বইমেলা বনাম সিক্রেট স্টেট

বিশ্যুধবারের মৌর্সিপাট্টা

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮

বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় NGO ভোক্তা বলা যায়। আশির দশকে মার্ক্সবাদীদের চলতি স্লোগান ছিল NGO বিরোধী। বামপন্থীদের ডার্লিং ছিল তানভির মোকাম্মেল, আনু মুহাম্মদেরা। সময় গড়াতে গড়াতে মার্ক্সবাদীদের একটা বড় অংশকে লাখো রকমের খাইখরচা দিয়ে NGOগুলোর পরিচালনা পর্ষদে হজম করা হলো সামরিক একনায়কতন্ত্রের ব্যবস্থাপনায়। NGO তত্ত্বাবধানে ক্ষুদ্রঋণের বিকাশ এবং মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলো পত্রেপুষ্পে মঞ্জরিত হলো একই সময়খণ্ডে।

NGO পরিচালক, ব্যবস্থাপক, পরামর্শক, মাঠ পর্যায়ের কামলা ইত্যকার মিলায়েই মনোহারি এক সুশীল সমাজ; আজকে যার ডার্লিং সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামেরা। ক্যাপিটাল লেটারের ‘প্রাগ্রসর’দের পাশে পেট্রডলারের মৌলবাদী NGOকেও একই সময় ধনে-জনে ব্যাপকতরো ব্যাপ্তি দেয়া হলো। এই দলের ডার্লিং হলেন ফরহাদ মজহারেরা। তবে বিশ টাকায় বেগুনি বেচা ফরহাদেরা বা BRAC এর নান্দনিক কাবুলিওয়ালা মঞ্জুরুল ইসলামেরা বা জনমতামত-বিভ্রান্তকারী প্রথম আলো বস্তুত NGO ভিত্তিক সিক্রেট স্টেটের মাঝখানের লিয়াসো অফিসার মাত্র। পালের গোদাদের বেশিরভাগ সময়ই কাটে এয়ারপোর্টের ক্লাব ক্লাস লাউঞ্জে!

লিয়াসো অফিসারেরা দেখিয়ে দেয়, কোথায় জমি সস্তা কিম্বা কোথায় জমি কিনলে সুশীল সমাজকে সরাসরি কুঠিয়াল বলা যাবে না। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, লালনের মাজারের আশপাশে মাইলকে মাইল জমি হস্তগত করার পাশাপাশি এরা ব্যাঙের ছাতার চাষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে। কলা, আনারস ফলায় গারো পাহাড়ে। চট্টগ্রামের গারো পাহাড়ের আনাজপাতির ব্যবসার পয়সায় অট্টালিকা তোলে গুলশান, বারিধারায়। বন্যার সময় স্যালাইন দেয়া, দুস্থ বাচ্চাদের দুধ, কম্বল দেয়া অক্সফাম। সেভ দা চিল্ড্রেন কর্মকর্তাদের গুলশানে কেন থাকতে হয়, পয়সাই বা কে যোগায়?

সিক্রেট স্টেটের এই কুঠিয়ালদের সুশীল সমাজ হিসাবে জায়েজ করতে মিডিয়ার দরকার। মিডিয়া তো আগবাড়িয়েই তৈরি। মাইলকে মাইল জমির হাতবদলে যে কোনোরকম কারসাজি নাই, তার ঢাল হিসাবে কাজ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেক NGO। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সুলতানা কামালের আইন সালিশ কেন্দ্র। কিন্তু কখনোই সিক্রেট স্টেটের অপরাপর অংশীদারদের জাবেদা খাতা দেখাবার কোনও দাবি তোলে নাই। BBC, VOA র বাংলা কর্মকাণ্ডও কুঠিয়ালদের লাইফ স্টাইল নিয়ে, কোনও প্রশ্ন কোনোদিন তোলে নাই। বাংলাদেশে অতি তৎপর অক্সফাম, সেভ দা চিলড্রেনের জাবেদা খাতা ধামাচাপা দিতেই কি?

পালের গোদাদের বড় শরিক অধ্যাপক ইউনুস তথা গ্রামিণকে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট দেখালো কিন্তু জনগণের প্রতিনিধিরাই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নয়। বাংলাদেশে BRAC এত উন্নয়ন করেছে যে তাকে আফগানিস্তানের উন্নয়নের ঠিকাদারি দেয়া হয়েছে। এই আফগান উন্নয়নের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এক আমেরিকান-বাঙালি, যার বৌ আফগানি এবং এই কর্মকর্তা আবার এক সাবেক মন্ত্রিপুত্র। আমি জানলাম কিভাবে? ২০১০এ বাংলাদেশে ঘোরার সময় প্রায়ই যেতাম ধানমন্ডিতে আবাহনী মাঠের পাশে ভাগ্নির বাসাতে। সেখানে দেখতাম বাচ্চা কোলে এক টসটসে তরুণী ঘরোয়া পোষাকে ভাগ্নির সাথে ইট, পাথ্যর, ইংরেজি কি কি বলছে। আফগানিস্তান যে বাতিল জায়গা তা আমরা জানি! কিন্তু ওই মহিলার কাছে মার্কিন মুল্লুকও বাতিল জায়গা। BRAC জাত কাইকাবুলিওয়ালার কল্যাণে দাসি, বান্দি, ড্রাইভার, দারোয়ানের একটা শবনমি জগত; কুটাটাও ছুইতে হয় না। এই রকম ঠিকাদারী,সাংস্কৃতিক-সাব-ঠিকাদারী দেয়া হয়েছে গ্রুপ থিয়েটার, আবৃত্তি সংসদ, মার্কেটিং রিসার্চের রাজনদের।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই সাবেক মন্ত্রিপুত্রকে এই হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারির হিসাবরক্ষক করার পিছনে BRAC কুঠিয়ালের বহু হিসাব নিকাশ আছে। তবে সবই করা হয় সেই সামন্তবাদী ধারাতেই, ছেলের বৌ, মেয়ের জামাই হিসাবেই। ওহ আমাদের প্রিয় অক্সফাম, সেভ দা চিল্ড্রেন অবশ্যি বৌ, জামাই, বেয়াই হিসাবের বাইরে। সেগুলা চালাচ্ছে ভাই-ভগিনি কোম্পানি। মেধা থাকলে বৌ, জামাই, বেয়াই, ভাই, ভগিনিগিরিতে আমি নাক গলাবার কে? কিন্তু হাজার কোটি টাকার ত্রাণ, পরিত্রাণের হিশাবে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার পর্জায়ে যে conflict of interest বা স্বার্থের বিরোধ হয়, তাতে ভাইবোন, জামাই, বৌ কি রক্তসম্পর্কের বা শয্যাসঙ্গীর বিরুদ্ধে যাবে? বলতে পারবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টার্ন্যাশনাল এবং সুলতানা কামলেরা!

BRAC এর কাবুলিওয়ালা যেই কম্পাউন্ডে, সেই একই কম্পাউন্ডে থাকেন চাকমা রাজা দেবাশিষ। খুবই মাইডিয়ার, উনি সুশীল সমাজের। আমার ভাগ্নিও ওনাকে আঙ্কেল বলে। দেবাশিষ বাবু বড় ব্যারিস্টার। সুলতানা কামালের মতো ওনারও অধিকার আছে মেহনতের টাকা কোথায় খরচ করবেন, কোথায় থাকবেন তা নির্বাচনের। কে কোথায় থাকে এই সাত সতেরোর সাথে বইমেলাতে NGOর বৈ-বর্জনের কি যোগসাজশ? চাকমা রাজা কাঠের কারবারী নাকি NGO মন্সবদার, তাও তো আমি জানি না। না জানার স্পেকুলেশানে না গিয়ে জানা পরিধিতেই ঘুরপাক খাওয়া যাক।

বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগের বিশাল একটা অংশই NGOদের হাতে। প্রায়োগিকভাবে সিক্রেট স্টেটের তথা NGOর মূলনীতি হচ্ছে গরিবে বানাবে তালপাখা, গার্মেন্টস; বড়লোকে পাবে শিক্ষা। বেসরকারি-ব্যক্তি পুঁজিকেও এই NGO নিতি নিয়ে যাচ্ছে এমন এক চোরাবালিতে যে, ব্যক্তি পুঁজি তার মুনাফা ব্যয় করছে চড়ামূল্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যকার প্রাথমিক সেবাখাতে, শ্রমিকের কল্যাণের বদলে। সরকারি, বেসরকারি/ব্যাক্তি পুজির বাইরে NGO পুঁজির আর্থিক দিকটাকে সমান্তরাল ব্যবস্থা বলা গেলেও রাজনৈতিক দিকটা প্রায় আলোআঁধারির কুহেলিকাতে ঢাকা। জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন, দরিদ্র বিমোচন এদের স্লোগান হলেও এদের পাব্লিক রিলেশানের একটা বড় দিক হচ্ছে, জনপ্রতিনিধিদের এবং জনপুঁজির প্রতিষ্ঠানের লাগাতার সমালোচনা। এই সমালোচনার পাশে কৌশলগত যে-কারণে এরা লালন, রবিন্দ্রনাথ, গ্রুপ থিয়েটার ইত্যকার বেগুনি ভাজি করে; সেই একই কারণে বাংলা একাডেমির বইমেলার দখলদারি নেয়াটাও দরকারি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে দলবাজ শিক্ষকদের কারসাজিতে প্রতিরোধও হয়ে পড়েছে দুর্বল।

নামে, বেনামে বইমেলার ৪ ভাগের আড়াই ভাগই NGO তথা সিক্রেট স্টেটের বই কী। সাংবিধানিক স্টেটের RAB জাতীয় প্রতিষ্ঠান থাকায়; সাম্প্রদায়িক নীতিমালা থাকায় সিক্রেট স্টেটের আরো পোয়া বারো। পাকিস্তানিরা বাংলাতে পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগ করেছিল। সেই পোড়ামাটির ছাইভস্ম মাখা কুহেলির-কাপালিক, বাঙালির-খুলিতে বাঙালিরই হৃদরক্তস্পন্দন পান করতে চাইছে। চার ভাগের আড়াই ভাগ NGO প্রকাশনা, বাকিটা পুলিশ আর প্রথম আলোর। প্রতিটা বইমেলার মধ্য দিয়ে এই সিক্রেট স্টেট তার কৌশলগত লক্ষ্যে আরেক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ভাগ্যের উন্নয়নের আড়ালে এদের লক্ষ্য বাংলা ভাষাকেই বাহন করে বাংলাদেশকে শোষণ। গার্মেন্টস বিক্রির, আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের কষ্টার্জিত উপার্জনের একটা আধলাও সিক্রেট স্টেটের দস্যুদের এবং তাদের বুদ্ধিজীবীদের কোষাগারে দিয়ো না। দুই বাংলার বই মেলা, NGO, সুশীল সমাজ এবং সিক্রেট স্টেটের বই বর্জন করো।