অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

আনন্দকাহিনি

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০১৮

রোদ আর ছায়ার ঝিলমিল রঙে ঘেরা একটি ঘর।
জীর্ণ, তবু তা আছে। ভেঙে এখনও পড়েনি। চৌকির ওপর স্থির বসে আছি আমি। এই ঘরের সংসারী পুরুষ। শুনতে পেলাম, কোথায় যেন ডাকছে ঘুঘু। তার পরপরই কাঠঠোকরা, এবং দোয়েল। এবং ইস্টিকুটুম। দেখলাম, পাখির ডাক কী রকম যেন ঝলমল ঢেউ তুলে বাতাসে ভেসে যাচ্ছে।
আমার ভালো লাগল।
আনন্দ নানা রঙের ঘূর্ণি তুলে নাচতে আরম্ভ করল বুকের ভেতর। ভেসে গেলাম রঙের ঘূর্ণির সাথে। যেতে যেতে দেখলাম, খয়েরি রঙের বৃদ্ধ এক পাতা ঝরে পড়ছে। বুঝতে পারলাম, আজ এই বাঁশপাতার মৃত্যুদিন। আরও বুঝতে পারলাম, পৃথিবীর মৃতপাতাদের মৃত্যুদিন কেউ লিখে রাখে না। মানুষ লিখে রাখে মৃত্যুদিনের আগের মুহূর্তে মৃত্যুদিনের খসড়া। কেবল নিজের, আর কোনও কিছুর নয়। কোনও প্রাণীর নয়।
একটি দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে গেল আমার বুকের ভেতর। বিড়বিড় করে উঠলাম, সবুজ যে উপায়ে খয়েরি হয়ে যায়, জীবনও সে উপায়ে মৃত্যু হয়ে যায়।
ঘরের কোথাও ডেকে উঠল টিকটিকি। এরপর কোনও এক পাখির ডাক। এখানে এত যে পাখি, যেন পাখির সংসার আমার। পাখির সংসার, বেশ তো কথাটা। আমি, বউ আর ছায়াবীথি। এই নিয়ে আমার পাখির সংসার। পাখির ডানায় মমতার যে প্রলেপ থাকে, আমার সংসার ঘিরে সে রকম কিছু একটা আছে।
কখনও কখনও আমার এ রকম মনে হয়। আর মনে হয়, ছায়াবীথি একটা ফুলের নাম। স্নিগ্ধ আর মায়াবী আবরণ ঘেরা একটি ফুল।
ছায়াবীথি একটা প্রজাপতি। কী যে আশ্চর্য সুন্দর ছায়াবীথির হাসি, আমি মুগ্ধ হই। যতবার দেখি, ততবার ভালোলাগা কী এক অনুভূতি আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। ছায়াবীথি যখন আধো আধো উচ্চারণে কথা বলে ওঠে, মনে হয় যেন, তার উচ্চারিত প্রতিটি কথাই এক একটি দৃশ্য। ছায়াবীথির হাসি দৃশ্যগুলোতে রঙ ছড়িয়ে দেয়, আর এভাবেই আমার চোখের সামনে একটি দৃশ্য তৈরি হয়ে যায়।
আয়না তুলে নিলাম হাতে। কবে যেন হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছিল, তা আর মনেও পড়ে না। ভেঙে যাওয়া আয়নার আধেকের কম একটি অংশে ঝুঁকে পড়ে আমি দেখতে লাগলাম আমার মুখ। একটা দেহ আছে। এক রকম আকৃতি আছে, যা মানুষের। এই যে নাক, ঠোঁট, চোখ, চোখের ওপর কপাল, এসব মিলিয়ে আমার মুখ, এই মুখের এক রকম ভাষা আছে। ইঙ্গিত আছে।
এই শরীর তবে আমি।
বউয়ের যে শরীর আছে, তা তবে তার।
ছায়াবীথির যে শরীর, তা আসলে ছায়াবীথির।
প্রত্যেক মানুষের যে শরীর আছে তা প্রত্যেক মানুষেরই। শরীর আলাদা তো হৃদয় আলাদা। অনুভূতি আলাদা। প্রাণে প্রাণ তাই মেলে না।
খুব নিমগ্ন এখন দুপুর।
তার ভেতর কড়কড়ে স্নিগ্ধ রোদ। ঝিঁঝিপোকার বিরামহীন ডাক, পাখির শিস, গাছের সবুজ পাতায় হাওয়া লেগে মৃদু ঢেউ নিয়ে পাতাদের দুলে ওঠা, ঘাস আর নানা রঙের ফুলের জগতে ডানা ছড়িয়ে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতির নিজস্ব পর্যটন, এ রকম, এ রকম আরও আরও দৃশ্য, রঙ, আর শব্দ নিয়ে দুপুর আছে তার নিজের ভ্রমণে।
নির্জন দুপুর এইখানে স্তব্ধ হয়ে থাকে। এবং ঝিমোয়। তন্দ্রার মতো গভীর আলস্যে ঝিমোই আমি। আমরা দুজন। দুপুর আর আমি। এই সম্পর্কে দুজনের মধ্যে গভীরতর এক সাঁকো আছে। নীরবতার গভীরতর বোধ হচ্ছে এই সাঁকো।  বসে থাকতে থাকতে আমি একসময় সাঁকো পেরিয়ে চলে গেলাম। দুপুর খরচোখে হাসল আমাকে দেখতে পেয়ে।
থমকে গেলাম আমি।
দুপুর গম্ভীর।
দেখলাম, তাপীয় বাষ্পের একটি আবরণ দুপুরকে ঘিরে। আর তার ভেতর রঙের অভাবিত এক জগৎ। নদী আছে। গাছপালা আছে। পাখি আছে। নদীতে মোহন সুন্দর রোদ এসে পড়েছে। চিকচিক করছে নদীর জল। একটি মাছরাঙা জলের দিকে মুখ নামিয়ে চেয়ে আছে খুঁটির ওপর বসে। ঝিরঝির হাওয়া বয়ে যাচ্ছে গাছপালার ওপর। পাতা কাঁপছে।
আর, কত কত শব্দ একটা দুপুরের ভেতর।
বললাম, আমি আমার জগৎ থেকে তোমার জগতে যোগাযোগ ঘটিয়েছি। আমি নিশ্চিত, তুমি চেয়েছিলে বলেই আমি ঘটাতে পেরেছি।
দুপুর যেন মেনে নিল, এ রকম ভঙ্গিতে হাসল। এরপর বলল, হ্যাঁ। মানুষের জগৎ আমাকে কী রকম যেন টানত। সেই টানটাই বুঝি ছুটে গেছে তোমার দিকে। এবং তোমাকে নিয়ে আবার ফিরে এসেছে আমার কাছে। বেশ তো তবে, এসো...
এরপর সখ্য হলো দুজনের।
কথা বলল। অনেক অনেক কথা। গোপন কথা। প্রকাশ্য কথা। কথা বলতে বলতে একসময় আমি বলল, চলো গোধূলি দেখে আসি।
দুপুর থমকাল।
বললাম, তোমাকে সাথে নিয়েই আমি গোধূলি দেখতে চাই।
দুপুর জানতে চাইল, কেন?
যেহেতু এই মুহূর্তে আমার আর তোমার সৌন্দর্যের একটা জগৎ তৈরি হয়ে গেছে। আমরা মিলে গেছি প্রাণে প্রাণে।
দুপুর বলল, কিন্তু বিকেল টপকে কী আমি যেতে পারব গোধূলির কাছে?
বেশ তো, তবে যোগাযোগ ঘটাও বিকেলের সাথে।
সে কী আর ঘটালেই ঘটানো যায়। যেভাবে ঘটে গেল তোমার আর আমার মধ্যে। বলেই হাসল দুপুর।
জীবনে কতবার আমি চেয়েছি, প্রাণে মিলে যাওয়া প্রাণকে নিয়ে গোধূলি দেখতে যাব। প্রাণে প্রাণ বুঝি তাহলে মেলে না। কাতর হলো আমার আত্মা। জখম হলো।
যন্ত্রণার রেখা নানা ভঙ্গিতে ভেসে উঠল আমার মুখে। তাকালাম দুপুরের দিকে। চোখে জলজ মেঘ। দুপুর চেয়ে রইল আমার দিকে বেশ কিছু সময়। এরপর বলল, চলো তবে... দেখাই যাক কতটা পথ পেরোলে তাকে পথিক বলা যায়।
শঙ্খের আনন্দঢেউ বুঝি কেউ ছড়িয়ে দিল আমার বুকে।

আমার দুজন, আমি আর দুপুর যাচ্ছি গোধূলি দেখতে। যেতে যেতে পথে, সামনে পড়ল নদী। নদীর স্বচ্ছ জলে চেয়েই আমি চমকে উঠলাম। বিকেলের করমচা রঙের রোদ টলটল করছে।
আতঙ্কিত স্বরে আমি ডেকে উঠলাম, দুপুর?
নিরুত্তর।
দুপুর?
শব্দহীন।
প্রদীপের শেষ নিশ্বাসের মতো আবারও ডেকে উঠলাম, দুপুর তুমি কোথায়... য়... য়...
একটা ঢেউ হাহাকার ছড়িয়ে দিয়ে ছুটে গেল দিগন্তে। দুপুর কোত্থাও নেই। তবু কোথাও আছে যেন মৃন্ময়ী দুপুর। আমার ভেতর কাতরতা। আমার ভেতর হাহাকার। শরীর যেন ভেঙে আসতে চাইছে। কাঁপছে হাতপা।
কী রকম নিঃসঙ্গতা, মৃতের মতো নিঃসীম নিঃসঙ্গতা আমাকে স্থির থেকে স্থিরতর করে তোলে। যেন আমি পাথর। ভার আছে, প্রাণ নেই। মন্ত্রচালিতের মতো আমি হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসি সংসারে। বউ চুল বাঁধছিল বসে মাটির দাওয়ায়। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল আমার দিকে চোখ রেখে।
বললাম, তেষ্টা পেয়েছো। একটু পানি দ্যাও।
বউ কথা বলল না। তবে আবারও হাসল কী রকম যেন চোখে।
বউয়ের পাশে গিয়ে আমি বসলাম। এবং বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। দেখলাম, একটা দুপুরের ভেতর থেকে রিপা একটা একটা করে নদীফুলপাখি লতাপাতাঘাস আলাদা আলাদা করে ফেলছে।
আমার ঝিঁমুনি পায়। আমি ঝিঁমোতে থাকি। কাঁপতে থাকে আমার পৃথিবী। অসাড় হয়ে যায় দেহ। তন্দ্রার মতো দুলতে দুলতে আমি ভাবতে লাগলাম, রিপা খাতুন মায়াবিনী কীনা। আমি তো জানি নারী, কিন্তু এবার জানতে হবে মায়াবিনী কীনা। ঢুলতে থাকি আমি। অতলান্তিক অন্ধকার থেকে যেন আমি উচ্চারণ করলাম, তুমি কি মায়াবিনী?
কথা নেই, তবে খিলখিল হাসির ধ্বনি মুখর হয়ে ওঠে চারদিকে।
তুমি কি রিপা খাতুন?
কথা নেই। হাসি নেই। নীরবতা।
নীরবতার এই ভাষা আমি বুঝতে পারলাম। এবং বুঝতে পারলা, এইবার আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এই শূন্যতায়, এই হু হু হাওয়ায়, শরীর ফুরফুরে হয়ে যাওয়া শূন্যতায়।
তবু, ঘুমিয়ে পড়ার আগে ষড়যন্ত্রমূলক স্বরে আমি জিগেশ করলাম, তোমাকে আমি চিনতে পারছি না কেন?
মায়াবিনী বলল, মায়ার ইন্দ্রজালে যে মানুষ থাকে তাকে চেনার চোখ কী জগৎ-সংসারে কারও থাকে? থাকে না বলেই তো মায়াবিনী হয়ে ওঠে প্রতিটি নারী। মায়াবী হয়ে ওঠে প্রতিটি পুরুষ।
হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম একটা সেতু। ঝুলন্ত সেতু, যেন শূন্যের ওপর দুলছে। আর তার একদিকে গোধূলির রঙ ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। কত কত যে পাখি সেই সেতুর ওপর, কেবলই কিচিরমিচির শব্দে ভরিয়ে দিচ্ছে শূন্যতা। সেতুর নিচে তিরতির বয়ে যাওয়া ছিপছিপে নদী। টলটলে সিঁদুররঙা তার জল।
ধীরে ধীরে আমি পৌঁছে গেলাম সেতুর ছবির জগতে। রঙচক্রে দীর্ঘ পর্যটন শেষে আবার ফিরে এলাম ঘর-গেরস্তে। রিপা খাতুন সেতুর নিচে বয়ে যাওয়া টলটলে নদীর ঢেউ দেহে নিয়ে চুমু খেল আমাকে। বলল, আমি তোমার জন্যে, কেবলই তোমার স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখে অপেক্ষায় আছি।
জিগেশ করলাম, কতকাল বসে আছ তুমি এইভাবে?
রিপা খাতুন বলল, দীর্ঘ বছর। পাঁচ বছর হতে পারে। হতে পারে দশ বছর।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, কারও কারও জীবন থেকে সারা জীবনও পেরিয়ে যেতে পারে।
বসলাম ঘরের দাওয়ায়। শেষ বিকেলের সিঁদুররঙা নরম রোদ ছড়িয়ে আছে পায়ের কাছে। রিপা খাতুন ছিল উঠোনে দাঁড়িয়ে। হাসছিল। হঠাৎ দেখলাম, রিপার হাসি থেকে কী রকম যেন রহস্য ছড়িয়ে পড়ছে। কেঁপে উঠলাম। কাঁপতে কাঁপতে জিগেশ করলাম, তোমার শরীরে দীর্ঘ এই বছরে আর কার কার স্মৃতি তুমি বাঁচিয়ে রেখেছো রিপা খাতুন?
বউ হাসতে থাকে।
আবারও জিগেশ করলাম, তোমার হৃদয়ে দীর্ঘ এই বছরে আর কার কার স্মৃতি তুমি বাঁচিয়ে রেখেছো হে?
রিপা খাতুন কথা বলে না। গোপন যন্ত্রণার মতো আমার বুকের ভেতর থেকে উঠে এলো, উহ!
রিপা খাতুন বলল, দেহ সম্ভোগের অনুভূতি প্রাণিমাত্রই এ রকম তীব্র যে, তা প্রাণীর চাহিদা। তবে আমি একজন মাত্র পুরুষের দেহ সম্ভোগ করেছি তোমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে।

ঝিমোতে থাকি আমি। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ভাঙন হচ্ছে কোথাও। ভাঙনের শব্দ হচ্ছে। বিস্ফোরক শব্দ। শব্দের ভেতর আলাদাভাবে শুনতে পেলাম, বউ বলছে, সম্ভোগ স্মৃতি আমি তোমার জন্যে লিখে রেখেছি। এই নাও।
ঘুম ঘুম চোখে ঘুমের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে আমি তখন ডুবতে আরম্ভ করেছি। এরপর অন্ধকার। অন্ধকারে নানা রঙের ছায়াশরীর। অন্ধকারে নানা রঙের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য। রঙের নানা রকম আঁকিবুঁকি অন্ধকারে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়। আলোর রেখা ছায়ার শরীর হয়ে ওঠে। এই আরেক জগত।
শব্দ ওঠে। মিহি শব্দ। ভারি শব্দ। ছায়াশরীরের চিৎকার। ফিসফাস কথাবার্তা। শুনতে পেলাম, খুব মৃদু শব্দের ঢেউ তুলে পাঠকাঠির বেড়া কাটছে উঁইপোকা। শুনতে পেলাম, একটি তক্ষক পাখির ডাক। দেখতে পেলাম, রিপা খাতুনের ছায়াশরীর ঘুরতে ঘুরতে মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। এই দৃশ্য আমার বুকের ভেতর হাহাকার ছড়িয়ে দিল।
এরপর দৃশ্য এবং শব্দের ভেতর দিয়ে আমি যেতে লাগলাম। যেতে যেতে এসে দাঁড়ালাম একটা পাহাড়ের পাদদেশে। বিস্ময়ে নিশ্বাস থমকে গেল বুকের মধ্যে। বিচিত্র রঙের নানা পাখি এই পাহাড় ঘিরে। পাহাড় যে, বোঝাই যায় না। যেন পাখির পাহাড়। ছোট ছোট সব পাখি। নানা রকমের রঙ শরীরে। পাহাড় ঘিরে ওড়াউড়ি করছে তারা। হেঁটে বেড়াচ্ছে পাদদেশে। আমার পায়ের কাছ দিয়ে। পাহাড়চূড়া দেখাই যায় না, কেবলই নানা রঙের পাখির নড়াচড়া চোখে পড়ে। কিচিরমিচির শব্দে চারদিক মুখর।
ভালোলাগা ঝিরঝির ঢেউ আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। চেয়েই রইলাম বিপুল বিস্ময়ের মতো দৃশ্যমান এই দৃশ্যের দিকে।
কী এক ঘোরের মধ্যে থেকে শুনতে পেলাম পাখির ভাষা। পাখির ছোট্ট বুকের ধুকপুক। ডানার ফরফর শব্দ।
বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে একসময় বিহ্বল হয়ে ওঠে আমার ভেতর। বিহ্বল একজন মানুষ ফিরতে থাকে সংসারে। শর্ষে ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে থাকি। শর্ষে ফুলের মৌতাত ছড়ানো গন্ধ মাতাল করে তোলে আমাকে। আনন্দে বিহ্বলতায় হাত বোলায় শর্ষে ফুলে। টুপ করে ঝরে পড়ে একটা ফুল। তুলে নিই। আর তখন দেখলাম, ছেড়ে আসা পাহাড়ে যে পাখি দেখেছিলাম, এখানেও তার কয়েকটা পড়ে আছে। মৃত। পাখিগুলোর মাথা নেই। গলার কাছটায় রক্ত জমাট হয়ে আছে।
মুহূর্তে টলে উঠল আমার পা। মাতালের মতো বিড়বিড় করে উঠলাম।
লাল ফ্রক পরা ছোট্ট একটা মেয়ে বসে আছে আলের ওপর। এ রকম মায়ামাখা টলটলে মুখ ছায়াবীথি ছাড়া আর কারও আমি দেখিনি। কী নিষ্পাপ আর স্নিগ্ধ এই মুখ। তবে এই মুহূর্তে মেয়েটির নিষ্পাপ মুখচ্ছবির ভেতর ক্রুরতার একটা ছায়া পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে হাতের ধারারো ছুরি দিয়ে পাখির গলা কাটছে। পাখিরা পালিয়েও যাচ্ছে না। বরং দেখে মনে হলো, পাখিগুলো যেন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গলা কাটার অপেক্ষায়। একটা একটা করে তারা এগিয়ে আসছে। আর মেয়েটি মাথাটা আলাদা করে পাখির দেহটা ছুঁড়ে দিচ্ছে শর্ষেক্ষেতের ভেতর।
হঠাৎই কী রকম যেন অন্ধকার হয়ে এলো চারদিকে। কারা যেন ফিসফাস করছে। মনে হলো, গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে কোথাও। এখানে আর আমি নিরাপদ নই। কিন্তু যাব এখন কোথায়? অন্ধকারে ফিকে আলোর নানা ছায়াশরীর ছোটাছুটি করছে। সামনে। পেছনে। ডানে। বামে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যে। রক্তের বৃষ্টি। লাল লাল বৃষ্টি। পাখি পাখি গন্ধ এই বৃষ্টির। কাতর ধ্বনি বৃষ্টিপাতের।
কাতরতা ছড়াতে থাকে আমার ভেতর। হাঁটতে থাকি। দৌড়োতে থাকি। হাঁপাতে থাকি আমি। বুক ঢিবঢিব করে। তেষ্টা পেতে থাকে।
দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার সামনে গাছপালায় ঘেরা নির্জন একটি কুঁড়ে। অবাক বিস্ময়ে কুঁড়েটার দিকে আমি চেয়ে রইলাম। রাত্রি গভীরতার দিকে যাত্রা করেছে। রাতের নিজস্ব সুললিত শব্দে চারদিক মুখর। ওপরে রুপোর থালার মতো ঝকঝকে চাঁদ। নরম আর উজ্জ্বল এক রকম আলো চারদিকে। গাছপালার ছায়া ছায়া আলো-অন্ধকারের ভেতর থেকে ডেকে যাচ্ছে পাখি। কী যেন কাতরতা স্বরে। ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝি। হঠাৎ হঠাৎ ঝিরঝির হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে উঁচু উঁচু গাছপালা।
স্নিগ্ধতা কেবল চারদিকে। এই অন্ধকারে। চাঁদের রহস্যময় দেহে। আশ্চর্য কুহক ছড়ানো একটা দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি স্থির হয়ে যাই। চেয়ে থাকি কুঁড়ের দিকে। টিনের একচালা। চারদিকে পাটকাঠির বেড়া। উঁই ধরে বেড়ার বেশিরভাগ অংশ খসে খসে পড়েছে। হতশ্রী মানুষের হতশ্রী ঘর। আমি তো একজীবনে এরকম হতশ্রী মানুষই হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম এরকম হতশ্রী ভেঙেপড়া নির্জন একটি ঘরে ঘুমোতে। জেগে থাকতে।
আমার বুকের ভেতর মুগ্ধতার একটা নদী বয়ে যেতে থাকে। মাথার ভেতর চাঁদের আলোয় ঘুমিয়ে থাকা ভেঙেপড়া একটি ঘর। এই এক মুহূর্ত। জীবন-যাপনের আর কোনও কিছুই আমার মনে পড়ে না। কারও মুখ মনে পড়ে না। আমি মানুষ কীনা, তাও তার আর মনে থাকে না। তবে মনে থাকে, আমি একটি প্রাণ। এই পৃথিবীর মুগ্ধ একটি প্রাণ। মুগ্ধ প্রাণে চেয়েই থাকি কুঁড়ের দিকে। ভালো লাগে। আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এই যে মুহূর্ত পেরিয়ে যাচ্ছে, এই সময়টাতেই আমি বেঁচে আছি পৃথিবীতে। এর আগে বেঁচে ছিলাম না। এরপরও বেঁচে থাকব না।
কুঁড়ের ভেতর থেকে নিশ্বাস ফেলার শব্দ হচ্ছে। গভীর ঘুমের মধ্যে থেকেই মানুষ এরকম নিশ্বাস ফেলে। ডেকে উঠলাম, কেউ আছেন ঘরে... কেউ কী আছেন...
কেঁদে উঠল একটি শিশু। একটি নারীর স্বর শোনা গেল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলছে, উঁ-উঁ, এই তো... নে, খা।
এরপর চুকচুক শব্দ। শিশুটি মায়ের বুক চুষতে থাকে।
ডেকে উঠলাম আবার, কেউ আছেন ঘরে?
নারীকণ্ঠ হতচকিত। ভাঙা ভাঙা শব্দে ঘরের মধ্যে থেকে ভেসে এলো, কে?
জবাব দিলাম, আমি একজন মানুষ।
নারী বলে, এখানে কাকে চান?
কাউকে না। দরজাটা একটু খুলুন। এই ঘরে আমি থাকতে চাই। এই ঘরে আমি ঘুমোতে চাই।
জবাব নেই। একটু সময় পর দরজা খুলে যায়।
থমকে গেলাম আমি।
থমকে গেল নারী।
আমি দেখতে পেলাম রিপা খাতুনকে। রিপা খাতুন দেখতে পেল আমাকে। ঘরের ভেতর কেঁদে উঠল ছায়াবীথি। বউ বলল, ঘরে এসো।
ফুরফুরে হাওয়া ছুটে গেল আমার ভেতর। বললাম, এই তবে আমার ঘর! এতদিন কেন জানতে পারিনি, বলো তো বউ?
বউ হাসে।
আমি তো একজীবনে এরকম একটি ঘরেই বেঁচে থাকতে চেয়েছি।
বউ জবাব দিল, বেঁচে তো আছই।
কেঁদে ওঠে ছায়াবীথি, দুদ্দে... দুদ্দে...
বউ ঢুকে যায় ঘরের মধ্যে। আমিও পা রাখলাম চৌকাঠে। এরপর হঠাৎ কী রকম যেন এলোমেলো হয়ে গেল মাথার ভেতর। শব্দের গুঞ্জন শুনতে পাই। কোত্থেকে যেন ভেসে ভেসে আমার কাছে চলে আসছে শব্দ। শব্দের ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকে ভেতর। প্রকাশ পেতে চায় শব্দেরা। শব্দেরা ছটফট করে। ছটফট করতে থাকি আমিও। এরপর জেগে উঠি। মাথার ভেতর সার বেঁধে কয়েকটি বাক্য দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলাম, এই বাক্য তবে শব্দ প্রকাশের বাহন। শব্দেরা শরীর চায়। শব্দেরা প্রাণ চায়। কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম।

বারুদের গন্ধে লোবানের গন্ধে স্থির হতে হতে হারিয়ে ফেলি পথ
পথের অনেক ঠিকানা। এপথে সেপথে ওপথে যারা গেছে
তারা কেউ লিখে যায়নি পায়ের ক্লান্তির কথা
আমার পায়ে শেকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে
কারও সাথে যেতেও পারছি না আমি
যার সাথে যাব সে তো ডাকাত, পথে আমার
সর্বস্ব লুট করে নেবে।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
একটি বাড়ি দেখলাম নারী দেখলাম পুকুরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে হাঁস
আর তখন গন্ধ পেলাম বারুদের
ঘুম ভেঙে গেলে গন্ধ পেলাম লোবানের

ঘুমের ভেতরে যে আমি, সে কে?
দাঁড়িয়ে রয়েছি যে আমি, সে কে?

বিশেষ দ্রষ্টব্য
বারুদ আর লোবান আমাদের প্রতিবেশী
প্রতিদিন গন্ধ পাই যাতায়াত পথে।

লেখা শেষ হয়ে গেলে চেয়ে রইলাম অক্ষরগুলোর দিকে। কী জ্বলজ্বলে এক একটি অক্ষর। যেন চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি কী এই অক্ষরগুলোর প্রাণদাতা? কোথায় থাকে অক্ষরের প্রাণ, আমি তো তা জানি না। তবে কোথায় পেলাম এদের? এখন আমার সামনে একটি কবিতা।
আমিই কী লিখেছি এই কবিতা?
এই যে এখন বসে আছি একটি কবিতার মুখোমুখি, কে এই মানুষ? কিছু সময় আগে যে ছিল, সে-ই বা কে?
বসেই থাকি। চারদিকে ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকে শব্দেরা। মানুষের শব্দ। পাখির শব্দ। পাতার শব্দ। বাতাসের শব্দ। শব্দের এই জগৎ তো ঘুমের ভেতরও রয়েছে। ঘুমের ভেতর দৃশ্যও থাকে।
ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে থেকে ঘুম আর জাগরণের মধ্যেকার পরদা উঠে গেল। আর আমি, আমার ভেতর গভীরতর আলো-অন্ধকারে টের পেলাম, আরেক প্রাণের স্পন্দন। মহাশূন্যের অন্তহীন শূন্যতায় যা ছড়িয়ে যায়। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। টের পেলাম, আমার অস্তিত্ব লীন হয়ে যাচ্ছে। কেবল একটি প্রাণই অসংখ্য প্রাণের সাথে ঘুরেফিরে, ফিরে ফিরে আমার অস্তিত্ব অনুভূত করে তুলছে। স্থির থেকে স্থিরতার দিকে এই যাত্রা। যাত্রা শেষে সময়ের আর কোনও উপস্থিতি থাকে না। তাই, আমার চোখের সামনে সময় এখন স্তব্ধতার শরীর। তা ঘিরে নীরবতার আশ্চর্য সম্মোহন রয়েছে। আশ্চর্য এই নীরবতার ভেতর সময় যেন সম্মোহিত। সম্মোহিত আরও একজন, সংসারী এক পুরুষ।
সম্মোহন ভেঙে তীব্র একটি স্বর আমার হৃদপি- কেটে কেটে চলে যায়। শুনতে পেলাম, আর কতদিন থাকবে তুমি এইভাবে বসে? কিছুই চোখে পড়ে না তোমার? ঘরের বেড়া ভেঙে পড়ছে। বর্ষা এলেই চারদিকে হা হা। থাকবে কোথায় তখন তুমি, ভেবেছো?
বউ এসে বসল আমার পাশে। আর আমার মাথার ভেতর তখন পৃথিবী ভেঙে যাওয়ার মহাবিস্ফোরক শব্দ। মাথার ভেতর তখন অগ্নিকু-।  
যে ঘরে আমি থাকতে চেয়েছিলাম, যে ঘরে আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম, সে ঘরের সৌন্দর্য চোখে পড়েনি বউয়ের। বউ নিরাপত্তা চায়। নিরাপত্তা জীবনের জন্যে। ছায়াবীথির জন্যে। সংসারের জন্যে।
সংসারের নিরাপত্তা কী আমিও ভাবেনি? সংসার তো একটা নারী আর একটা পুরুষের সম্মিলন। একটা জীবন একসাথে কাটিয়ে দেয়ার সামাজিক অঙ্গীকার। কিন্তু এই অঙ্গীকার মানুষের নিজের নয়। মানুষের প্রবৃত্তি কোনও অঙ্গীকার, কোনও রীতিনীতি মানে না। মানুষের প্রবৃত্তি আলো-অন্ধকারের গহ্বর। গহ্বরে শাদাকালো লালনীল এসব রঙের আলাদা কোনও চেহারা আর থাকে না।
প্রাণ তখন লীন হয়ে যায় সৃষ্টির আনন্দে। বীজ রেখে যাওয়ার তীব্রতা মানুষের আনন্দের তীব্রতর উৎস। যা আনন্দ তাই তো সৌন্দর্য। সৌন্দর্যমুগ্ধ বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষ দেহে দেহে মিলে যায়। ঢেলে দেয় বীজ। কেউ কেউ নানা উপায়ে আটকে রাখে বীজ, কিন্তু সৌন্দর্য দেখতে এবং তার আনন্দ পেতে বারবার তাকে ফিরতেই হয় বীজ উৎপাদনের কাজে।
রিপা খাতুন আমার জন্য সম্ভোগকাহিনি লিখে রেখেছে। এ রচনা তাই আনন্দকাহিনি। আনন্দকাহিনিতে কী কী লেখা থাকতে পারে, ভাবতে চেষ্টা করলাম। ভাবতে গিয়ে দেখলাম, এক একটি রচনা শেষ হচ্ছে আর আমার জীবন থেকে ভয়ংকরভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের যখন আড়াল ছিল, বাসররাতের হিম হিম কুয়াশায় ঢাকা চাঁদ তখন প্রতিরাতে ঝুঁকে থাকত জানলায়। রিপা খাতুনের দেহে ফুটে উঠত আশ্চর্য রঙের ফুল। মাদকতা ছড়াত। দেহের ভেতর, নাভির নিচে কী রকম যেন শিরশির ঢেউ বয়ে যেত। আনন্দ বয়ে যেত সারা শরীরে। এখন সৌন্দর্য নেই। এখন খলবল আনন্দে দেহ কাঁপিয়ে হেসে ওঠা আনন্দ নেই।
ভেঙে পড়ছি আমি। ভেঙে যাচ্ছি। ভাঙচুর হচ্ছে চারদিক। চোখের সামনে কেঁপে উঠল ভিটেমাটিসহ আমার সংসার।
বিমূঢ় হয়ে বসে চেয়ে রইলাম আমি রিপা খাতুনের মুখের দিকে। খুব কাতর স্বরে বললাম, সংসার বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাঁধ নেই তো সংসার ভাঙলে কেন হে?
রিপা খাতুন কথা বলে না। মনোযোগ আরেকদিকে নেয়ার অভিনয় করে।
বললাম, বুঝলে না? আচ্ছা বসো, বুঝিয়ে বলছি। তার একটা হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিলাম। এরপর বললাম, একটা পুরুষ যখন বিয়ে করে, সামাজিক নিয়মেই একটা নারীসহ গোটা সংসার সে কাঁধে তুলে নেয়। দাম্পত্যের বিপরীত কাজে যখন তুমি যাও নিশ্চিত জানতে, আড়াল প্রকাশ্যে চলে এলে আমি দাঁড়িয়ে যাব কামানের গোলার মুখে। আর তখন সংসার তোমাকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে। অবশ্যি আমার সাথে সংসার যদি করতে চাও, তবেই।
রিপা খাতুন কথা বলে না। চুপচাপ বসে থেকে কিছু একটা ভাবার অভিনয় করে। কথা বলে সংসারী পুরুষ, আমাকে আবার সেই আগের আমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাও? কোথায় তাকে তুমি আর পাবে। সে তো মৃত।
রিপা খাতুন কথা বলে না। একবার কেবল স্বামীর দিকে চেয়ে, কী যেন দেখে আবার চুপচাপ বসে থাকে। চেয়ে থাকে জানলা দিয়ে বাইরে। বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভেজা হাওয়া বইছে ঝিরঝির ঢেউ তুলে। চারদিকে গাছপালা স্নিগ্ধ সবুজ। আর সবুজ স্নিগ্ধতায় ডেকে যাচ্ছে পাখি। নানা রকম পাখি। নরম এক আলো জানলার ওপাশে ঘাসের বনে। কয়েকটা শালিক কী যেন খুঁজছে ঘাসের ভেতর ঠোঁট ডুবিয়ে।
রিপা খাতুন মুখ ফেরায়। জিগেশ করে, শালিকগুলো ওইখানে কী খুঁজছে বলো তো।
আমি জবাব দেই না।
রিপা খাতুন বলল, আহার।
আমি বললাম, এই মহাবিশ্বে প্রতিটা প্রাণীকেই আহার খুঁজে নিতে হয়। নিজের প্রাণ নিজেকেই বহন করতে হয়। কে আর কাকে বহন করে নিয়ে যেতে পারে। প্রত্যেকেই যার যার প্রাণ নিয়ে প্রাণান্ত।
রিপা খাতুন বলে, কেবল তুমি ছাড়া।
কথা না বলে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কোথাও আর শালিক দেখতে পেলাম না। তবে সজনেগাছের চিকন একটা ডালে লেজঝোলা একটা টিয়া দেখতে পেলাম। ডেকে উঠে আরেক ডালে গিয়ে বসল। এদিকটায় বেশ ঝোপঝাড়। কচুগাছের জঙ্গল। কচুর পাতায় বৃষ্টির পানি জমে আছে। টলটল করছে, বাতাস এসে যখন দুলিয়ে দিচ্ছে পাতা।
হঠাৎ এক ঝলক ভেজা আর ঠা-া হাওয়া ছুটে এসে আমাকে কাঁপিয়ে দিল। ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম। আর একইসাথে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার খুব ভেতর থেকে। তবে বুকের মধ্যেকার ভার নামে না। মনে হয়, কী যেন একটা পাথর কোথাও জায়গাজমি না পেয়ে আমার বুকের ভেতর এসে  সেঁধিয়েছে।
স্থির চোখে রিপা চেয়ে আছে আমার চোখে। কেঁপে উঠল আমার চোখের পাতা। কেঁপে উঠল না রিপা খাতুনের চোখের পাতা। কী রকম ভাবলেশহীন তার চোখের চাউনি। মনে হতে পারে বরফের গহ্বর। কিন্তু আমি জানি, তা নয়। বিস্ফোরক। যে কোনও মুহূর্তে কথার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এই নারী।
গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে করতে আমি বললাম, একটা জীবনে প্রতিটি মানুষ কয়েকবার কামানের গোলার মুখে দাঁড়ায়। যতবার দাঁড়ায়, ততবার নতুনভাবে পৃথিবীকে চেনে। চাইলেই মানুষ তাই আগের জীবনে আর ফিরে যেতে পারে না। যে জীবন আমি চিনে গেছি, তা কী আর অচেনা কখনও হয়?
এরপর আর কথা নেই। দুজন মানুষের না থাকলেও এই পৃথিবীতে আরও আরও প্রাণীর কথা তো রয়েছে। জানলার পাশে জামরুল গাছ থেকে হঠাৎ ডেকে উঠল পাখি, ট্রিট্রিটিট... ট্রিট্রিটিট...
আর তখন, সেই মুহূর্তে কে যেন আমার মধ্যে থেকে পরিষ্কার উচ্চারণে বলে উঠল, পাখির একটি শিসের জন্ম হলে একটি জীবনের জন্ম হয়। রঙ আর স্বপ্নের আকৃতি নিয়ে সে থাকে মানুষের সংসারে।
বিড়বিড় করতে থাকি আমি, পাখির একটি শিসের জন্ম... বিড়বিড় করতে থাকি আর দেখতে থাকি আমার পাশ থেকে উঠে বউ ঘরের একদিকে বইয়ের বাকসের দিকে এগিয়ে যায়। বাকসের ওপর নানা কিছুর স্তূপ। স্তূপ হয়ে আছে কাগজ। আমার লেখালেখি। একটু খুঁজে রিপা স্তূপের মধ্যে থেকে ছেঁড়া এক টুকরো কাগজ নিয়ে এলো। এই কাগজে কবিতা লিখেছিলাম। কবে লিখেছিলাম, মনে নেই। এরকম অনেক অনেক কাগজ রয়েছে সংসারে। ছড়ানো-ছেটানো। ছেঁড়া এবং দলা পাকানো।
কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বউ বলল, পড়ো।
আমি পড়লাম। কিছু দিন আগে লেখা কবিতা আজ আবার পড়লাম :

রাজমিস্তিরি টিনের চালা দিচ্ছে
আমার প্রতিবেশীর বাড়িতে আজ দুদিন ধরে
চলছে এই কর্মকা-
আমি বুঝতে পারি, আমার প্রতিবেশী সুরক্ষিত
আমার ঘরের পাটকাঠির বেড়ায় উঁই ধরেছে
ভাঙতে শুরু করেছে

আমার নিরাপত্তা কোথায়?

পড়া শেষ হলে তাকালাম রিপা খাতুনের চোখের দিকে। সেও চেয়ে আছে। কী যেন এক আনন্দঢেউ তার মুখের মানচিত্রে। কথারা ভাঙতে থাকে আমার ভেতর। গড়াতে থাকে তারা। শব্দ শুনতে পাই আমি। একসময় টের পেলাম, শব্দেরা আমার কণ্ঠস্বর দিয়ে বাক্য হয়ে বেরোচ্ছে।

মানুষ কথা বলে
নির্জনতার গহ্বর থেকে
মানুষ তা জানে না

তাই অনেক মানুষের কথাই
অশ্রুত থেকে যায় মহাকালের।

চুপচাপ বসে থাকে রিপা খাতুন। সে নিরাপত্তা খুঁজে পায় না আমার কথায়। কী রকম বাঁকা বাঁকা চোখে তাকায়। বাইরে চড়া রোদ ধীরে ধীরে নরম হয়ে যাচ্ছে। কী রকম ছায়া ছায়া রোদের রঙ। ছাইরঙা মেঘ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঢেকে ফেলছে আকাশ। হাওয়া নেই কোথাও। গুমোট এক ভাব। বৃষ্টি হতে পারে। ঝড় হতে পারে। ভেঙে পড়তে পারে সংসারের আবরণ। আর এরপর সংসার খা খা শূন্যতায় ভরে যাবে।
মানুষ দেখবে আমার খোলামেলা সংসার।
রিপা খাতুন জিগেশ করল, চোখের সামনে কী দ্যাখো তুমি সারাদিন?
জবাব দেই না আমি। কেবল তলিয়ে যেতে থাকি। তলিয়ে যেতে থাকি আদিম অন্ধকারে। গুহাজীবনে। সামাজিক রীতিনীতির বাইরে মানুষ যখন সভ্য জীবন-যাপন করত, সেই আশ্চর্য সময়ে।
রিপা খাতুন বলল, তুমি বসবাস করো তোমার কল্পরাজ্যে। বাস্তবে তুমি বেঁচে নেই। এইভাবে একটা জীবন কাটিয়ে দিলে, আশ্চর্য মানুষ তুমি। কথা বলতে বলতে সে শুয়ে পড়ল ঘুমন্ত ছায়াবীথির পাশে। ছায়াবীথির মুখে গুজে দিল স্তনের বোঁটা।
আমি বললাম, কল্পনা কী বাস্তব নয় রিপা খাতুন?
কল্পনা আবার বাস্তব হয় কী করে? যা কল্পনা তা তো কল্পনাই। বাস্তবতার সাথে তার মিল কোথায়?
ব্যাকরণগতভাবে কল্প একটা ধাতু। এর অর্থ সৃষ্টি। কল্পলোক মানে সৃষ্টিলোক। ইহলোক যে রকম সত্যি, তেমনই কল্পলোক স্বপ্নলোকও সত্যি। এমনকি রূপকথাও সত্যি।
কী সব যে বলো, মাথামু-ু নেই।
সত্যি-মিথ্যের মাঝখানে কোনও ব্যবধান নেই রিপা খাতুন। যা সত্যি তা-ই মিথ্যে। যা মিথ্যে তা-ই সত্যি। যে যেভাবে নেয়।
আর কোনও কথা বলে না রিপা খাতুন। ছায়াবীথিকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে।
আমি জিগেশ করলাম, পাপ আর পুণ্য কী, বলতে পারো?
যা খারাপ তা পাপ। যা ভালো তা পুণ্য।
আবার সেই খারাপ-ভালো। আচ্ছা ঠিকাছে, একটা গল্প শোনাই তোমাকে।
আস্তে আস্তে বলো, ছায়াবীথি উঠে যাবে।
আমি বলতে থাকি কিংবদন্তি। কিছু প্রেমিক থাকে সংসারে, যারা প্রেমিকার কথায় সূর্যকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে তুলে দিতে চায় প্রেমিকার হাতে। চাঁদকে প্রেমিকার গলার লকেট বানিয়ে দিতে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এমন থাকে না কিছু কিছু প্রেমিক?
থাকে তো।
এমন প্রেমিকাও থাকে যারা প্রেমিককে দিয়ে সব করাতে পারে।
হ্যাঁ, এরকম প্রেমিকাও থাকে।
তো শোনও, এক প্রেমিকা তার প্রেমিকের কাছে চাইল প্রেমিকের মায়ের প্রাণ। প্রেমিক তো বিস্মিত, কিন্তু পরাজয় সে কেন মানবে? ছুটে গেল মায়ের কাছে। মা তখন ছুরি দিয়ে ছেলের জন্যে আপেল কাটছিল। দেরি না করে পুত্র মায়ের হাতছুরি হাতে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে আমূল বিঁধিয়ে দিল মায়ের বুকে। বাইরে খুব ঝড় বইছে তখন। প্রেমিক ভয়ংকর নিষ্ঠুরতায় মায়ের হৃদপি- কেটে রওনা দিল প্রেমিকার বাড়ির উদ্দেশে। হঠাৎ পা পিছলে সে পড়ে গেল। হাতে ধরা হৃদপি- পরম মমতায় বলে উঠল, বাছা, লাগেনি তো?
হাতপাখা বন্ধ হয়ে যায় রিপা খাতুনের। সে চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। জিগেশ করলাম, কী বুঝলে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিপা খাতুন বলল, মায়ের মতো কী আর কেউ হয় এই ভবে! যে মা জন্ম দিল, তাকেই খুন করে ফেলল প্রেমিক। এরচে বড় পাপ আর নেই। তার স্বরে প্রেমিকের মায়ের জন্যে সহানুভূতি।
এই মায়ের পাশাপাশি মাতৃত্বের আরও একটা চরিত্র আছে। যে মা বুকের শিশুকে গলা টিপে মেরে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। আবার আরম্ভ করে সংসার।
রিপা খাতুন কথা বলে না। মাথা নিচু করে চেয়ে থাকে জানলা দিয়ে বাইরে। মুখে মেঘ মেঘ আকাশের ছায়া।  
এখন বলো, পাপ-পুণ্যের সীমারেখা কোথায়? মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম চোকির ওপর। চেয়ে রইলাম রিপা খাতুনের মুখের দিকে।
রিপা খাতুন কথা বলে না। আগের মতোই চেয়ে থাকে বাইরে।
আমি বললাম, পাপ-পুণ্য কিছুই না রিপা খাতুন। ব্যাপার হলো মানুষের প্রবৃত্তি। মায়ের হৃদপি- নিয়ে যে প্রেমিক তার প্রেমিকার বাড়ি যাচ্ছিল, তার যে প্রবৃত্তি, ঠিক একই প্রবৃত্তি ওই মায়ের যে তার শিশুকে গলা টিপে মেরে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। এই প্রবৃত্তির জগতে পাপ-পুণ্যের কোনও মানদ- নেই। শাদা কিংবা কালো, এরকম আলাদা কোনও রঙ নেই। পাপ-পুণ্য, শাদা-কালো মানুষ তার সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যেই নির্ধারণ করে নিয়েছে।
কোনো কথা বলল না রিপা খাতুন। ভাবলেসহীন মুখে সে বসে আছে। জানলার ওপাশে তার দৃষ্টি। ভেজা বাতাসের ঝাপটা এসে তার মুখের ওপর উড়িয়ে দিচ্ছে চুল।
শোনও রিপা, গল্পের প্রেমিক এবং মেয়েটির প্রবৃত্তিই প্রেম। এছাড়া প্রেমের আলাদা জাতের কোনও মানে কেউ দাঁড় করাতে পারবে না। সৌন্দর্য থেকে এই প্রেম মানুষের ভেতর জন্মে। এরপর জন্মে আনন্দ। আনন্দে ভেসে যেতে যেতে মানুষ ভুলে যায় আর সবকিছু।
মুখ ফেরায় রিপা খাতুন। ভুরু একটু নামিয়ে বলে, কিন্তু সামাজিক নিয়মেই তাকে লজ্জিত হওয়া উচিত।
যে এভাবে ভেসে যেতে থাকে সে আর সামাজিক থাকে না রিপা খাতুন।
রিপা খাতুন কথার হাল ছাড়ে না। কথার ঢেউ ছড়িয়ে সে বলে, মানে আমি বলতে চাচ্ছি, আবরণ না থাকলে সৌন্দর্য খুব করুণ উপায়ে নগ্ন হয়ে পড়ে। তখন আর তার সৌন্দর্য থাকে না।
থ হয়ে যাই।
স্থির হয়ে যাই।
বললাম, আর সৌন্দর্য না থাকলে আনন্দ থাকে না। আনন্দ না থাকলে জীবন থাকে না। জীবন থাকে তো বাস্তবতা থাকে না। তখন কল্পরাজ্য আর দৃশ্যরাজ্যের মধ্যেকার ব্যবধান চুকে যায়। একটু আগে তুমি জিগেশ করেছিলে, চোখের সামনে সারাদিন আমি কী দেখি। তোমাকে বললেও তুমি তা দেখতে পাবে না রিপা খাতুন। তুমি একটি ঝরাপাতা দেখতে পাবে। আমি দেখতে পাব প্রাণের একটি ফসিল।
বেশ কিছু সময় নীরবতা। এরপর একসময় নীরবতা ভেঙে বললাম, আমার বোধে কোনও সৌন্দর্য নেই। বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিমুহূর্তে তাই আমাকে সৌন্দর্য খুঁজে যেতে হয়। যতক্ষণ সৌন্দর্য দেখি ততক্ষণ আনন্দে থাকি। তুমিই এবার বলো, কীভাবে তবে আমি আর যন্ত্রসভ্যতার সভ্য হয়ে উঠব।
কথা বলতে বলতে মাথা ঝুলে পড়ল আমার। চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। শ্লেষ্মা জড়ানো স্বরে বিড়বিড় করে উঠি, শুধু মৃতদের গল্প কত আর পিঠে বয়ে যাব। এবার সারথি হলে মহাকাল কাঁধে নিয়ে যাব।
গুরু গুরু শব্দে মেঘ ডেকে ওঠে। আশ্চর্য শিরশিরে এক আকুলতা টে পেলাম দেহের ভেতর। কী যেন হারিয়ে ফেলার অমোঘ শূন্যতা আমাকে ঘিরে ধরল। বের করলাম মাউথঅর্গান। শেষ কবে বাজিয়েছিলাম,, সে স্মৃতি আজ বিস্মৃত। ধুলো জমে গেছে। কত কত দিন, কত কত রাত ঝরে গেছে এই মাউথঅর্গানের ওপর দিয়ে, তারই সাক্ষী যেন ধুলো। পরনের পাঞ্জাবি দিয়ে আন্তরিক মমতায় আমি ধুলো মুছলাম। এরপর ফুঁ দিলাম মাউথঅর্গানে। আর অমনি ঝিরঝির সুরের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল চারদিক। বৃষ্টি নেমে এলো। ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টি।
আমি বৃষ্টি দেখলাম। তাকালাম বউয়ের দিকে। বউ চেয়ে আছে আমার দিকে। মাউথঅর্গান বাজাতে বাজাতে আমি বেরিয়ে পড়লাম।