আদিম

রহস্যকাহিনি ৬

প্রাচ্য তাহের

প্রকাশিত : মে ২১, ২০১৮

শরীর ডুবিয়ে বসে রইলেন তিনি। এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে। বেশ ভালো লাগছে। আবছা অন্ধকার করে আছে উঠোনটা। বারান্দার আলো অতটা পৌঁছোতে পারেনি। উঠোন ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে দক্ষিণ দিককার দেয়াল ঘেঁষে বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে বেড়া দেয়া। চাঁদের ফিকে আলোয় অদ্ভুত স্বপ্নময় দেখাচ্ছে জায়গাটা।
ওদিকে কি, ফুলের বাগান?
জ্বি।
বেশ গন্ধ ছেড়েছে। রজনীগন্ধা?
জ্বি সার, এনে দেব?
আনো।

আবছা অন্ধকারের ভেতর মিলিয়ে গেল রাজু। তৈরিই ছিলেন তিনি। রাজুকে কিছুতেই হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না এখন। চোখকান খোলা রেখে হেলান দিয়ে বসে রইলেন তিনি। অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে তার। বাতাসে সাধারণ একটা পাতা পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে শব্দ শুনতে পান তিনি। অন্ধকার ভেঙে ভেঙে এগিয়ে চলা রাজুর পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি এক দুই তিন করে ক্রমাগত গুনে চলেছেন নীরবতার ভেতর আকণ্ঠ ডুবে থেকে।
যা ঘটবে বলে ধারণা করেছিলেন তিনি তা শেষ পর্যন্ত ঘটল না । অন্ধকারের ভেতর থেকে উঠে এসে রাজু দাঁড়াল তার সামনে। হাতে রজনীগন্ধা।
নেন সার।
হাত বাড়িয়ে ডাঁটাগুলো নিলেন তিনি। বললেন, ধন্যবাদ।

দারুণ একটা মিষ্টি গন্ধ ভুরভুর করছে বাতাসে। বাতাস ভারি করে তোলা কড়া গন্ধটা নামে এসে ধাক্কা মারে। মাথার ভেতর বাতাসে মিশে থাকা ঝাঁঝাল ওই গন্ধটুকু আটকে যায় যেন। বুক ভরে গন্ধ নেন তিনি। হাওয়া অনেকক্ষণ আটকে রাখেন বুকের ভেতর। চোখ বুজে আয়েশ করেন। ঘুম ঘুম মতো দুলতে থাকেন। স্বপ্ন। স্বপ্নের ভেতর হুস করে জেগে ওঠে আরেকটা স্বপ্ন। একটা ধবধবে শাদা রাজহাঁস। পিটপিট করে চায়। ঘাড় নাড়ে। সাঁতরায় হেলেদুলে পুকুরের ঘোলাটে ছায়াঘেরা সবুজ পানিতে। শ্যাওলা মাখা সোঁদা গন্ধ পানির। কি এক মাদকতায় সাঁতরাতে থাকে একা একা, দলছুট। মাথা দোলায়। দুপায়ে শান্ত পানি কেটে কেটে এগোতে থাকে রাজহাঁসটা। পর মুহূর্তে হয় চপলা হরিণী। ছুট লাগায় খোলা মাঠে। টানা টানা গভীর চোখ তুলে চেয়ে থাকে। গায়ের ডোরাকাটা দাগগুলো সূর্যের আলোয় সুন্দর দেখায়। রোদের পিছু পিছু দৌড়োতে থাকে।
স্বপ্ন গতি পায়। খুব সহজেই পটভূমি বদলে যেতে থাকে। ঠিক যেন ডারউইনের বিবর্তনবাদ। স্বপ্নের কি প্রাণ থাকে? বোঝার চেষ্টা করেন তিনি। ঝিমুতে থাকেন। পা নাচান। ক্লান্তি। বড় ক্লান্তি দেহের মধ্যে। মাংসের সঙ্গে সাঁড়াশির মতো আটকে আছে। কত দিনে ধীরে ধীরে জমেছে কে জানে। হাড়ের মধ্যে মজ্জায় মজ্জায় তিনি একরাশ ক্লান্তি অনুভব করলেন এই এত বয়েস বাদে, এই মুহূর্তে।

চোখ মেললেন তিনি। কি যেন একটা আঠার মতো লেগে আছে চোখের পাতায়। সহজে খোলে না। চোখ খুলেই চমকে ওঠেন তিনি। রাজু নেই। পালিয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন আমজাদ হোসেন। ধীরেসুস্থে ধোঁয়া ছাড়লেন। এ রকম ভাবালুলতা আগে তো কখনো এমন ভাবে পেয়ে বসেনি তাকে। আজ কেন হঠাৎ? তবে কি তার বয়েস বাড়ছে? বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন তিনি? বুকের নিচে কি কুটকুট করে উইপোকা অনবরত ক্ষয় করে চলেছে তার বয়েসের উত্তাপ? তাই বা কি করে হয়। তার বয়েস মোটামুটি পঞ্চান্নই হবে এবার। তেমন তো বয়েস হয়নি। এ বয়েসেও পাহাড়ে উঠছে কত লোকে। রাত্রে বউয়ের সঙ্গে যৌনতা শেয়ার করছে। পঞ্চাশ তো আসলে যৌবনের তিন ভাগের এক ভাগ। পশ্চিমে তো এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। চুটিয়ে উপভোগ করে জীবন। শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন সিগারেট। গড়িয়ে গড়িয়ে কিসে যেন ঠেকল টুকরোটা। অন্ধকারে চিতাবাঘের চোখের মতো জ্বলতে থাকে সেটা। তারপর আস্তে আস্তে নিভতে থাকে।

খুব বেশি দূর যেতে পারেনি। চার-পাঁচ মিনিট পার হয়েছে মাত্র। এত অল্প সময়ে বেশি দূর খুব একটা যাওয়া যায় না। বিশেষ করে আমজাদ হোসেনের আওতা থেকে। হালকা পায়ে তিনি নেমে এলেন উঠোনে। গেটের দিকে পা বাড়ালেন। বেশি দূর যেতে হলো না। ফিরে এলেন আবার চেয়ারটায়। অবিনাশ রাজুকে টানতে টানতে নিয়ে এলো। লোকটা চোরের মতো দেয়াল টপকাচ্ছিল সার। সন্দেহ হওয়ায় ধরে নিয়ে এলাম।
ভালো করেছ।
মহিষের শক্তি সার ব্যাটার গায়ে। জাপটে ধরতেই এমন এক ঘুষি মারল চোয়াল সার ফুলে গেছে। দম নিল অবিনাশ। আমজাদ হোসেন তার চোয়াল ফুলে ওঠার কোনও আলামত দেখতে পেলেন না। তবে বেশ খানিকটে জায়গা লাল হয় গেছে ঠিকই।

লোকটা কে সার?
রাজু। এ বাড়ির কাজের লোক।
পালাচ্ছিল কেন?

চলবে