নিরুদ্দেশ

উপন্যাস পর্ব ৬

সজীব দে

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৮

সকালে ঘুম ভাঙে। ভোর পাঁচটা। জলের তৃষ্ণায় গলা মুরুভূমির মতো হয়ে আছে। আমি জলে বোতল নিয়ে এক ঢুকে এক লিটার জল খেয়ে ফেলি। মনে হয়, এ জীবনে প্রথম জল পান করলাম। ভয়ংকর এক স্বপ্নের ভেতর থেকে আসলে জেগে উঠেছি। স্বপ্নের বর্ণনা হুবহু কেউ দিতে পারবে না। আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। যতটুকু মনে পড়ে তা হলো, আমার চোখ বাঁধা। খোলা প্রান্তর। শীতের হাওয়া বইছে। অথচ আমার গায়ে যেন কাপড় নেই। আমার হাত পেছন দিকে বাঁধা। একটা দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকানো। কানে ভেসে এলো, স্যার, ও মুক্তি হ্যায়! আমি বুঝতে পারিনি মুক্তি মানে কি? আমার মনে হয়, মুক্তি মানে তো মুক্ত স্বাধীন। আমিতো মুক্ত স্বাধীনই। তবে সমস্যা কোথায়? আবারও কানে ভেসে আসে, স্যার ও শালা হারামি। উসকো নেহি ছোড়েগা...

আচ্ছা লোকটা কোন ভাষায় কথা বলছে? এটা কি উর্দু? ৫২ তে আমরা বাংলা ভাষা ছিনিয়ে এনেছি। গোটা বাঙালি তবে উর্দু বলছে কেন? শীতের বাতাসে আমি হিম হয়ে যাচ্ছি। শরীরের চামড়া ভেদ করে মনে হচ্ছে হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ছে ঠাণ্ডা। তবু আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আবারও কানে আসে, স্যার উসকো খতম কোর দো। আমার মনে হচ্ছিল, কয়েকটা রাইফেল আমার দিকে তাক করা আছে। আরেকজন বলল, শ্যুট হিম। সাথে সাথে কয়েকটি রাইফেল থেকে গুলি ছুটে এলো। প্রথম বুলেটের অনুভবটুকু মনে আছে। একটা গরম চাকু আমার বুকের পাজরের ভেতর যেন ঢুকে পড়েছে। এরপর আর কোনও শব্দ নেই। এখন আর শীত করছে না। বাতাস থমকে গ্যাছে। কিন্তু আমি মরছি না কেন? আমার এমনটা মনে হয়। আমার ঘুম ভাঙে। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। জল খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন।
আমি তরুণ। বয়স ২৫। ঢাকা ভার্সিটিতে চারুকলায় পেইন্টিংস এ পড়ছি। সামনে পরীক্ষা। পড়ালেখা বা ছবি আঁকার দিকে কোনও মনোযোগ নেই। বাবা সরকারি চাকরি করতো। বহুদিন হলো রিটায়ার্ড। আমি সবার ছোট ছেলে। দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকে। যদিও একই বাড়িতে। তাদের সাথে খুব একটা সখ্য নেই। নিজের মতো করে থাকি। বন্ধুবান্ধবও খুব বেশি নেই। আর প্রেমিকা? দুই বছর হলো তার সাথে সম্পর্ক নেই। আমার সাপটের বন্ধন ভালো লাগে না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি আমার ছোট কাকার মতোই হয়েছি। কিন্তু ছোট কাকা তো ভীতু। আমি ভীতু নই। আবার কখনও যদি যুদ্ধ হয় তখন আমি যুদ্ধ করবো। রিভালবারের প্রতি আমার কেমন জানি টান আছে। একটা রিভালবার থাকলে ভালো হতো। আজ ভার্সিটি যেতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা, কাকাকে কি স্বপ্নে কথা বলা যায়? বললে আর কী হবে? হয়তো চুপ করে থাকবে। কিন্তু আমার আবারও ঘুম পায়।
আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙে। কাকা ডাকে। দেখি, কাকা আমার মাথার পাশে বসে আছে। আমাকে জেগে উঠতে দেখে বললেন, সারাদিন ঘুমালি যে?
আমি জবাব দিলাম, আমার ঘুমোতে ভালো লাগে যে কাকা। যেমন মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছা করে। মরতে পারি না, তাই ঘুমিয়ে থাকি।
কেন মরতে চাস?
জানি না।
কাকা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমি উঠে বসি। কাকা বলে, চা খাবি?
না।
তুই চা খাস না?
মাঝে মাঝে। বাইরে যাবে আমার সাথে? চলো রিক্সা করে ঘুরি।
চল।
বাইরে ঠাণ্ডা। তুমি মাফলার নিয়ে নিও। আমি কাপড় বদলিয়ে কাকার রুমে যাই।
আমারা জানি না কোথায় যাব। আমাদের কোনও পরিকল্পনা নাই। একটা রিক্সা নেই। বলি, তোমার যেদিকে ইচ্ছা, সেদিকে চলো।
রিক্সা চলছে।
কোন দিকে যাবি?
জানি না। রিকশাঅলাকে বলি, চাচা যেদিকে খুশি নিয়ে যান। আজ আমরা বাড়ি ফিরবো না, বাড়ি আমাদের ভালো লাগে না।
কাকা বলে, এসব কী বলছিস?
তোমার ভালো লাগে বাড়ি, ছাদ, বিছানা, চেয়ার, বাড়ির মানুষ?
কাকা চুপ করে থাকে। আমি বলি, তুমি কি জানো আমি অনেকটা তোমার মতোই হয়েছি? পার্থক্য এটুকু তুমি ভীত, আমি না।
কাকা হসে। কাকার হাসির মধ্যে কেমন মাদকতা আছে। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। আমাদের রিক্সা চলছে। রিক্সাওয়ালা কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে সেসব কিছুই খেয়াল করছি না। আজ না হয় শহরটা ভুলে যাই।
তরুণ?
বলো?
আমরা কি স্বাধীন?
হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না।
যদি স্বাধীন না হই তবে এটা কীসের স্বাধীনতা?
ওই যে বাংলায় কথা বলছ।
এটুকু?
তোমার পরিচয় আছে। তুমি বাংলাদেশি বাঙালি।
হা হা হা... কাকা হাসেন। বলেন, আমার কেবল সংশয়। এই সংশয়ের কারণে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। আজ বললাম। এই মুক্তিযুদ্ধে যা হারিয়েছি। তার এক আনাও আর্জন করতে পারিনি। এত বড় যুদ্ধ তার বিনিময় আমি বাঙালি বাংলাদেশি! হা হা হা...
কাকা তোমার কী হলো?
না কিছু না। চল বাড়ি চল।
কেন? সবে বের হলাম।
আমার ভালো লাগাছে না। আমার কোন আইভেল্টি ক্রাইসিস নাই। কখনও ছিলাম না। তারচে বরং আমি যা হারিয়েছি তা কেবল হারিয়েছি। যুদ্ধ আমাকে নিঃশেষ কার দিয়েছে। চল বাড়ি চল।
আমি রিক্সাওয়ালা চাচাকে বলি, চলেন যে খান থেকে এসেছেন সে খানে চলেন?
রিক্সা ঘুরে, প্যাডেল ঘুড়ে। আমরা চুপচাপ বসে থাকি। বাসায় ফিরে আসি। কাকা দ্রুত তার রুমে চলে যায়। আমিও।
চলবে...