অনন্য দার্শনিক-সাহিত্যিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

কে. হাসান সায়হান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮

জাগতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার মধ্য দিয়ে মানুষ জীবনযাপন করে। মানুষ স্বাপ্নিক। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা অন্তর্দৃষ্টিতে দেখতে পারেন। যুগে যুগে এমন মানুষের জন্ম নেহাতই কম হয়।

আবার বাস্তবতা হচ্ছে, বিশাল প্রতিভাকে আস্বাদন করা আমাদের স্বভাবগতও না। এমন অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তিরা আমাদের কালে খানিকটা অনালোচিত ও উপেক্ষিত। তাছাড়া চলিষ্ণু গতিধারা হচ্ছে, এই ভূমিতে জীবদ্দশায় কেউ সম্মানিত হন না।

জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমাদের জাতীয় জীবনে এক নক্ষত্র পুরুষ এবং উপমহাদেশের অন্যতম দার্শনিক ছিলেন। তিনি যে সামগ্রিক জীবন দর্শনের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা হচ্ছে ইসলামি বিশ্বজনীন জীবন দৃষ্টি। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কর্মকাণ্ডে একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করেন।

তিনি স্বীয় সম্প্রীতি ও উদারতার মাধ্যমে সকল ধর্মাবলম্বী মানুষকে তার আলিঙ্গনে আনেন। ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ তাকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিল। তার জীবন দর্শন সচেতন মানুষের মানবিক কল্যাণের আলোকবর্তিকা।

বিশ্বের অনেক দেশেই দার্শনিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন অধ্যাপক আজরফ। অনেক দেশে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য প্রদানের জন্য। তার লেখনি ছাপা হয়েছে বিশ্বের কমপক্ষে দশটি দেশে। কিন্তু আমাদের অনেকের কাছেই এই মহান ব্যক্তিটি এখনো অপরিচিত। আমরা জানিই না, বহুপ্রজ সৃষ্টিশীল, বহুমুখীন কর্মকুশলী, দার্শনিক এক প্রবাদতুল্য বাঙালি প্রতিভার নাম।

অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ একাধারে দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্য গবেষক, ইতিহাসবেত্তা, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, কথাসাহিত্যিক, কবি, সুবক্তা, রাজনীতিক প্রভৃতি। তিনি গ্রিসের দার্শনিক মতবাদের সাথে ধর্মের সম্পর্ক সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তার ব্যাখ্যা স্বীকৃতও ছিল। এই উপমহাদেশে তিনিই প্রথম জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘দর্শনের ছাত্র মাত্রই নাস্তিকতা নয়।’ তিনি সুফি মতবাদের ওপরও গবেষণা করেন।

মধ্যযুগে মুসলিম লেখকদের সাহিত্যচর্চার অন্যতম সাধনা ছিল ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী প্রচার করা। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করে সমাজকে ইসলামের ছায়াতলে আবদ্ধ কল্পে তারা যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাতে বাংলা সাহিত্যও হতে পেরেছিল সমৃদ্ধ। ধর্মীয় বিষয়াদি অনুবাদ করে ধর্মসাহিত্যের বিকাশ ঘটিয়েছেন। একই সাথে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে জনগণকে সচেতনও করেছেন। সওয়াল সাহিত্য ও চরিতকথার মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়ের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে।

আজ থেকে ১১১ বছর আগে, ১৯০৬ সালের ২৩ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যদিও বাংলাপিডিয়ায় তার জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯০৮ সালের ১ জানুয়ারি।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বংশগত পরিচয় অনন্য। বিখ্যাত মরমি কবি ও সঙ্গীত সাধক হাসন রাজার দৌহিত্র তিনি। হাসন রাজার জ্যেষ্ঠ মেয়ে রওশন হুসন বানু ছিলেন তার মা।

দেওয়ান আজরফ ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল জীবনশিল্পী এবং সাহিত্য গবেষক। তিনি গল্প লিখেছেন শতাধিক। দর্শনগ্রন্থ, গল্প গ্রন্থ, উপন্যাস, নাটক এবং প্রবন্ধ ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় শ’-এর কাছাকাছি। তিনি সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে ৬৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সম্পাদনামূলক ও ভূমিকা লিখিত গ্রন্থের সংখ্যাও অনেক। তবে তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে এক হাজারের বেশি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দর্শনের ওপর তিনি লিখেছেন চারটি নান্দনিক গ্রন্থ। ফিলোসফি অব হিস্ট্রি (১৯৮২), দর্শনের নানা প্রসঙ্গ (১৯৭৭), ধর্ম ও দর্শন (১৯৮৬) এবং জীবনদর্শনের পুনর্গঠন।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বিশিষ্ট দার্শনিক এবং ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। অবিভক্ত পাকিস্তান দার্শনিক কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৫৬ সালে ভারতীয় দার্শনিক কংগ্রেসের তৎকালীন মাদ্রাজ প্রদেশে অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে ইতিহাস, দর্শন সম্বন্ধে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৬১ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্দোপাক কালচারাল কনফারেন্সে ‘নৈতিকতার শিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৬২-৬৩ সালে ইরাক সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে প্রথম মুসলিম দার্শনিক আলকিন্দি সম্পর্কে গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৮৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফাউন্ডেশন কর্তৃক দার্শনিক কনফারেন্সের প্রবক্তাদের আমন্ত্রনে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৯৮৫ সালে রোমে অনুষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক সম্মেলনেও প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এই অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। ভাষা, সাহিত্য ও রাজনীতির সাথে তার সম্পর্কের জন্যে ১৯৪৬ সালে আসাম আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৭ সালে আসাম সরকারের বাঙ্গাল খেদা অভিযানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং ১৪৪ ধারা অমান্য করে শীলচরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৬ সালে সিলেটে প্রতিষ্ঠিত ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

ভাষা আন্দোলন সর্বপ্রথম শুরু করে যে সংগঠন তার নাম ‘তমদ্দুন মজলিশ’। তিনি ছিলেন তমদ্দুন মজলিশের সভাপতি। এছাড়া সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘নওবেলাল’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘নওবেলাল’ পত্রিকা বাঙালির ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য তাকে পরবর্তীকালে (১৯৫৪ সাল) সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করে তৎকালীন পাকিস্তান প্রশাসন।

শিক্ষা বিস্তারে ও জ্ঞান চর্চায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ এই মহান ব্যক্তি। জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, ইসলামী সাম্য ও মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তিনি একজন সুলেখকও ছিলেন। ‘শিয়াল মামা’ শীর্ষক গল্পের মাধ্যমে ১৯১৮ সালে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে পঞ্চাশাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা ইংরেজীতে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি ছিলেন সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার বিরোধী ও মানবতাবাদী। বৃটিশ বিরোধী ও ভাষা আন্দোলনে একজন শিক্ষাবীদ ও লেখক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

১৯৫৮ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ড. হাসান জামান ও তৎকালীন ফ্রাংকলিন পাবলিকেশনের পরিচালক (পরবর্তীকালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার) এটিএম আবদুল মতিন, মাওলানা মহিউদ্দীন খান প্রমুখের সাথে মিলে দারুল উলুম ইসলামিক একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামিক একাডেমি ঢাকা নামে অভিহিত এ প্রতিষ্ঠানটিই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ নাম নিয়ে কাজ করে চলেছে।

জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ অবদানের জন্য মোহাম্মদ আজরফ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, আন্তর্জাতিক মুসলিম সংহতি পুরস্কার, একুশে পদক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার, বাংলাদেশ মুসলিম মিশন পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালের ৪ নভেম্বর তাকে জাতীয় অধ্যাপক পদ প্রদান করে। ১৯৯৯ সালের ১ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়।

তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ এ যাবৎকাল কেউ গ্রহণ করেনি। অনুসন্ধিৎসু পাঠক গবেষকের পক্ষেও চট করে তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে তাকে মূল্যায়ন করা কঠিন ব্যাপার। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এমন একজন পণ্ডিতের লেখা ৪০টির বেশি পাণ্ডুলিপি এখনো অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।

মোহাম্মদ আজরফ রেখে গেছেন বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের দ্বীপশিখা। তার প্রাপ্য সম্মান আমরা কতটা দিচ্ছি। আমরা কতজন জানি, এমন একজন মনীষী ছিল আমাদের দেশে। দেওয়ান আজরফ জাতীয় অধ্যাপকে ভূষিত হয়েছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে তার একটি সম্মানজনক চেয়ার ছিল। কিন্তু আজ তাকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই।

যে জাতি তার অতীত গৌরব পরবর্তী প্রজন্মকে জানায় না, সে জাতি মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য। মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন সর্বজনীন চিন্তার কীর্তিমান পুরুষ। এমন প্রতিভাধর ব্যক্তিরাই জাতির অহমিকা হতে পারেন।