশেষে একটি পারিবারিক নির্যাতনের কাহিনি নিয়ে গল্প লিখলাম। এই হলো আমার লেখা প্রথম গল্প। তবে এখন বুঝতে পারি, গল্প লিখতে কাহিনি কোনও বিষয় না, গল্প বলার কৌশলটাই প্রধান।

মোর্শেদ শেখ: আমার মতও তাই। যে বিষয়টা আমাকে তাড়িত কওে আমার চারপাশের ঘটনাগুলোর ভেতর থেকে, সেটাই আসলে গল্পের বিষয়বস্তু হওয়া উচিত।

আবু তাহের সরফরাজ: গল্পহীনতার গল্প ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলা যায়। এমরান কবির গল্প লিখছে। এবং গল্পের নিচে লিখে দিচ্ছে, ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এই গল্পে কোনও গল্প নেই’। সে এক একটা চরিত্র তৈরি করছে এবং কোনও একটি যাপিত জীবনব্যবস্থায় এগিয়ে নিয়ে গন্তব্যহীন পথে ছেড়ে দিচ্ছে। গল্পে তার বলার কিছুই নেই। কোনও ঘটনাও ঘটছে না। হাসান আজিজুল হককে একবার আমি জিগেশ করেছিলাম, গল্পহীনতার গল্প বিষয়ে বলুন। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, এটি একটি বিভ্রান্তিকর ফর্ম।

সজীব দে: গল্প তো বিভিন্ন রকমের হতে পারে। গল্পহীনতার গল্প বলতে আমি বুঝি, ইমেজের গল্প।

রাহাদ আবির: গল্প সে যেভাবেই লেখা হোক, আমার কথা হচ্ছে, সেই গল্পে যদি সে আমাকে নাড়া না দিতে পারে তবে আমি বলব, ওই গল্প না লিখলেও চলত।
সজীব দে: আমাদের সারাদিন কিন্তু একরকম যায় না। আমরা দুপুরে একরকম থাকি। বিকেলে একরকম। রাতে আরেক রকম। আমাদের গল্পগুলোও এ রকম। ইমেজের হরহামেশা পরিবর্তন ঘটছে। তো সে ওই ইমেজকে ধরে রাখতে চাচ্ছে। সেই কারণেই কিন্তু বেছে নেয়া গল্পহীনতার গল্প।

চলবে...