অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প `কাফের` নিয়ে আলোচনা

মৌসুমী কাদের

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০১৯

অবিভক্ত বাংলার কথা গল্পে শুনে শুনে বড় হয়েছি। রপকথার মতন সেই সময়টিকে শ্রেষ্ঠ বলে মায়েরা গল্প করতেন। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, মায়ের মুখে পান-সুপারী আর সেই স্নিগ্ধ হাসি, এ গল্প কার না শোনা। সেই মা বুড়ো হয়ে গেছেন আর গল্পেরাও শুকোতে শুরু করেছে। সাতচল্লিশে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়েছে আর মায়ের বাড়ী আর বাবার বাড়ী বিভক্ত হয়ে গেছে ধর্মের নামে। মা`কে জন্মস্থানটা ছেড়ে যেতেই হয়েছিল কারন বিভক্তির আগুনে তখন গোটা উপমহাদেশ পুড়ছিল। সেই আগুন এখনও দাউ দাউ করে জ্বলছে, আজও যেন মানুষ সেই আগুন থেকে রেহাই পাচ্ছেনা।

 

দেশভাগ আর তার সাথে জন্মস্থান থেকে উৎখাতের তীব্রতা’র সূত্র ধরেই হয়েছিল ইতিহাসের সবচাইতে জঘন্য এবং ঘৃণ্য হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার। `হিন্দু-মুসলমান একসাথে থাকতে পারে না` এই ধারণা কখনও কি বাঙালীদের নিজস্ব চিন্তা ছিল? ছিলনা। ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির এক মহা সাম্যের দেশই চেয়েছিল তারা। কিন্তু কোথায় গেল সেই সাম্যের দেশ? ধর্ম বারবার ঘুরে ঘুরে, ফিরে ফিরে আসে, আর বারবার দাঙ্গা হয়। বিভক্তিটা আসলে কারা চায়? আসলেই কি গ্রামের সাধারন মানুষ বিভক্তি চেয়েছিল কোনদিন? মানুষ কতটা `ধর্মে মানুষ` সেই সত্যটি অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের `কাফের` গল্পটিতে নিঁখূতভাবে আবিষ্কার করা যাবে। যাপিত জীবনে দাঁড়িয়ে থাকা সভ্যতাকে নির্মমভাবে প্রশ্ন করে উপযুক্ত উত্তরটা জেনে যাবার মেলবন্ধনও হতে পারে এই গল্প।

উত্তর দক্ষিণে সোনারগাঁ, পূবে-পশ্চিমে মহেশ্বরদি আর শীতলক্ষার দুই তীর। পুরো অঞ্চলটি জুড়ে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা । দাউ দাউ করে জ্বলছে সমস্ত গ্রাম । বাবুরা ঘোড়া ছুটিয়ে অকাতরে মানুষ হত্যা করছে। সুপারীর শলা পেটে ঢুকিয়ে চিড়ে ফেলা হচ্ছে মানুষ। আর্তনাদ আর পোড়া মাংসের গন্ধে হাহাকার এক ছবি প্রেতের মতন ভেসে বেড়াচ্ছে। অন্ধকার মাঠ, ঘাট, বন-বাদাড় ছাড়িয়ে পালাবার জন্যে মানুষ ছুটছে। যুবতীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, কিরণীকেও খুঁজে পাচ্ছেনা পরাণ। ভয়ে থরথর করছে গ্রাম। কোথাও যখন সে যেতে পারছেনা তখন নদীর জলে ভেসে পড়ে সে । কিরণীকে খূঁজে পেতেই হবে তার। শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে সেই মুসলমান দম্পতি হাসিম আর জাবিদার উপর, যারা বারবার তার প্রান রক্ষা করেছে। সাঁতরে সাঁতরে যখন তাদের বাড়ী পৌছয়, দাঙ্গা তখন ওদেরকেও জাপটে ধরেছে। তফন বা টুপি পড়ে মুসলমান সেজেও কাজ হচ্ছেনা, এমনি হিন্দু নিধন আর নির্যাতনের সময় ছিল সেটা।

পরাণের এই বাঁচবার চেষ্টাটি ছিল পুরোটাই কিরণীকে ঘিরে। ভয় ছিল বন্ধুর বাড়ীতে উঠে তার আবার বিপদ ডেকে আনছে কিনা। কিন্তু হাসিম রুখে দাঁড়িয়ে বলেছিল, `যাইবা কই? মাঠে? আমিতো এখনও মরি নাই।` বন্ধুর প্রতি তীব্র এই ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা এ সব কিছু ধর্ম মানেনি, বর্ণ মানেনি। যদি পরাণ ধরা পড়ে যায়? এই চিন্তা হাসিমকে শহরগামী বন্ধুর সহযাত্রী করতে চেয়েছিল। দূরত্বটা কম নয়। নদী পর্যন্ত হেটে গিয়ে তারপর নদীর জলে ডুবে ডুবে পথ কাটবে পরাণ। সঙ্গে থাকবে একটা পাতিল, পাতিলটা জলের উপর ভেসে যাবে, জলের নিচে পরাণের মুখ, পাতিলের নিচে মুখ রেখে শ্বাস নেবে পরাণ। মাছের মতন জল কেটে শহরে পৌছে যাবে।ঘাস, পাখি, সবুজ গন্ধময় মাঠ, সব পিছনে ফেলে চলে যাবে কিরনীর কাছে। আর নদীর পার ঘেসে হেটে যাবে হাসিম। সঙ্গে থাকবে বাঁশের লাঠি, ছোট এক পুটলি চিড়া। ক্রমশ পাহাড়ের মতন উঁচু নদীর পাড় বেয়ে হেটে যাচ্ছে হাসিম আর জলের নিচে পাতালপুরীর ঘোড়ায় ছুটে চলছে পরাণ , দুই হিন্দু মুসলমান বন্ধুর কোন ভয় থাকছেনা। ঝোপ জংগল, টুনি ফুলের লতা, চরের শশ্মান, ধুক-ধুক, ঠক ঠক, জলের নিচে পরাণীর ঝিনুক খোঁজা। শক্তি যখন ক্রমশ নিঃশ্বষ হয়ে আসে, দুজন দুজনের নির্ভর হয়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের দেখে ফেলে দুজন যুবক। টের পেয়ে যায়, এক গেরস্থ মুসলমান হাসিম, আরেক গেরস্থ হিন্দু পরাণকে রক্ষা করে নিয়ে যাচ্ছে শহরে ! বাঁচাতে চাইছে! হাসিম ঘুরে ঘুরে লাঠি বাজিয়ে গাজীর গীত শুনিয়েও ওদের ভোলাতে পারেনা। পাতিল ঘুরে ঘুরে অন্যমনস্ক করতে চায় যুবকদের, তাও পারেনা। ওরা সুপারীর শলা নিয়ে জলের দিকে পাতিলকে লক্ষ্য করে নেমে যায়। ছুঁড়ে মারে শলাটা। পাতিলের ভিতর দিয়ে সেটা পরাণের ব্রম্মতালুতে ঢুকে পালকের মতন খাঁড়া হয়ে থাকে। বুকে, পিঠে, রক্তের ফোয়ারা, চোখ দুটো লাল, দুহাত তুলে চিৎকার করে উঠে পরাণ... `কিরনীরে পাইছি`...। `কিরনীরে পাইছি`...। `কিরনীরে পাইছি`...।

গল্পটি এইখানে শেষ হলে হয়ত অবাক হবার কিছু ছিলনা। কিন্তু অতীনের লেখার যাদু এখানেই। তিনি বিষয়ের গভীরে ঝুটেছেন সকলকে উদ্বিগ্ন করে; স্বতস্ফুর্তভাবেই পাঠককে ভেতরের তাগিদ থেকেই ঢুকে পড়তে হয় গল্পের ভেতরে। এর পরের ঘটনাটি এমনঃ

হাসিম পাগলের মতন পালাবার জন্য ছুটছে আর পেছন পেছন ছুটছে মানুষ দুজন। ওরা হা হা হা করে হাসে আর চিৎকার করে বলে...`কাফের যায়`...! কাফের যায়`...! কাফের যায়`...! এক শ্বাসরদ্ধকর দৃশ্য! মাঠের ভিতর, খাঁড়া পাড়ের ভিতর সেই কাফেরকে ধরার জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে ওরা। গম খেতের ভেতর হাসিম ছুটে যায়। পাখিরা ঘরে ফেরে কিন্তু হাসিম লুকিয়ে থাকে গম খেতে। তন্ন তন্ন করে কাফেরটাকে খুঁজে মরে ওরা। মাটিতে বড় বড় ফাটল। মৃত্যুভয়ে অস্থির এক যুবক। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। ওরা লাফ দিয়ে যখন ফাটল পেরুতে চাইল, লাঠি দিয়ে ফাটলের মাঝখানে আটকে দিল পথটা হাসিম। ওরা হড়কে নিচে পড়ে যেতে থাকলো। এবার হাসিমের হাসবার পালা। সে জোরে জোরে হাসে...মুখ ঝুলিয়ে বলে, ...। `কি মিয়ারা আসমান দ্যাখ, নদী দ্যাখ, কি রকম লাগে...দোজখের পথটা চোখে পড়তাসেনি?` কাতর শব্দ যত তীব্র হয় ততই হাসিমের হাসি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে...ভেসে ভেসে প্রতিদ্ধনি বাজে...`দুই কাফের জীবন্ত কবর যায়`। হাসিম ভুলতে পারেনা পরাণের মৃত্যু দৃশ্য। পরাণের পায়রাগুলো বক বকম করে উড়ে। নিজের দেশ, নিজের মাটি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল দুই বন্ধু। কাফের শব্দটি বড় মর্মান্তিক হয়ে বাজতে থাকে...কে কাফের? কে কাফের? কে কাফের?

গল্পটিতে চারটি বিষয় আলোচনা করা জরুরী। এক.হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং এর ইতিহাস দুই. অসাম্প্রদায়িক দুজন মানুষের বন্ধুত্ব যা দাঙ্গার মূল কারন সাম্প্রদায়িকতাকে চ্যালেঞ্জ করে, তিন.পরাণ এবং কিরণীর প্রেম এবং চার. প্রকৃতির বর্ননা।

এই গল্পের লেখক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালে, পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলায়। সোনারগাঁও এর পানাম স্কুলে পড়েছেন তিনি, আর দেখেছেন সেই সময়ের সমাজচিত্র। কিশোর বয়সে, যখন এলাকার হিন্দুদের উপর নির্যাতন শুরু হয়, পেটোয়া বাহিনী হিন্দু বউদের সিঁথির সিঁদুর তুলে নিয়ে যায়, শাঁখা ভেঙে ফেলে, ধর্মান্তরীত করবার মহাচেষ্টা শুরু করে, হত্যা নির্যাতন তুঙ্গে উঠে যায়, ঠিক তখনই যৌথ পরিবারগুলো একে একে ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। সেই সময়টিতেই ভারত পাকিস্থান আলাদা হবার ফসল হিসেবে অতীনকেও তার জন্মস্থান ত্যাগ করতে হয়। ভিটেমাটি দেশছাড়া অতীন, এইসব জীবনের মর্মবেদনা গুলো নানাভাবে তুলে এনেছেন তার লেখায়।

`হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা` বিষয় হিসেবে অনেক ব্যাপ্ত, সন্দেহ নেই। কিন্তু একে এত অসামান্য দরদ দিয়ে অর্থবহ করে ভাষায় ফুটিয়ে তোলার বিষয়টিই ছিল ভীষন কঠিন। অতীন কট কট করে ইতিহাস বর্ননা করেননি। তার লেখায়, কথায় রক্ত ঝরেছে। গল্পের প্রতিটি দৃশ্য জীবন্ত হয়ে উঠেছে সহজ এবং প্রানবন্ত শব্দমালায়। যেন তিনি এঁকেছেন নিজের জীবনের ক্লেশ, গ্লানি এবং নির্দয় সমাজ। হতে পারে হাসিম এবং পরাণ দুটি প্রতিকী চিত্র, আমরা জানিনা। হতে পারে, তাদের কাছ থেকে দেখেছেন অতীন আর মনে মনে ঠিক ততটাই অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ডালপালাগুলোকে শক্ত করে বেঁধেছেন। দুজন বিধর্মী মানুষের বন্ধুত্বকে ধর্ম দিয়ে তিনি আলাদা করে দেখেননি। সমাজের মানুষ যা নিয়ে দাঙ্গা করছে, সেই চরম বিভক্তীর সরল এবং সমান্তরাল সমাধান দেখেছেন তিনি এই বন্ধুত্বে। তৃতীয়ত, প্রেম মানুষকে কতটা বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগাতে পারে, কতটা সাহসী করে তুলতে পারে কিরণীর প্রতি পরাণের প্রেম তারই প্রমান......। এসব কিছুই উনি লিখেছেন, না বলে বলা যায় ‘এঁকেছেন’ পটুয়া শিল্পীর মতন, নানা রঙ মাখিয়ে। কখনও তীব্র বেদনার নীল অথবা লাল রক্ত রঙে, কখনও স্নিগ্ধ লাবন্যময় প্রকৃতি সবুজ লোকজ বর্ননায়। ইতিহাস, সময়, সমাজ, প্রকৃতি এবং প্রেম, এই সব কিছুই একসাথে ছবি হয়ে উঠে এসেছে এই গল্পে। আর সে কারনেই বাংলা সাহিত্যে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এটি একটি অনবদ্য অবদান।

গল্পের কোথাও কোন চরিত্রের শারিরীক বর্ননা নেই। অথচ কথায়, ভাষা্‌য় আবেগে, তাদেরকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়না। পাঠক ইচ্ছে করলেই নিজের মতন করে চরিত্রগুলোকে এঁকে ফেলতে পারেন। অতীন যখন যে চরিত্রটি বর্ননা করেছেন তখন তার সাথেই তিনি হেঁটেছেন। চরিত্র চিত্রায়নে তার সার্থকতা হোল, প্রতিটি চরিত্রকে সময় এবং ঘটনার সাথে যূঁতসই করে তিনি গেঁথেছেন। পাঠক আলাদা আলাদা করে পরাণ, হাসিম, জাবিদাকে নিজের মত কল্পনায় আঁকতে পেরেছেন শুধুমাত্র তার লেখার গুণে।

পরাণ স্ত্রী অন্তপ্রান দরদী একজন সাদামাটা সরল গ্রামের মানুষ। ভালোবাসার তীব্রতায় সে ভেসে যায়। মানুষ মানেনা, ধর্ম মানেনা, দাঙ্গা মানেনা। হারিয়ে যাওয়া কিরণীকে খূঁজে না পাওয়ার হাহাকারের বর্ননা পড়ে পাঠক বেদনাবিদ্ধ হয়। খোলা আকাশে মহাশূন্যতায় বারবার বাজতে থাকে...`কিরণী, কিরণী, `কিরনী`...। বন্ধুকে সে বিপদে ফেলতে চায়না আবার একই সংগে বন্ধুর হাত ধরে হাটে সে।

‘কিরণী’ গল্পের কোথাও আলাদা একটা চরিত্র হিসেবে আসেনি। এসেছে ভালোবাসার প্রতিক হিসেবে। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠক পরাণের স্বপ্নটি ধারণ করে হদয়ে নিয়ে হেঁটেছেন, যেখানে কিরণীর অবস্থান স্পষ্ট, যেন কোন প্রতিমা মাথায় রয়ে যায়, দেখা দেয়না ।

গল্পের নাম ভূমিকায় ছিল হাসিম। পরাণের সেই বন্ধু, যে দুঃক্ষ কষ্টে তাকে বারবার রক্ষা করে এসেছে। পরানের সবটুকু নির্ভরতা ছিল ওরই কাছে। সকলেই যখন পরাণ’কে ঘিরে ফেলেছে মেরে ফেলবার জন্যে, কোথাও যাবার জায়গা নেই, তখন হাসিমের বাড়ীতেই আশ্রয় নিয়েছিল সে। এমনি পরম নির্ভরশীল বন্ধু ছিল সে;একজন সত্তিকার মুসলমান, যার কাছে বন্ধুত্ব, বিশ্বাসই প্রকৃত ধর্ম। সত্যিকার মুসলমানকে কাফের বলার স্পর্ধা কি করে মানুষের হয় সেটা মৃত্যুর ঠিক দ্বারপ্রান্তে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল সে, একজন অসম বর্ণের বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে।

জাবিদা নদী পারের মানুষ, হাসিমের স্ত্রী। খুব বেশী উপ্সথিতি নেই গল্পে, কিন্তু তার পরও সে ছিল ছায়ার মতনগুরুত্বপূর্ণ হয়ে। নদীর জল, কচুরীপানা এইসব তার চিরচেনা। তাই এই বুদ্ধিটাও সেইই বাতলে দিয়েছিল দুইবন্ধুকে, কি করে নদী পাড়ি দিয়ে শহরে যেতে হবে।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় চরিত্রগুলোর ভেতর অন্তর্দ্বন্দ হবার কোন সু্যোগ না দিয়ে অনেকবেশী গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন দ্বন্দমুখর সময়কে। দ্বান্দিক জীবন ও সমাজকে সামলাতে গিয়ে চরিত্রগুলো নিজস্ব পরিচয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল হয়ত সেই কারণে ।

‘কাফের`গল্পটি বর্ননায়, চরিত্রসৃষ্টিতে ভীষন স্পষ্ট এবং সরল, একই সঙ্গে দুঃখবোধগুলো তীব্রতায় আঁকড়ে ধরে। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা গ্রাম, ঝোপ ঝাড় আর খাল বিলের বর্ননা, যেন সেই শৈশবই ছুটে ছুটে খেলে বেড়ায়। অবিভক্ত বাংলায় যেমনটি তিনি সোনার গাঁয়ে তার শৈশবকে দেখেছিলেন। সময়ের ক্ষত, মানুষের বিক্ষিপ্ততা, জীবনসংকট, সংখালঘু নির্যাতন, এইসব সমন্বিত দৃশ্য যখন ভাবনার জগতটায় পায়চারী করে, ঠিক তখনই অতীন ধীরে ধীরে পাঠককে একটু টুইস্ট করে সরিয়ে নিয়ে যান অন্য আরেকটা দৃশ্যপটে, যেখানে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বুকে বেঁধে যুদ্ধ পাড়ি দিতে সাহায্য করছে। হাসিমের `তিন ক্রোশ টেনে নিয়ে যাবার সম্মানটি` পাবার চেষ্টাটি কিযে অসামান্য হয়ে টিকে থাকে শেষ পর্যন্ত, তা সত্যিই বিস্ময়কর! প্রশ্ন আসে, গল্পটির মূল শক্তিটা আসলে কোথায়? এর সহজ উত্তর হোল, ‘ভালোবাসায়, বিশ্বাসে’। দাঙ্গার মতন অস্থির এক সংঘর্ষের পাশে প্রেম-বন্ধুত্ব যেন এক অমৃত সমাধান। পাঠকের কাছে সহজ ভাষায় বিষয়কে উপস্থাপন করাটা যত সহজ মনে হয়, আসলে সেটা ততখানিই কঠিন। অতীনের ভাষা ব্যবহার, শব্দ চয়নে অসাধারন এক সহজিয়া লোকজ প্রবণতা আছে, যা পাঠককে আঁটকে রাখে, যুক্ত করে। গল্পটি পড়া শেষ হলে একটা হুহু অনুভূতি হয় আর দুটি দৃশ্য জ্বল জ্বল করে ভাসতে থাকে। `পরাণের মৃত্যু দৃশ্য` এবং ` পরাণকে হত্যাকারী সত্যিকার কাফেরদের মৃত্যু`। একটা ‘কষ্ট’, আরেকটি ‘শান্তি’। পরাণের মৃত্যু কষ্ট এবং একই সঙ্গে হাসিমের বন্ধুকে বাঁচাতে না পারারও কষ্ট, দুটো অনুভূতিই নিস্তব্ধতায় ভাসতে থাকে।

প্রকৃতির বর্ণনায় পারদর্শী হয়না সকলে, কিন্তু অতীন ছিলেন এই দক্ষতার শিখরে। এত ভালোবাসা দিয়ে প্রকৃতিকে আঁকার কেনইবা প্রয়োজন হোল? ডুবিয়ে ডুবিয়ে ভালোবাসায় মেখে গ্রামদৃশ্যের বর্ননাগুলো না দিলেওতো চলতো! এর মূল কারণটি ছিল, অতীন নিজেকেই ঘুরেফিরে দেখেছেন, এঁকেছেন নিজেকে ‘পরাণ অবয়বে’। ভিটেমাটি দেশ ছাড়া সেই নাবালক যাকে পারিবারিক এবং ব্যক্তি জীবনে দিনের পর দিন কত ক্লেশ মনোবেদনা, গ্লানি, বিমুখতা সহ্য করতে হয়েছিল, সেই উঠে এসেছে গল্পের কাল্পনিক চরিত্র হয়ে । ভালোবাসার জন্মস্থান ছেড়ে যাওয়া, মাতৃভূমির সংগে বিচ্ছিন্নতার কষ্টটি আলাদা করে কোথাও বর্নিত হয়নি গল্পে। কিন্তু পাঠক সেটি অনুভব করেছে একান্তে। বিমল কর যেমন অতীনকে নিয়ে লিখেছিলেন, `তিনি ছিলেন না পলাতক, না উদাসীন। তার চরিত্রগত গুনটিই হলো, মমতা, সমবেদনা, উদ্বিগ্নতা নিয়ে সমাজ ও সংসারকে দেখা। মানবিক বোধই অতীনের লেখার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ-তা অস্বীকার করা যায়না।` কাফের গল্পটিতেও সেই বোধটিকে আমরা খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাই।