অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

জগতে জীবনের মানে পাগলের চিৎকার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১২, ২০১৭

বাংলা গদ্যসাহিত্যে নতুন ধারা উন্মোচনকারী আত্মমগ্ন কথাসাহিত্যিক রবিশংকর বল চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। চলেই যেন যেতে তিনি চাইছিলেন, যতদিন বেঁচে ছিলেন, সে আকুতিই তিনি লালন করতেন। রবিদার লেখা পড়ি সেই ২০০০ সাল থেকে। তখন থেকেই আমি তার প্রতি মুগ্ধ। এক সকালে গল্পকার পারভেজ হোসেন মুঠোফোনে আমাকে বললেন, সরফরাজ, রবিদা আসছেন ঢাকায়। তোমার কথা ওনাকে বলেছি। তুমি দ্যাখা করতে চাইলে বিকেলে বাংলা একাডেমিতে আসো। ওখানে জেমকন সাহিত্য পুরস্কারে উনি থাকবেন। সে-ই দ্যাখা হলো। এরপর তার সঙ্গে যা কথা, তা হয়েছে ফেসবুকের ইনবক্সে। তার আকস্মিক মৃত্যুতে আমি হতবিহ্বল। ছাড়পত্রের পাঠকদের জন্যে ইনবক্স থেকে রবিদা ও আমার কথোপকথন তুলে দিলাম। আবু তাহের সরফরাজ  

সরফরাজ: দাদাভাই, আপনারে আবারও ফেসবুকে পাইয়া ব্যাপক ফূর্তি পাইতেছি। আমার আত্মগর্ভস্থ শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন। যখন আঁধার যখন কুয়াশা নিয়া আপনার মন্তব্য জানার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছি। আমার তৃষ্ণা পূর্ণ করুন। ভালো থাকবেন।
রবিশংকর: শরীর খুব খারাপ। দেখা হলে তোমার বইটা নিয়ে ডিটেইলে বলতে পারতাম। তবে আমার অন্যরকম মনে হয়েছে। কোথাও পারলে লিখব।
সরফরাজ: কৃতার্থ থাকব দাদাভাই। আমার লুকনো স্বভাব। হট্টগোলে না-থাকায় সাহিত্যের ডামাডোলেও আমি নাই। লিখেই তবু আনন্দ আমার। আপনার সুস্থতা কামনা করি।
সরফরাজ: দাদাভাই, জগতে জীবনের মানে কি?
রবিশংকর: এক পাগলের চিৎকার।  Sound and fury.
সরফরাজ: তাইলে তো ভারবাহী পশুর মতো আমরা জীবনকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। অথবা আমরা প্রত্যেকেই সিসিফাস। জীবন অর্থহীন জেনেও বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। আমি তো এখন শূন্যতার ওপর শাদা ক্যানভাস দেখতে পাচ্ছি। ইচ্ছেমতো তা আমি রাঙিয়ে দেব। তবে তাও অর্থহীন। ওফ জীবন...
রবিশংকর: এখন সব অর্থহীন মনে হয়।
সরফরাজ: দাদাভাই, খোদার কসম, বেঁচে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। আর ভাবি, ক্যামনে এখনও আপনি বেঁচে আছেন।
রবিশংকর: আমিও ভাবি।
সরফরাজ: আই মিস ইউ দাদাভাই। স্বপ্নে আমি আপনার সাথে কথা কই। কী সব যে কই, ঘুম থেকে উঠে মনেও থাকে না।
রবিশংকর: স্বপ্নের কথাই সত্যি।
সরফরাজ: হ। আমিও নিশ্চিত যে, স্বপ্নই সত্যি।

এরমধ্যে এক রাইতে হইছে কী, শাহবাগের এক বারে গেছি। খুব চলতেছে...। কামরুজ্জামন কামু, তানিম কবির, অনিকেত শামিম, কবির হুমায়ুন, সাদ রহমান ও মাসুদ পথিকসহ ছ’সাতজনের একটি দল। দুটো টেবিল দখল করে চলতেছে বাকোয়াজি। হঠাৎ কবির হুমায়ুন কইলেন, সরফরাজ, রবিদা তিন-চারদিনের মধ্যে ঢাকা আইতেছে। আমার তো সময় নাই, তুমি একটু ওনাকে সময় দ্যাও। নাকি? আমি তো রাজি। রাইতে ইনবক্সে রবিদাকে লিখলাম, দাদাভাই, কবির ভাই কইল, আপনে নাকি তিন-চারদিনের মধ্যে ঢাকা আইতেছেন?
রবিশংকর: না তো!
সরফরাজ: কবির ভাই তাইলে বোধয় হুদাই কইছে। কাইল রাইতে বারে মদটদ খায়া কবির ভাই কইল, আপনি আসতেছেন। শুইনা তো আমি মহাখুশি।
রবিশংকর: হয়তো ভুল করেছে।
সরফরাজ: আপনার শরীর এখন কেমন আছে? ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। ভালোবাসা।
রবিশংকর: একটু ভালো। তুমি ভালো থেকো।
সরফরাজ: দাদাভাই, যদি কখনো সম্ভব হয়, যখন আঁধার যখন কুয়াশা নিয়ে কিছু হলেও লিইখেন। আর ভালো থাকবেন। আমার জীবন শৈশব থেকেই বিপর্যস্ত। আর পারছি না...। আপনার কেমন চলতেছে?
রবিশংকর: ভালো না। শরীর খুব খারাপ।
সরফরাজ: আপনার সুস্থতা কামনা করছি। আপনার মুখামুখি বসে থাকতে খুব ইচ্ছে হয়।
রবিশংকর: লেখো ভালো করে। তোমার লেখা অন্যদের চেয়ে আলাদা।
সরফরাজ: কৃতজ্ঞতা দাদাভাই। গুটিবাজি না জানলে শুধু ভালো লিখে ঢাকার সাহিত্য বৃত্তে এখন কেউ আর কলকে পায় না। নানা নোংরামি এখানে।

সরফরাাজ: দাদাভাই কেমন আছেন?
রবিশংকর: শরীর ভালো না। তুমি?
সরফরাজ: ভালোই। তবে চাকরিহীন দিন কাটছে...
রবিশংকর: কেন?
সরফরাজ: মানুষের মুখোশগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। তাই কর্মক্ষেত্রে মানিয়ে চলতে পারি না। এই আরকি... আপনি ভালো থাকুন। আপনাকে আমার অন্তরের নমস্কার।
রবিশংকর: লিখছো তো?
সরফরাজ: জি দাদাভাই। তবে ডামাডোলের বাইরে থাকলে যা হয়, প্রকাশ হয় খুবই কম। আমি এখন গ্রামে বসবাস করছি। জীবিকা বলতে সাহিত্য বিষয়ক একটা ওয়েব ম্যাগ সম্পাদনা। পড়া আর লেখার মধ্যেই কেটে যায় সময়। যান্ত্রিক জীবনযাপন থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির নিবিড়তায় ভালোই আছি। লেখক হিশেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ইচ্ছে নেই। একটু শান্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই হলো। তবু কখনও কখনও ইচ্ছে হয়, যা লিখেছি এ যাবৎ সব পুড়িয়ে ফেলি। কী লাভ এসব লিখে?
রবিশংকর: ভালো থেকো।