হযরত মুহাম্মদ (সা.)

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০১, ২০১৭

আরবি মাসের আজ ১২ রবিউল আউয়াল। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক শেষনবি হযরত মুহাম্মদের (সা.) জন্ম ও মৃত্যুদিন। আন্তরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে আমরা এই মহামানবকে স্মরণ করছি। বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হযরতের জীবনী ছোট্ট কিন্তু খুবই হৃদয়গ্রামী করে লিখেছিলেন। আজকের এ দিনে সে লেখাটি ‘ছাড়পত্র’ এর পাঠকদের জন্যে পুনর্মুদ্রণ করা হলো।

এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ জুড়িয়া খুব বড় এক মরুভূমি আছে। ইহার নাম আরব মরুভূমি। অতি প্রাচীন কাল হইতে এই মরুভূমির দেশে আরব জাতি বাস করিত। তাহারা লাত, মানত, হবল ইত্যাদি ইত্যাদি ৩৬০টি দেব-দেবীর পুতুল বানাইয়া পূজা করিত; তাহা ছাড়াও নানা রকম গাছপালা, ইটপাথর প্রভৃতিকে দেবতা বলিয়া মানিত। এই জাতি ছোট ছোট শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হইয়া পরস্পর মারামারি খুনাখুনি করিয়া সময় কাটাইত। তাহারা বেজায় মদ খাইত ও চুরি-ডাকাতি লুটতরাজ করিয়া দেশে এক ঘোরতর অশান্তির সৃষ্টি করিয়া রাখিত। মেয়ে জন্মিলে তাহাকে জ্যান্ত পুতিয়া ফেলিত। এত দোষের মধ্যেও তাহাদের বিশেষ একটি গুণ ছিল; তাহারা কবিতা বড় ভালবাসিত। প্রত্যেক দলেরই প্রায় কয়েকজন করিয়া কবি থাকিত। তাহারা ছড়া বাঁধিয়া গান গাহিয়া অন্য দলের বিরুদ্ধে নিজেদের লোকদিগকে ক্ষেপাইয়া দিত; এইভাবে দুই দলে যুদ্ধ বাঁধিত।
সমাজ যখন একেবারে পাপের চরমে গিয়া পৌঁছে, তখনই তাহাতে মহাপুরুষের জন্ম হয়। তাহাতেই যে সমাজ একেবারে মরণ দশায় গিয়া পৌঁছিয়াছে তাহা আবার বাঁচিয়া ওঠে। সকল সময় সকল দেশেই এই নিয়ম। আরব জাতির এই ঘোর দুর্দিনে এক মহাপুরুষের আবির্ভাব হইল। তাঁহার নাম হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
মক্কা তখন হইতেই আরব দেশের খুব নামকরা স্থান ছিল। মক্কার শ্রেষ্ঠ সম্ভ্রান্ত বংশের নাম ছিল কুরাইশ। প্রসিদ্ধ এ বংশে খ্রিস্টিয় ৫৭১ সালে ২০ এপ্রিল (রবিউল আওয়াল মাসের ৯ কিম্বা ১২ তারিখ) সোমবার হযরত মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) জন্ম হয়। তাঁহার পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম বিবি আমিনা। জন্মিয়াই তিনি বাপ-হারা। আবার ছয় বছর বয়সেই তিনি মা-হারা হইলেন। পিতামহ আবদুল মুত্তালিব এই অনাথ শিশুকে মানুষ করিতে লাগিলেন। কয়েক বছর পরে তিনি মারা গেলেন। তখন তাঁহার এক চাচা আবু তালিব তাঁহাকে আশ্রয় দিলেন। এইরূপ দুঃখের পর দুঃখের ভিতর দিয়া তাঁহার বাল্যকাল অতীত হয়। তারপর পঁচিশ বছরে তিনি খাদিজা (রা.) না¤œী বিধবা এক মহিলাকে বিবাহ করেন। খাদিজা বিবি (রা.) তাঁহার অপেক্ষা বয়সে বড় ছিলেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) বাহিরের রূপ-যৌবন দেখিতেন না; তিনি অন্তরের গুণেরই পক্ষপাতী ছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছেলেবেলা হইতেই নিরিবিলিতে বসিয়া চিন্তা করিতে ভালবাসিতেন। বিবাহের পরেও তিনি সংসারের সুখভোগ ছাড়িয়া মক্কার নিকটে হেরা পাহাড়ের গুহায় বসিয়া প্রায়ই ধর্মচিন্তা করিতেন। তাঁহার দেশবাসীর কথা ভাবিয়া তাঁহার বড় দুঃখ হইত। কেমন করিয়া তিনি এই পাপাচারী সমাজকে সৎপথে টানিয়া আনিতে পারেন, এই চিন্তাই তাঁহাকে সকলের চেয়ে বেশি আকুল করিয়া তুলিত।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়স হইলে তিনি আল্লাহর নবী রূপে প্রকাশিত হইলেন। সেই বছর রমজান মাসের এক গভীর রাত্রে তিনি হেরা পাহাড়ের গুহায় একাকী ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি আল্লাহর আদেশ পাইলেন। ভাবিতে ভাবিতে ঘরে আসিয়া তিনি খাদিজাকে (রা.) সকল কথা কহিলেন। খাদিজা (রা.) বলিলেন, আপনি কিছুই ভাবিবেন না। আপনি লোকের বিশ্বাস রক্ষা করেন, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করেন, সদা সত্য কথা বলেন। আল্লাহ আপনাকে লজ্জিত করিবেন না।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) আশ্বস্ত হইলেন। ইহার ফলে ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জগতে এক ধর্ম প্রচার করিলেন। তাহার নাম ইসলাম ধর্ম। ইহার মূলমন্ত্র, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলল্লাহ। এর অর্থ, আল্লাহ ছাড়া আর কোনও উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।
তিনি প্রচার করিলেন যে, আল্লাহ এক; তিনি স্বয়ং মূসা (আ.) ও ঈসা (আ.) প্রভৃতির ন্যায় আল্লাহর পয়গাম্বর বা দূত। নানা দেব-দেবীর পুতলি পূজা মিথ্যা; মানুষ এক নিরাকার আল্লাহরই উপাসনা করিবে; তাঁহার নিকট কেহ ছোট জাতি, কি কেহ বড় জাতি নাই, সকলকেই আল্লাহ সমানভাবে দেখেন। সেই জন্য এই ধর্মে জাতিভেদও নাই। আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণভাবে নিজকে সঁপিয়া দিয়া এবং সকলকে ভালবাসিয়া ও সকলের ভাল করিয়া আল্লাহর প্রিয়পাত্র হইতে হইবে, ইহাই এই ধর্মেও গোড়ার কথা। জোর করিয়া ধর্ম প্রচার এই মতে নিষিদ্ধ।
সকলের প্রথম তাঁহার পতœী হযরত খাদিজা (রা.) তাঁহার ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেন। তৎপর হযরত আলী, আবু বকর, উসমান প্রভৃতি ঈমান আনেন। পরে নতুন এই ধর্মের কথা শুনিয়া মক্কাবাসীদেও কতক লোক আসিয়া তাঁহার শিষ্য হইল। এমন কি হযরত উমর যিনি প্রথমে রাসূলের (সা.) ঘোরতর দুশমন ছিলেন, মুসলমান হইলেন। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই তাঁহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইল। হযরত মুহাম্মদের (সা.) ৫০ বছর বয়সের সময় তাঁহার চাচা আবু তালিবের মৃত্যু হইল। এই সময় খাদিজাও পরলোক গমন করেন।
খাদিজার (রা.) মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁহার বিরহে বড়ই কাতর হইয়া পড়েন। তখন হযরত আবু বকর (রা.) প্রিয় বন্ধু রাসূলের (সা,) জীবনের আনন্দের জন্য তাঁহার সহিত নিজের কন্যা আয়েশাকে (রা.) বিবাহ দেন। হযরতের ওফাতের পর তিনি ৪৮ বছর বাঁচিয়া ছিলেন। তিনি যেমন তেজস্বিনী, সেইরূপ ধার্মিকা ও বিদুষী ছিলেন। তিনি হযরতের জীবিতকালে ওহুদেও যুদ্ধে নিজের পিঠে পানির মশক বহিয়া তৃষ্ণার্ত মুসলমানদের পানি পান করাইয়াছিলেন। হযরত মুহাম্মদের (সা.) দেহত্যাগের পর যখন কতক লোকে তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানকে শহীদ কওে, তখন তিনি অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য স্বয়ং যুদ্ধ করিয়াছিলেন। তিনি প্রায়ই অতিরিক্ত নামাজ ও রোজায় কাল কাটাইতেন এবং প্রা প্রত্যেক বছর হজ্জ করিতেন। তিনি দানশীল ছিলেন।
আবু তালিবের মৃত্যুর পর বিধর্মীরা হযরতের শিষ্যগণকে বেশি করিয়া জ্বালা-যন্ত্রণা দিতে লাগিল। এমন কি অবশেষে তাহারা তাঁহাকে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিতে লাগিল। তখন আল্লাহর আদেশে খ্রিস্টিয় ৬২২ সালের ২০ জুন (রবিউল আউয়াল মাসের ৪ তারিখ) হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মভূমি মক্কা হইতে প্রস্থান করিলেন। মক্কা ছাড়িয়া তিনি মদিনায় আসিলেন। এই হিজরতের (প্রস্থানের) সময় হইতেই মুসলমানেরা একটি সন গণনা করিয়া থাকেন। এই সনের নাম হিজরী।
মদিনার লোকে তাঁহাকে আদরের সহিত গ্রহণ করিল। ক্রমে তাহারা সকলেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লইল এবং এই ধর্ম চারিদিকে প্রচার করিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল। মদিনাবসীগণ হযরত মুহাম্মদকে (সা.) তাহাদের প্রধান শাসনকর্তার পদে স্থাপন করিয়া তাঁহার প্রতি নিজেদের আন্তরিক ভক্তি দেখাইল।
রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আশ্রয় পাইলেন বটে, কিন্তু মক্কার শত্রুদের হইতে নির্ভয় হইতে পারিলেন না। হিজরীর দ্বিতীয় বছর তাহারা প্রায় এক হাজার সশস্ত্র সৈন্য লইয়া মদিনার উপর হামলা করিল। ১৬ রমজান মদিনার নিকটবর্তী বদও নামক স্থানে মুসলমান ও বিধর্মীগণের এক যুদ্ধ হইল। মুসলমানগণ সংখ্যায় ৩১৩ জন মাত্র এবং সামান্য অস্ত্রধারী হইয়াও শত্রুদের হটাইয়া দিয়া যুদ্ধে জয়ী হইলেন। মুসলমানদের ১৪ জন শহীদ হইলেন। শত্রুপক্ষে ৭০ জন মারা গেল এবং ৭০ জন বন্দি হইল।
এই বছরের শেষের দিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের প্রিয়তমা কন্যা ফাতেমা বিবির (রা.) বিবাহ হযরত আলীর (রা.) সহিত সম্পন্ন করেন। হযরত ফাতেমা (রা.) আদর্শ রমণী ছিলেন। তাঁহার কোনও বাঁদি-চাকর ছিল না। তিনি নিজের হাতে গৃহস্থালির কাজ করিতেন। যাঁতা পেষা, মশক করিয়া পানি আনা, রাঁধা-বাড়া সকল কাজই তিনি হাসিমুখে সম্পন্ন করিতেন। হযরত হাসান (রা.) এবং হযরত হুসাইন (রা.) তাঁহারই দুই পুত্র। হযরত মুহাম্মদের (সা.) ওফাতের ৬ মাস পওে তাঁহার ইন্তিকাল হয়।
হিজরতের আট বছর পরে হযরত মুহাম্মদ (সা.) দশ হাজার শিষ্য লইয়া বিজয়ী বেশে আবার মক্কায় ফিরিলেন। মক্কার কুরাইশ বংশ তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিয়া ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হইল। মক্কার প্রসিদ্ধ কা’বা গৃহ তখন হইতে ইসলামের তীর্থস্থানে পরিণত হইল। তাহাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহের অবসান হইল। সমস্ত আরবদেশ ব্যাপিয়া ইসলামের শান্তিরাজ্য স্থাপিত হইল। তিনি সকল সময় দীন দরিদ্রের ন্যায় জীবন কাটাইতেন। তিনি খেজুর পাতার চাটাইতে শুইতেন, নিজের হাতে কাপড়ে ও জুতায় তালি বসাইতেন, ঘর ঝাঁট দিতেন, দুধ দুহিতেন, অতিথির সেবা করিতেন। আল্লাহর উপাসনা ও ধর্ম প্রচার তাঁহার জীবনের প্রধান কার্য ছিল। মদিনা নগরে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে (১১ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ১লা) সোমবার ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁহার মুখের শেষকথা ছিল, হে আল্লাহ! সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু।
দেহত্যাগের পূর্বেই তিনি সমস্ত আরববাসীকে এক ধর্মে দীক্ষিত করিয়া শক্তিশালী এক জাতিকে পরিণত করিয়াছিলেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছোটদের নবী কথা বই থেকে সংগৃহীত