অ ও আ

পর্ব ৬

মো. খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সল

প্রকাশিত : আগস্ট ১৬, ২০১৮

গল্পের জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে কখনো কখনো প্রকাশের আলোতে হারিয়ে যায় বিদেহী আত্না! প্রকৃত পরিচয় গহ্বরে হারিয়ে আত্মহননের খেয়ালিপনা শবকে গভীর ভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারা দেহযষ্টি তখন নিজের মাঝে হারিয়ে যায়। চিন্তাজগত আর কল্পনাজগতের সৌজন্য মনোভাব আর হরিণী চোখের মোহে বাস্তবতার পথ থেকে দূরে নিয়ে যায়, ফলশ্রুতিতে একসময় নিজের অস্তিত্বের সংকট হন্য হয়ে ধরা দেয় হাতের মুঠোয়। সেবেলায়, হারানো গানের সুর মনের কোণে বেজে উঠলে প্রাণহর দেহ যেন স্বর্গের অমৃতকে আঁকড়ে ধরে উঠে!

 

করিডোরের শেষ মাথায় জানালার পাশে বসানো চেয়ারগুলোর শেষাংশের চেয়ারে ঝিম ধরে আছে শুভ্র। কতক্ষণ পেরিয়ে গিয়েছে তা সম্ভবত হিসেবের বাইরে। এক ভয়ংকর আর্তনাদ যেন কেঁদে উঠছে বারে বারে, নিদারুণ কান্নার স্রোতে শুভ্র ভেসে যাচ্ছিলো তখনও। এক কাঁধ ক্লান্তিতে শরীরে নুয়ে আসছে, এক কোল ঘুম কেড়ে নিচ্ছে শুভ্রকে! যেন এখনো স্বপ্নের রাজ্যে চলে যাবে সে, আর বাকি সবকিছুকে পিছনে ফেলে আকাশের ‘পরে মেঘের রাজ্যে চলে যাবে সে। একমনে ভেবে যাচ্ছে শুভ্র অনেককিছু, ভাবছে অনন্তকাল ধরে যেন ঘুমানো হয় না!

 

শুভ্রাকে ডেকে এনে পাশে বসিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, “শুভ্রা, এই শোন না! আমার পাশে বসে আমার চুলে একটু বিলি কেটে দে না! অনেকদিন ধরে দিস না, তাই অনেকদিন ঘুমোতে পারি না! আজকে দিবি একটু, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে রে..!”

 

আবেশের স্মৃতি তখন হুড় করে কেঁপে উঠে এক আওয়াজে, চোখ মেলে দেখে শুভ্রা রুম থেকে ফাইল হাতে বেরিয়ে আসছে মুচকি হাসি নিয়ে। যেন কত যুগ পরে শুভ্রার হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণায়, পিছনে ৫-৬ মাস যেন এখনের এক মুহূর্তের কাছে ফিকে হয়ে গিয়েছে! এই হাসির জন্য কত কি না করতে হয়েছে শুভ্রকে, কিন্তু সফলতার পাঞ্জেরী যেন হাতে এসেছেও ছুটে গেলো আজকে।

“কিরে, বসে বসে কি ভাবছিস? ভেতরে এলি না কেন তুই?

........আর, চোখ এতো লাল কেন তোর? কি হয়েছে?” উৎকণ্ঠ গলায় জিজ্ঞেস করলো শুভ্রা।

শুভ্রার আকস্মিক আওয়াজে শুভ্রের ঘুম-কল্পনা ভেঙে যায়! উঠে বসে কেমন জানি এক মায়ার চোখে ভালোবাসা নিয়ে শুভ্রার দিকে তাকায়। ভালোবাসা আর সময় - এই দুটো যেন নিমিষে হারিয়ে যাচ্ছে!

“কিরে শুভ্র, চুপ কেন? শরীর খারাপ নাকি? কথা বলিস না কেন?” বলে শুভ্রা ওর মসৃণ কোমল আঙ্গুল দিয়ে শুভ্রর গালে স্পর্শ করে! শুভ্র এই স্পর্শকে প্রখর রোদের একটু বৃষ্টিস্নান অনুভব করে!

“কই, তুই তো ঠিক ই আছিস! তাহলে কথা বলছিস না কেন?” একনাগাদে শুভ্রা বলে যেতে লাগলো।

“আজ শুধু তোর কথা শুনতে ইচ্ছে করছিলো, তাই আর কি...!”

“এহহহেহ! ভাব কত্ত যে তোর! চল, বাসায় যেতে হবে।

........অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোর আবার শালিকা’র বিয়ের ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করতে হবে গিয়ে! শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে তোমার আবার।” শুষ্ক কণ্ঠে জবাব দিলো শুভ্রা।

“তোকে কে বলেছে এই বিয়ের কথা? তোকে না আমি শতবার না করেছি ফোন থেকে দূরে থাকতে, কথা শুনিস না কেন আমার?”

“আস্তে কথা বল, আমরা এখনো হাসপাতালে আছি!  

......তোর বউ ফোন করেছিলো, আজকে আসতেও বলেছিলো। আমি কোনো এক ছুতা ধরে পাশ কাটিয়ে এসেছি।” ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো শুভ্রা। “ভালো করেছিস। দোলা আজকাল বেশ অস্থিরতার মধ্যে থাকে, আমি টের পাই। বুঝি আমিও। কিন্তু, যখন দোলা আমাদের ব্যাপারে টের পেয়ে যাবে সন্দেহের বশে ও হয় নিজেকে গুলি করবে না হয় আমাকে আর তোকে! ........এবং গুলি করার ব্যাপার আমি শ’টাকা নিশ্চিত!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিয়ে বললো শুভ্র। “তাহলে তুই কি করতে বলছিস? কিছু একটা প্ল্যান তো তুই করেছিস?”“জানি নি না রে, আপাতত তোর ঠোঁটের কোণের চিরায়ত হাসির কারণ খোঁজার ধ্যানে আছি আমি।কি বলেছে ডা. মেহেরুন্নেসা, শুভ্রা?” ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো শুভ্র। “..................” “কি ব্যাপার, চুপ কেন তুই? বল আমায়, কি বলেছে?” হরিণের মায়াবী চোখে শঙ্কা থাকলে এর সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়, শুভ্রার কাজলটানা চোখের মাঝে এক অশনিসংকেতের ভয় সেই মোহ-মায়াকে ঐশ্বরিক করে দিচ্ছিলো। তখন ছোট করে চোখের ভয় আর মনের স্বাধীনতাকে উন্মুক্ত করে মুখ ফুটিয়ে শুভ্রা জবাব দিলো – “৩ মাস!” “কি.....?? সত্যি??

.......আর মাত্র ৭ মাস আছে ওর আসার! Oh ALLAH! I just can’t believe it.” উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো শুভ্র।

“No one will believe it, Shuvro. কেউ ই বিশ্বাস করবে না, করতে চাইবে না এই কথা! How will I raise him up? What did people call him??” প্রশ্নের ছলে তখন দু’চোখ বেয়ে অশ্রুকণা ছলছল করে ঝরে পড়তে লাগলো শুভ্রা নয়ন বেয়ে। 

“A BASTRAD!” স্বগোক্তি করলো শুভ্রা।

“কিহহ? ......Shut the fuck up your mouth, শুভ্রা! Seriously? I mean like seriously, you are thinking this at this stage?!

..........that’s unbelievable, শুভ্রা!”

“এখন না চিন্তা করলে কখন করবো? শুরুর দিকে আমি বলেছিলাম আমি অ্যাবরশন করিয়ে ফেলি, তোর জন্য আমি করাতে পারি নি! .......কয়েকমাস পরে লোকে যখন আমাকে ‘বিয়ে ছাড়া বাচ্চা কিভাবে জন্ম দিছো’, ‘কুলটা’ বলবে তখন তুই কি করবি বল?” ডুকরে ডুকরে বলতে লাগলো শুভ্রা। “শুভ্রা, এটা হাসপাতাল। আস্তে কথা বল।......আর, তুই ভালো করে জানিস আমি কেন তোকে অ্যাবরশন করতে দেয় নি! তোর জীবননাশের হুমকি ছিলো, বাচ্চা অ্যাবরশন করলে তোর মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যেতো।” ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো শুভ্র। “মরে গেলে মরে যেতাম, কি হতো আর!এমন কলঙ্কিত জীবন তো আর দেখতে হতো না। জীবনে একদন্ড সুখও আমার কপালে সইলো না রে, শুভ্র! আমি বড্ড অভাগী রে....” বলে শুভ্রকে ধরে কান্নার রোল বেয়ে পড়লো শুভ্রার চোখ বেয়ে। প্রতারণা, প্রলোভন আর প্রলোপের আঁধার নিশ্ছিদ্র করে সময়ের সারথী হয়ে বিনিদ্র শান্তি পেয়েছিলো শুভ্রা। স্বস্তি পেয়েও যেন সন্ত্রম হারিয়ে অস্থিমজ্জার এক নদী রক্তে নিজেকে বিলীন করেছিলো সেদিন। হোক না বাধা প্রস্তর শক্ত কিংবা শক্ত অবিরাম যাত্রা চির সংঘর্ষের, তবুও এই যাত্রায় সারথীর কাঁধ হবে শুধু শুভ্রের! এ যেন চির কল্পের সান্তনা।

“শুভ্রা, I have got the BASTRAD.”

“কোথায় পেয়েছিস ঐ হারামির বাচ্চাকে? গর্ত থেকে কি এবার নতুন শিকার করতে বেরিয়েছে? .......শুভ্র, আমার ওকে নিজের হাত মারতে চাই। I just want the motherfucker ALIVE!”

“শুভ্রা, তোর এই শহরে আছে। আজকে এসেছে কিন্তু ওকে এখনো ট্রেইসিং করা যাচ্ছে না। তবে আমার ছেলেরা কাজ করে যাচ্ছে। খুব শীঘ্র ঐ শুয়োরকে পেয়ে যাবো আমরা! জাস্ট গিভ মি সাম টাইম, প্লিজ।” অনুরক্তের সুরে বলে গেলো শুভ্র।

শুভ্রা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, বিনাবাক্য বলে হাঁটতে থাকে সামনের দিকে। পথচলার সঙ্গী হওয়ার ওয়াদা করে তখন শুভ্রও উঠে গিয়ে শুভ্রার পাশে দাঁড়ায়। পাশাপাশি কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করে, শুভ্রার অনামিকা স্পর্শ করে নিজের তর্জনী দিয়ে। শুভ্রের স্পর্শ পেয়ে সেই চিরচেনা মুচকি হাসি দেয় শুভ্রা, ওরা হাঁটতে থাকতে। সিঁড়ি বয়ে নামতে থাকে নিজের পথে। চলতে থাকে আনন্দের পথে।

মনে হচ্ছে এ যেন অনন্তকালের পথ....!

হঠাৎ করে এক আলোকিত উচ্চাঙ্গে বজ্রপাত পড়ে পৃথিবীর বুকে। সমস্তটা আলোকিত করে এক ঝাঁপ স্মৃতি তুলে নেয় সে। সে মুহূর্তে শুভ্রার আরক্তিম চোখগুলো লাভাখন্ডের আকারে ধীরে ধীরে নিজের মায়া জালে গুটিয়ে নেয়......!

 

চলবে