জলমগ্ন পাঠশালা

কাজল শাহনেওয়াজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০১৮

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি চর্চা আমার কাছে বেশ মজারই মনে হতো। এখানে পড়তে আসাদের লক্ষ্য পূরাটাই অন্য রকম। জীবনের আরো বাস্তব, আরো কার্যকরী বিষয়াদির ব্যাপারেই শিক্ষা সাজানো, থরে থরে। বাগানে গিয়ে অন্যরা যখন ফুল আর গাছের সৌন্দর্য দেখে, এখানকার বাশিন্দারা তখন প্রাকটিক্যাল ক্লাশে শেখে পাতার বৈশিষ্ট্য আর বৈজ্ঞানিক নাম।
আমার কবিতা লেখার ব্যাপারটা সবাই সেরকমই ভেবে নিয়েছিল। শুধু খুব কাছের কেউ কেউ বুঝতো, যে, এটা অন্য কিছু। খুবই ছোট সেই দল।
তবে আমি অনেকের সাথে মিশতাম। আর অপ্রচলিত কথাবার্তা বলতাম। আর জুটিয়ে নিয়েছিলাম একাধিক বন্ধুগ্রুপ, তারা পড়তো আবার অপ্রচলিত বা অগ্রগামী চিন্তাও করতো। ‘ছাঁট কাগজের মলাট’ পেয়ে সাধারণ কবিতা পাঠকেরা তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। আমিও জানতাম, এমনটাই হবে।
কিন্তু ততদিনে আমার চিন্তার পালে হালকা হালকা নিজস্ব হাওয়া খেলা করা শুরু করেছে। যখন ভাবছিলাম আমার জগত নির্মাণে কে কে শহীদ হবে, সে সময়, কোন এক দুপুরে, মেশিন সপে কাজ করতে গেছি, ভারী ছিল একখণ্ড লোহার টুকরা, লেদ মেশিনে চাকের সাথে সেটাকে লাগাতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ হাত থেকে পড়ে গেল তা। ঝনন করে শব্দ উঠল, নিস্তব্ধ দুপুর খান খান হয়ে গেল। আমাদের লাল রং বের করা ইটের টানেল করিডোর ভেদ করে সেই শব্দ যেন সমস্ত কিছু ভেদ করার জন্য পাগল হয়ে গেল।
আরেক রাতে ‘কুম’ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি রেললাইনের পাশ দিয়ে অন্ধকারে, দেখি ভেটেরেনারি গবেষকদের ঘোড়াটা, যার নাম বাহাদুর, সেই নির্জন পথে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে, পেটে তার ফুটো করে ফানেল বসানো, তা নিয়েই। দেখে মায়া নয়, অন্য এক বোধ কাজ করে গেল। মনে হল, এক মহান যাত্রায় সে-ও আমাদের মানুষদের জন্য নিজেকে গবেষণায় নিয়োজিত করেছে বটে, কিন্তু তারও কিছু নি:সঙ্গতা আছে, গোপনতা আছে। তারও নিজের মত করে প্রাচীন কায়দায় ঘাস খেতে ইচ্ছা করে।
এগ্রি.র ল্যাব-ময়, প্রমাণ সাপেক্ষ জীবনে নিজেকে বারবার প্রমাণ ও অপ্রমাণের ভিতর দিয়ে নিয়ে গেছি আমি। নিজেকে যথেষ্ঠ পুরস্কার ও শাস্তি দিয়েছি। সেসব কথা লিখতে পারার চেষ্টা করতে করতে জলমগ্ন পাঠশালার জন্ম।
ক্যাম্পাসের কাছেই ময়মনসিংহ শহর। ঢাকার সাথে খুব অন্তরাত্মার মিল এই শহরের। কিন্তু মানুষগুলি বেশ আঞ্চলিক থাকতে চায়, বিশেষ করে কবিরা। অনেক চেষ্টা করেছি তাদের সাথে গলাগলি করার। যৌথ কিছু করার। কিন্তু ঠিক সেই রকম ঐকতাণ হয়ে ওঠেনি। খুব অল্প কয়েকজনের সাথে মতামতের লেনদেন হয়েছিল মাত্র।
আবিদ আজাদ বললেন, এইবার বই করেন। আমিও ভিতরে ভিতরে তেতে ছিলাম বই করার জন্য। কারন ততদিনে ঢাকার বাতাসও কন্ডিসন্ড হয়ে উঠেছে। আগে যতটা ভালবাসা ছড়ানো থাকতো পথে ঘাটে তা এখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কম। আমি গদ্য লিখি, বেশ বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই লিখি, এসব জানাজানি হয়ে গেছে। অনেকেই চায়, তাদের বইটা নিয়ে কিছু লিখি, আড্ডায় চায় তাদের পক্ষে থাকি। বন্ধুরা চায় তাদের সাথে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বা সিলভানায় বসে গুলতানি করি। সম্পাদকেরা চায় তাদের টেবিলে সপ্তাহে একবার বসে আসি।
কিন্তু সেসব করা গেল না। আমার ভাল লাগে গলি থেকে তস্যগলির ভিতর থেকে এক টুকরা চিত্রকল্প খুঁজে বের করার জার্নি। জেমস জয়েসের কানা চোখের আলো দেখতে। সিলভিয়া প্লাথের সাথে কিছু দিন নারী জন্মের তালিম নিতে। লোরকার সাথে গ্রামেগন্জে ঘুরতে।
যাই হোক, বহুকষ্টে পাণ্ডুলিপি সাজালাম। খুব রিস্কি একটা গেম। তেমন কোনই প্রেমের কবিতাই নাই, যদিও প্রেমে হাবুডুবু খাইয়া হজমও কৈরা ফেলছি, শুধু শক্ত শক্ত বিষয়, লোহা লক্করের বিষয়। লেঅফ করা মেশিন পত্তরের কান্না। নিজের ভিতরের ভাষা খুঁজছি, স্বর অণ্বেষণ হচ্ছে।
আবিদ ভাই বললেন, প্রচ্ছদ করে দেন। তখন আমি নিজের জন্য আঁকাআকি করি। কিন্তু প্রচ্ছদ করলাম বিদেশি পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে একটা নারীমুখ নিয়ে, যে রূপচর্চার জন্য মাস্ক লাগিয়েছে। শুধু কেচি দিয়ে তার কথা বলার মুখটা কেটে দিলাম। আর চোখটাকে অর্ধেক ঢেকে দিলাম। শহরে তখন নতুন এসেছে অফসেট টেকনোলজি। আরামবাগ গেলাম। কালার সেপারেসন হল, কিন্তু কি রঙে ছাপা হবে? কালার চার্ট? দিলাম একটা র‍্যান্ডম চয়েস। লাল লাল মেটে মেটে। ছাপা হবার পর মাথা খারাপ। পূরাই ঝাকানাকা!
ব্যাক কভারে একটা ছবি লাগবে। কিছুদিন আগেই ১৯৮৮র বন্যা হয়ে গেছে, তখন ময়মনসিংহ ছিলাম। একটা ছবি পেলাম, বিখ্যাত রেলব্রীজের উপর দাঁড়ানো, পিছনে বন্যার পানি।
এই হলো সংক্ষেপে ‘জলমগ্ন পাঠশালা’ প্রকাশের গল্প!

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক