আইয়ুব বাচ্চু ভালো থাকবেন, যেখানেই থাকুন

রাজীব জবরজং

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৮, ২০১৮

নব্বই দশকের প্রথমভাগের শেষদিকে, আমরা তখন থাকি মফস্বল শহর ফেনীতে। সে সময়টায় ফেনী শহরে যে বারবার শপে চুল কাটাতে যেতাম সেই বারবার শপের নাম ছিল সম্ভবত ফ্যাশন হেয়ার ড্রেসার অথবা অন্যকিছু।

চুল কাটাতে যাব এটা ভাবলেই আমার ভালো লাগতো। কারণ, সেই বারবার শপে খুব সুন্দর সুন্দর গান বাজতো। একবার চুল কাটাতে গিয়ে শুনলাম কী সুন্দর একটা গান বাজছে। আনমনেই আমার শরীরটা দুলছে।

গানটা ছিল:
ও বন্ধু তোমায় যখনই মনে পড়ে যায়
বুকেরই মাঝে বড় বেশি ব্যথা বাজে
আমার ইচ্ছে করে প্রান ভরে তোমায় দেখি
আমায় কথা দাও কখনো ছেড়ে চলে যাবে না
ও বন্ধু তোমায় যখনই মনে পড়ে যায়
বুকেরই মাঝে বড় বেশি ব্যথা বাজে।

প্রায় টানা কয়েকদিন আমি গুনগুন করে এ গানটাই গাইতাম। গানটা কে গেয়েছে তা তো জানি না। বারবার শপ পর্যন্ত একা যাবার সুযোগ খুব একটা না থাকায় কত মানুষকে যে জিজ্ঞেস করেছি, কেউই বলতে পারেনি। তাতে কী, গানটা যতটুকু শুনেছিলাম ততটুকু মনে মনে সারাক্ষণ গুনগুন করে গাইতাম।

এরপর আরেকদিন চুল কাটাতে গিয়ে হঠাৎ শুনলাম আরেক গান, আশিকুজ্জামান টুলুর।
সেদিনও আকাশে ছিল চাঁদ
হৃদয়ের বন্দরে তুমি...

কোনো একদিন জেমসের,
ইচ্ছের পালক দিয়ে লিখেছি নুতন ঠিকানা
সেই পালকগুলো উড়িয়ে দিলাম অজানায়
আহা ওহো...

এভাবেই কখনো বারবার শপ, কখনো মিয়া ভাইয়ের স্টুডিও হলিউড, কখনোবা বেলাল ভাইয়ের মুদি দোকানে, কখনো বা নিজের বাসায় ক্যাসেট প্লেয়ারে ঘুরেফিরে আমার গান শোনার কান তৈরি হচ্ছিল। এভাবে দুম করে করে একদিন চুল কাটাতে গিয়েই শুনি কী অদ্ভুত অসাধারণভাবে গিটার বাজছে এবং একজন গাইছে:
ঘুমন্ত শহরে রুপালি রাতে
স্বপ্নের নীল চাদর বিছিয়ে
কষ্টের শীতল আবরণ জড়িয়ে
আমি আছি তোমার স্মৃতিতে...

মুহূর্তেই গানটা গেঁথে গেল। এবং ততদিনে জেনে গেছি আইয়ুব বাচ্চু এবং এলআরবি সম্পর্কে। জেমস চিরকাল আমার পছন্দের শীর্ষে থাকলেও যে কোনোভাবেই আইয়ুব বাচ্চু বা এলআরবির গান শুনে কৈশোর থেকেই আমি কী যে এক মুগ্ধতায় হারিয়ে যেতাম! নব্বই দশকের শেষে এবং শূন্য দশকের শুরু দিকে বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলোতে ফিলিংস, এলআরবি এবং আর্ক ব্যান্ডকে কেন্দ্র করে বন্ধুদের মধ্যে এক রকমের যুদ্ধ হতো। এমনকি বন্ধুদের মধ্যে যে  ক‘জন আর্কের ফ্যান তাদের মধ্যে সখ্য অন্যদের চেয়ে একটু বেশি।

ঠিক একইভাবে ফিলিংসের ভক্তকুল তাদের নিজেদের গোষ্ঠি এবং এলআরবির ভক্তরাও যে যার জন্য বেশি টান অনুভব করতো। কিন্তু যখন অ্যালবাম বের হতো, ঠিকই সবাই অ্যালবাম কিনতো। ১৯৯৫ এ বের হলো এলআরবি’র ‘ঘুমন্ত শহরে’। আইয়ুব বাচ্চু সলো অ্যালবাম ‘কষ্ট’। কষ্ট অ্যালবামটি সবাই এত বেশি শুনেছিল যে, মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে আর কোনো গানই নেই।

বছর না গড়াতেই আসলো ফিলিংসের ‘নগর বাউল’ এবং আর্কের ‘তাজমহল’। বাংলা ব্যান্ডের এক অদ্ভুত জোয়ার বইছিল সে সময়টাতে। আমরা কেউ কেউ জেমস হতে চাইতাম, কেউ বাচ্চু, কেউ টুলু অথবা কেউ হাসান। নব্বই দশকে কৈশোর কাটানো অধিকাংশ ছেলেই আসলে গোপনে গোপনে রকস্টার হতে চাইতো। আমি তো এখনো রকস্টার হবার বাসনা গোপনে পুষি। হয়তো কোনোদিন আমি রকস্টার হবার বাসনাই পুষতাম না, যদি না সেদিন চুল কাটাতে গিয়ে না শুনতাম আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে:

ও বন্ধু তোমায় যখনই মনে পড়ে যায়
বুকেরই মাঝে বড় বেশি ব্যথা বাজে
আমার ইচ্ছে করে প্রাণ ভরে তোমায় দেখি
আমায় কথা দাও কখনো ছেড়ে চলে যাবে না
ও বন্ধু তোমায় যখনই মনে পড়ে যায়
বুকেরই মাঝে বড় বেশি ব্যথা বাজে...

আইয়ুব বাচ্চু ভালো থাকবেন, যেখানেই থাকুন।