অব্যক্ত

আত্মদীপ

প্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০১৮

সে হেঁটে চলেছে। নিবিড় বনানী নিবিড়তর হয়ে আসে। পথ হারিয়ে যায় বারবার। আঁধার যেন গোগ্রাসে গিলে খেতে চায় চারধার। তবু সে হেঁটে চলেছে...

কেউ তার পরিণতি জানে না। জানতে চায় না। এমনকী সে নিজেও জানে না কবে কোথায় তার পথ চলা থামবে। অবরুদ্ধ কণ্ঠে গোঙানি হঠাৎ ছড়িয়ে পড়তে চায়।

চিৎকার একটু মুক্তি ভিক্ষা চেয়ে প্রশ্ন করতে চায়, ওগো মহাকবি, কী আমার অবশেষ? আমি যে ক্লান্ত প্রভু, আমার যাত্রা তুমি নিঃশেষ করো। কিন্তু হায়! মহাকবি যে প্রয়োজন বোধ করেন না।

এক সামান্যা অনার্যার পরিণতি কী, তার কীবা অবশেষ তা ভাবার দায় ছিল না তার। ছিল না কারো। এমন কী ভারত যুদ্ধের প্রাণপুরুষ যে কৃষ্ণ, তারও মনে পড়িনি।

কত যুগ হেঁটে চলেছ তুমি মা গো। পদতলে হাজার ব্যাধের শর বিঁধেছে যে। মহানায়কের মৃত্যু একমাত্র শরে। অনার্যা বলে কী এই শরশয্যাতেও তোমার ইচ্ছামৃত্যু নেই? মা... মা... মা গো, কিন্তু কে ও নামে ডাকে?

তোমার সন্তান বীরের মতো যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। তারপরও এ ঘন অন্ধকারে কে ও নামে সম্বোধন করে? সন্তানের অনার্য রক্তে স্নাত হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র। আর্যের আত্মাভিমান তখন ওই গাঢ়, সতেজ, যৌবনোষ্ণ রক্তে ধুলিসমান। তুমি উৎসব করো হে, তোমার মহাবীর আর্য স্বামী তার অনার্য পুত্রের শোকে উন্মাদ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। ভুলো না মাতা, গর্বিত হও... আজও গর্বিত হও। তুমি, তুমি কী করেছিলে সেই ক্ষণে? কত মৃত্যু পেরিয়ে এসেছে যেন হায়! কেউ তো জানতে চায়নি, আমি কী করছিলাম তখন। মনে পড়ে না। সব আবছা। গৃহে নাকী বনান্তরে কোন ধুলিপ্রান্তরে, কিছুই মনে পড়ে না। কেবল একটা ছায়াকে মাতৃত্বের সুধারসধারাতে আঁকড়ে ধরতে চায় অশেষ যাত্রী হিরিম্বা। হায় ঘটোৎকচ, প্রিয় সন্তান আমার, সম্বল আমার... ফিরে আয় ওরে...! হায় মা গো, জন্মের ওপার থেকে কেউ কী ফিরে আসে... তুমি তো জানো, ভালোবাসার জন্যও কেউ ফেরে না!

কতই বা বয়স তখন, সদ্য যুবতী। ওগো দ্বিতীয় পা্ণ্ডব, ভালোবেসেছি তোমায়। আমি আর্যের শালীনতা জানিনি। শরীর মন দিয়ে আঁকড়ে ধরেছি তোমার প্রশস্ত স্কন্ধ। সিংহ কটিকে আমার শ্যামল শরীরের কাছে, আরো কাছে টেনে ধরেছি। ছল করিনি। মন পাব ভেবেছি। আর তুমি, তুমি কীনা মন দিয়ে বসলে কৃষ্ণাকে। জানি জানি, সম্রাজ্ঞী সে। কিন্তু আমি যে ছল করিনি সখা। আমার সন্তান হারানোর হাহাকারে কোথায় তুমি? আজ এ অশেষ যাত্রার যাত্রী যে আমি, সে কী তোমার মহাপ্রস্থানের ধুলিকণারও যোগ্য না? ধিক হে ভিমসেন, ধিক! কোন পথে তোমার মুক্তি মাগো, তবে কোনো আলো কী আছে?

হে মধুসূদন, তোমাকে দেখিনি আমি কখনো। আমি অশিক্ষিতা, অনার্যা। তবু আমিও যে নারী সখা আমার! তুমি সম্রাজ্ঞীর সম্মান রক্ষা করেছ, ন্যয় প্রতিষ্ঠা করেছ, তবে আমায় মুক্তির পথ দেখাও সখা। আর যে পারি না, ক্লান্ত চরণ, রুধির ধারা নিঃশেষ প্রায়। আমায় গ্রাস করো শ্যাম। নাহ, কেউ তো শুনছে না। কেউ কখনো শোনে না। তুমি অনার্যা রাক্ষসী, তোমার আবার মাতৃত্ব, তোমার আবার বিরহ! সব জন্মান্তরের মৃত্তিকাতে মিশে গেছে। আর যে সহ্য করা যায় না। শেষ শক্তিটুকু অর্জন করে চিৎকার বেঁচে ওঠে, ওহে তৃতীয় পাণ্ডব, তোমার মহাপ্রস্থানের নিদ্রা থেকে জাগরিত হয়ে আর একবার দহনে দগ্ধ করো এ বনানী। আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, জ্বলেপুড়ে একটু বেঁচে নিতে চাই। হায়, এখনো কেউ শুনতেই পায় না!

লেখক: বিশ্বভারতীর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী