অবরোহী

উপন্যাস ১

আশাজ যুবায়ের

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৮, ২০১৯

আকাশজুড়ে নীলবৃষ্টির পূর্বাভাস, বড় অদ্ভূত আবহাওয়া। নির্দ্বিধায় যে কেউ মনে করে নেবে, সূর্যোদয়ের পূর্বমুহূর্তে আলো-আঁধারির খেলা চলছে। প্রকৃতির এমন পরিচয় অন্তত পৃথিবীতে মেলানো মুশকিল। প্রশস্ত নীলাভ সূর্যটা আপোষে অবস্থান নিয়েছে চ্যাপ্টা আকাশটার অন্তরে। এদিকে হিমেল-হাওয়া মন ছুঁয়ে দেবার  উপরি দ্বায়িত্বটাও নিজের উপরে সেধেই নিয়েছে। দিগন্তভেদ করা চওড়া রাস্তার দু`ধারে সোনালি রঙের সুবিশাল গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে আগের আমালের জমিদারি-পেয়াদাদের কায়দায়। এর ফাঁকে ফাঁকে হিরকোজ্জ্বল শিশিরকণারাও অধিকার করে আছে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের ঢঙ।

এমন একটা  কল্পিত-রাজ্য প্রেয়সীকে উপহার দেবার স্বপ্ন পৃথিবীর সমস্ত দরিদ্র-প্রেমিকেরাও হামেসাই দেখে এই ভেবে যে, বিশেষ কোনো মুহূর্তে প্রিয়তমাকে রাজ্যটির সামনে দাঁড় করিয়ে কানামাছির ছলে চোখ খুলে উপহার দিয়ে চমকে দেবে। স্বপ্নটা দেখতে তো আর পাপ নেই, বরং সে সময়টুকুতে অন্তত হৃদয়ে উষ্ণতা উপচে ওঠবে প্রেয়সীর কল্পনায়। আচ্ছা, অমন অদ্ভুত প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে থাকার সাধ্য কার থাকতে পারে? কী? চিন্তায় বিভোর হয়ে যাচ্ছেন, তাইতো? উঃ, আমিই বলছি- একমাত্র ঈশ্বরেরই থাকতে পারে। এতো আয়োজন তারপরও কেন অবরোহীর চেহারায় বিষাদের কালো ঢেউ খেলে যাচ্ছে? কেনইবা অত পূর্ণ আয়োজন ওর মনে ধরার অবকাশ পাচ্ছে না?

মানুষ যখন নিতান্ত দগ্ধ হয় তখন নাকি আপন অনুভূতিও অস্বীকার করে। এই আয়োজনের প্রয়োজন অবরোহীর মনে ধরছে না আজ। বেখায়ালি হয়ে হনহন করে হেঁটে চলেছে ও।এই মুহূর্তে ওর ভারাক্রান্তমন ঈশ্বরের প্রস্তাবিত প্রমোদকেও পরাভূত করছে। আরো কিছুটা সামনে এগুতেই মস্তবড় একটা দরজা! ওর গতিপথ রুদ্ধ করল। নজর উঁচিয়ে দেখল, চন্দ্র-রঙের বিশাল চওড়া দরজা! ঠাহর করতে পারছে না সে এখন কী করা উচিৎ। জায়গাটাতো ওর জন্য একেবারেই নতুন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা অদৃশ্য আওয়াজ ওর কানে বিঁধল, `থামলে যে? ভিতরে প্রবেশ করো। এখন থেকে চিরঅবধি তোমার আবাসস্থল এটা। আর জেনে রেখো,এটাই সেই কাঙ্ক্ষিত স্বর্গ, যার জন্য মানুষ অবধারিত নিয়মে ভাগ্যের পরীক্ষাটা পৃথিবীতে সবসময় দিয়ে যাচ্ছে। তোমার ঈশ্বর, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই এই স্বর্গ দ্বারা আজীবন সম্মানে ভূষিত করেছেন তোমায়। ফলে আজ থেকে তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবেই চলবে এখানকার কানুন, সে অধিকার ঈশ্বরের পক্ষ থেকে তোমাকে দেয়া হয়েছে।`

কোনো কথাই অবরোহীর কানতক পৌঁছেনি, বরং ওর চক্ষুদ্বয় ফেঁপে অঝরে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। আপাতত স্বর্গীয় সুখ সইছে না তার। কেন? কী হয়েছে ওর? ওর ওপরে প্রকৃতি কোনো প্রকার অবিচার করেনি তো? কী জানি? হবে হয়তো! প্রকৃতি কখনও কখনও নির্দ্বিধায় নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে থাকে ভবিষ্যতের প্রশ্রয়ে। পুনরায় অদৃশ্য আওয়াজ কানে ভাসল, `কই যাচ্ছ না যে? তুমি কি কিছু বলতে চাইছো?` প্রতিউত্তরে ও মনব্যথায় মাথা ঝুকিয়ে `হ্যাঁ` বলেই ফুঁপিয়ে একটা হিচকিতে কেঁদে উঠল। কোনো কথা মুখ থেকে বের হচ্ছে না। ফুঁপিয়ে কাঁদলে নাকি মনের জমানো বেদনাগুলো প্রশান্তি হয়ে নেমে যায়। তবে কি সেই চেষ্টাটাই করছে ও? নাকি অন্যকিছু, যা আমাদের কল্পনারই ঊর্ধ্বে। কিছুক্ষণ বাদে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আঁচলে চোখমুছে একটা অঙ্গুলি নির্দেশ করে, `একটাবার, শুধু একটাবার আমাকে পৃথিবীতে যেতেই হবে। বিশ্বাস করুন, যাব আর আসবো। প্রমিজ করছি, কারও সঙ্গেই দেখা করবো না, কথাও বলবো না; আ--মি, আ---মি প্লিজ প্লিজ আমাকে যেতে দিন। আমার উপর একটু দয়া করুন না।`

পুরো কথাটুকু বলতেই পারল না।কান্নার পুনরাবৃত্তি হতে হলো। বেশ চুপ থেকে ক্লান্ত কণ্ঠে অদৃশ্য ,`দেখো, `সেই সৃষ্টিলগ্ন  থেকে অদ্যবধি এই স্বর্গের পাহারায় নিয়োজিত আমি, কিন্তু কাউকেই অমন আশ্চর্য আবদার করতে দেখিনি। শুধু তাই নয়, এখানে দাঁড়িয়ে কেউ কথাও বলার প্রয়োজন মনে করেনি। আচ্ছা বলো তো, তুমি কী অমন ফেলে আসতে পারলে, যে কারণে স্বর্গের সুখ পায়ে ঠেলছ?।

‘পৃথিবীর পর্যাপ্ত সুখও এইমুহূর্তে আমার কাছে অর্থহীন ওই বাক্যটির তুলনায়, যে বাক্যটি ঠোঁটে আসার আগেই আমাকে পৃথিবী ছাড়তে হলো।’ ওর কথার কোনো জবাব মেলাতে না পেরে স্তব্ধ  বনে গেল অদৃশ্য। মুশকিলটা কোথায় জানেন? স্বর্গীয় পাহারাদারদের তো আর অমন আবেগ হবার কথা নয়, যতটা আবেগ মানুষ সইতে পারে। মানুষের আবেগের কাছে স্বর্গীয় নিয়মগুলোও কখন যেন পরাভূত হয়ে পড়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপারগতার স্বরে অদৃশ্য, `দেখো, আমি নিয়মের কাছে অসহায়; তাছাড়া যা যা বলেছি সেগুলো বলার জন্যই ঈশ্বরের পক্ষ থেকে আমি আদিষ্ট। ওগুলোতো তারই সিদ্ধান্ত। তুমি একবার যেখান থেকে প্রস্থান করে এসেছ সেখানে ফিরে যাবার দুরহ নিয়ম বানানোর অধিকার আর কারও নেই। কেবল তাই নয়, সম্পুর্ণ অসম্ভব। আর ঈশ্বর তার নিয়মের খেলাফ করেন না।’

কান্না বিজড়িত কণ্ঠে অবরোহী বলল, আপনি একটাবার ওনাকে আমার জন্যে অনুরোধ করেই দেখুন না, প্লি---জ, প্লি---জ। বিশ্বাস করুন, আমিতো অতটুকু সময়ই নেব, যতটুকু সময়ে একটা মানুষ ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ বাক্যটা উচ্চারণের ফুরসত পাবে।`

চলবে