আইয়ুব বাচ্চু আমাদের জন লেনন, বব ডিলান

রহমান মুফিজ

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৯, ২০১৮

আইয়ুব বাচ্চু আমাদের কালের নায়ক, কিংবদন্তি শিল্পী। আমাদের কুঁজো আর আটপৌরে তারুণ্যের উন্মাদনা ছিল তার গান। ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে, সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম’ কী অদ্ভুত সুরমূর্চ্ছনায় ভাসতে ভাসতে আমরা পাঠ নিয়েছিলাম অনন্য প্রেমের। ‘এই রূপালী গিটার ফেলে, একদিন চলে যাব দূরে’ শুনতে শুনতে অদ্ভুত শূন্যতায় তাড়িত হতাম বারবার, এখনো হই। কেন এত কাতর হতাম? কী আছে তার গানে? আছে অদ্ভুত জাদু। সে জাদুর ঘোর আমাদের এখনো কাটে না। আমৃত্যু কাটবে না। আজ যারা নতুন যৌবনে পা দিচ্ছে বা আগামীতে যারা দেবে তারাও এ জাদুর স্পর্শ পাবে। কারণ তার সৃষ্টি যৌবনের মতো চিরায়ত। সুর ও উদ্দীপনা কাল থেকে কালে সকল যৌবন অধিকার করার মতো সর্বগ্রাসী।

আইয়ুব বাচ্চু আমাদের জন লেলন, আমাদের বব ডিলান। এলআরবি আমাদের ‘দ্যা বিটলস’। ইয়োরোপ-আমেরিকার এ দুই শিল্পীর কাছে যেমন সেখানকার রক মিউজিক চিরকালের ঋণ নিয়ে অবনত তেমনি আমাদের বাংলা রক মিউজিকও চিরকালের ঋণ নিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর কাছে টুপিখোলা অভিবাদন জানাবে। আমাদের পপগুরু আজম খান যদি হন এ দেশের ব্যান্ড সঙ্গিতের সূচনাকার তাহলে আইয়ুব বাচ্চু হবেন তার বিস্তারকারীদের প্রধান। তার ব্যান্ডদলের ১২ অ্যালবাম আর একক ১৬টি অ্যালবামের এমন কোনো গান নেই যেটাকে অবহেলা করা যায়। তাই আমরা প্রথম বেলা থেকেই আইয়ুব বাচ্চুকে শুনতে শুনতে কাতর হয়েছি। মূলত আমাদের যৌবন, আমাদের আনন্দ গড়ে দিয়ে গেছেন আইয়ুব বাচ্চু।

পূর্ণেন্দু, সুনীল, আবুল হাসান, নির্মলেন্দুর কবিতার মতো তার গান আমাদের প্রথম যৌবনে ভিন্ন এক অনুরণন নিয়ে এসেছিল। বাংলা গান আমরা তার কাছেই প্রথম শুনেছি এমন তো নয়, তাহলে তিনি কেন এতটা দখলদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন? দখলদার নয়, মূলত তিনি অধিকার করেছিলেন আমাদের হৃদয়। কি দিয়ে অধিকার করেছেন? কথা, সুর আর গায়কী দিয়ে। আর অধিকার করেছেন ব্যাতিক্রমী তার মেধা দিয়ে।

উৎসব পার্বনে আমাদের এক চিলতে পবিত্র আনন্দ হয়ে আসতো আইয়ুব বাচ্চুর অ্যালবাম। প্রিয়তম নারীটির হাতে আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অর্ঘ হতো আইয়ুব বাচ্চুর বাছাই গান। পাঁচটা অ্যালবাম খুঁজে ১০টি বাছাই গান তুলে দিয়ে আমাদের ‘ভাষা’ পৌঁছে দিতাম প্রেয়সীর কাছে। সে দূরন্ত-দুর্দম সময়। আর আশেপাশের শহরে আইয়ুব বাচ্চুর কনসার্টের খবর পাওয়া মানে হাজার তরুণের ঘুম উবে যাওয়া।

আইয়ুব বাচ্চু যখন মঞ্চে দাঁড়তেন, আর গিটারে তুলতেন স্বর্গীয় দ্যোতনা সে সময় উন্মাতাল হয়নি এমন তরুণ আছে ক’জন আজকের বাংলাদেশে? যেনবা কেবলই ছন্দ, কেবলই সুর আর কথার মায়াজালে ভাসতে ভাসতে যাপন করা অনন্তকাল। কোন গানের কথা বলা যায়- আমি কষ্ট পেতে ভালবাসি? এখন অনেক রাত? সুখেরই পৃথিবী? এক আকাশের তারা? কোনো সুখের ছোঁয়া? একদিন ঘুম ভাঙা শহরে? অভিলাষী? হাসতে দেখো গাইতে দেখো? কোন গানটার কথা বলি যে গানটি আমাদের আরো আরো যুগ ভাসাবে না? কোন গানের সুর আমাদের জাগাবে না আরো শত বছর? আমাদের প্রেম-অপ্রেম, বিরহ-বিচ্ছেদ, সুর-সঙ্গম আর তরুণ মনের অব্যক্ত কথামালাগুলো সুর করে দিতেন আইয়ুব বাচ্চু-সে সুর বেঁচে থাকবে তো অবশ্যই। শুধু প্রেম-প্রীতি, সুখ-দুঃখেই নয়, দেশাত্ববোধক গান হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর সেই অসাধারণ গানটির কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ! কী অসাধারণ কথা আর সুরে বেঁধেছেন অনন্য এক কবিতা- তা কি জেগে থাকবে না আমাদের হৃদয়ে, বাংলাদেশের হৃদয়ে?

‘তুমি প্রিয় কবিতার ছোট্ট উপমা, তুমি ছন্দের অন্ত্যমিল/ তুমি বর্ষার প্রথম বৃষ্টি, তুমি পদ্ম ফোটা ঝিল...’। বাংলাদেশকে এভাবে কতজন দেখেছে গানে? গানটির শেষ কথাটি তো মনে আছে নিশ্চয়- যারা শুনেছেন, ‘তোমার মাঝেই স্বপ্নের শুরু তোমার মাঝেই শেষ/ ভালো লাগার ভালোবাসার/ তুমি আমার বাংলাদেশ/ আমার বাংলাদেশ।

এ গানে অন্তত তিনি মিশে থাকবেন দেশে, হৃদয়ে...অনন্ত সময়ে...