অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সুষম-উন্নয়ন, নির্বাচন ও গণতন্ত্র

শাহেদ কায়েস

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৬, ২০১৮

বাংলাদেশে এখন নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে। বিদেশে আমাদের এক্সপোর্ট বেড়েছে। গার্মেন্টস রপ্তানির মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করছে, তারা দেশে অর্থ পাঠাচ্ছে, এসবের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু কোনও একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর দেশের জনগণের সার্বিক উন্নয়ন এক বিষয় না।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে কোনও একটি দেশের চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে দেশে দুর্নীতি বাড়ছে, ব্যাংক থেকে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুট হচ্ছে। দশ বছরে শুধুমাত্র ব্যাংক থেকেই লুট হয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা (সিপিডির তথ্য অনুযায়ী), কত হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে এবং হচ্ছে তার তো কোনও হিসাবই নাই।

আমার জানা নাই, পৃথিবীতে এমন দেশ কয়টা আছে যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পর্যন্ত ডাকাতি হয়, যেখানে দেশের প্রধান বিচারপতি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন, বাংলাদেশে সেটাও হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, দেশের শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে মেরুদণ্ডহীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে, ন্যুব্জ আইন ও বিচার ব্যবস্থা, সুশাসনের অভাব, দিন দিন বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা, সঙ্কুচিত মুক্তচিন্তা, মানুষের বাক স্বাধীনতা, প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ভিন্ন মত ও দলের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমখুন, নারীদের প্রতি সহিংসতা, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু মানুষের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা, বিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সরকারি দলের হামলা... এমন অজস্র সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে যখন একটি দেশ যায়, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে কোনও কাজেই আসে না।

এমন এক অমানবিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে যুক্ত আর ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মাত্র দশ ভাগ মানুষ সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পান আর বাকি ৯০ ভাগ মানুষ বঞ্চিত হন। বাংলাদেশে ধনী দরিদ্রের এই বৈষম্য অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং দিন দিন তা বাড়ছে। আমরা এসবের অবসান চাই।

বিজয়ের এই মাস ডিসেম্বরে দেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সরকারের অন্যতম একটি ভালো কাজ হচ্ছে একাত্তরের মানবতাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু খুবই দুঃখজনক বিষয়, দেশের স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও দেশের বড় দুইটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এখনোও রয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এই নির্বাচনে দুইটি বড় জোট- মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে তারা নির্বাচন করার নমিনেশনও পেয়েছে। এরও সুরাহা হওয়া উচিৎ।

আমরা চাই আগামী ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত হয়ে দেশে যারাই সরকার গঠন করুক, তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সুশাসন দিয়ে দেশটাকে পরিচালিত করুক। আমরা একটা কল্যাণকর গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে। চাই গণতন্ত্র, চাই সুষম-উন্নয়ন। দেশে গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন ছাড়া সুষম-উন্নয়ন সম্ভব না।

একাত্তরে বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, কিন্তু মানুষের মুক্তির যুদ্ধ এখনো চলছে। শুধু দশ ভাগ না, দেশের শতভাগ মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পাক। বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসুক। জয় বাংলা, জয় মানুষ, জয় মানবতা।

লেখক: কবি