রিফাত বিন সালাম ও আবু তাহের সরফরাজ

রিফাত বিন সালাম ও আবু তাহের সরফরাজ

আবু তাহের সরফরাজের সঙ্গে গপসপ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮

শূন্য দশকের ধীমান কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ। এবার বইমেলায় তার দুটি বই বেরুবে। একটি কবিতার, আরেকটি উপন্যাস। প্রকাশিত মোট বইয়ের সংখ্যা সাতটি। নির্জনতাভূক এ কবির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন রিফাত বিন সালাম।

রিফাত: এবারের মেলায় আপনার কটি বই প্রকাশিত হচ্ছে?
সরফরাজ: দুটি। কবিতার বই ‘দরবেশি কবিতা’ আর থিল ফন লিমবার্গের জীবনী ভিত্তি করে লেখা উপন্যাস ‘দ্য লাভ লেটার।  

রিফাত: প্রকাশক কারা?
সরফরাজ: কবি ও প্রকাশক সৈকত হাবিবের প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রকৃতি’ থেকে বেরুচ্ছে ‘দরবেশি কবিতা’। আর ‘দ্য লাভ লেটার’ বেরুচ্ছে কবি ও প্রকাশক চন্দন চৌধুরীর প্রকাশনা সংস্থা ‘বেহুলা বাংলা’ থেকে।

রিফাত: বই দুটোর লেখাগুলো কবে লেখা?
সরফরাজ: ‘দরবেশি কবিতা’র কবিতাগুলো তা প্রায় সাত-আট বছর আগের লেখা। আর ‘দ্যা লাভ লেটার’ লিখেছি এ বছরেরই জুন মাসে। তড়িৎ গতিতেই লেখা আর কী। অবশ্যি এই খেলাটা আমি খেলতেও চেয়েছি। মানে, ঘটনা এবং নিয়তি আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে। আমাকে শুধু চরিত্রটাকে বুনে যেতে হবে। খুবই বোরিং, এবং একইসঙ্গে মজারও।

রিফাত: দরবেশি কবিতার বিষয়বস্তু কি?
সরফরাজ: তখন ক্লাস ওয়ানে কী টুতে পড়ি। মাথায় একটা ভাবনা খালি ঘুরপাক খেত, আমি কোথা থেকে এসেছি? মানুষ মরে গেলে কোথায় যায়? আম্মা-আব্বাকে জিগেশ করলে তারা বলতেন, আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি। তার কাছেই ফিরে যাব। এই পৃথিবী তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আবার ধ্বংস করবেন।
বিষয়টি আমাকে ভাবালেও আল্লাহর ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হতো না আমার। এখনো মনে আছে, ওই বয়েসটাই বেশ একটু বিষণ্ন থাকতাম আমি। একটু ঘরকুনে থাকায় একটু বেশি বয়সেই আশপাশের ছেলেদের সঙ্গে মিশতে শুরু করি। এরপর ফাইভে পড়ার দিকে ভাবনার ওই ভূত বিদেয় হয়। মানুষ যখন শৈশব পেরিয়ে আসে, সে তখন আসলে তার জীবনকে পেরিয়ে আসে। এরপর সামাজিক মানুষের মতো চিন্তাভাবনা, তাদের মতো করে সবকিছু করা... এভাবেই মানুষ ক্লান্ত হতে হতে বুড়িয়ে যায়, মরে যায়। বছর দশেক আগে একটি ঘটনায় তড়িৎ গতিতে আমার মাথায় আবার ওই ভাবনাটা এলো, যা শৈশবে আমার বিষণœ দিনগুলোর প্রশ্ন ছিল। আমি নিশ্চিত হলাম, আমি কিছুই না। একটা চরিত্রে আমি আসলে অভিনয় করে যাচ্ছি।
এরপর জীবন ও জগৎ নিয়ে যা যা আমার মনে আসতো, তা তা আমি লিখতে শুরু করি। সেসব কবিতাই এই দরবেশি কবিতা। এখানে সুফিবাদের ঘ্রাণ আছে, ধ্যানের গভীর মগ্নতা আছে। আছে মানুষের অনেক গোপন দরজার উন্মোচন। আমি আসলে আমার ছোট্ট বয়েসের চিরন্তন সেই প্রশ্নটার জবাব পেলাম এই বয়েসে এসে। কী কী জবাব পেলাম, তা নিয়েই আসলে দরবেশি কবিতা। জালালুদ্দীন রুমির একটি কবিতা হচ্ছে:
‘যা দেখছ, বিশ্বে এর কোনও পণ্ডিতি প্রমাণ নেই;
সে শুধু গোপন, গোপন আর গোপন।’
ওই গোপনকে নিজের ভেতর যেরকম চিনেছি, তার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা হচ্ছে এই বইয়ের কবিতাগুলো। এখন, আমার এই বিশ্বাস, এই দর্শন নিয়ে অনেকের নানা জিজ্ঞাসা থাকতে পারে। তাদের উদ্দেশে বিনীতভাবে বলব, কোরআন বুঝতে হলে ব্যাপক পাঠের একটা প্রস্তুতি লাগে। ব্যাপক পাঠ মানুষকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে নিয়ে দর্শক হিশেবে দাঁড় করায়। আর তখন কেউ যদি কোরআন পড়া শুরু করে, দেখতে পাবে, প্রতিটি বাক্য কীভাবে তার চিন্তার দরজা পরতে পরতে খুলে দিচ্ছে। ভোগবাদী সমাজে একজন ঈমামও কোরআন পড়ে কোনো না-কোনো ভোগের সুবিধে আদায়ের মাধ্যম হিশেবে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা। জ্ঞানীব্যক্তিরা কোরআন পড়েন অবিশ্বাস নিয়ে। ফলে আমাদের সমাজটা তথৈবচ। পদার্থ ও জীববিজ্ঞানটা পড়তে গিয়ে আমি অবাক হয়েছি। ধর্মের সেই একক সত্তার ইঙ্গিত! আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ এর বড় উদাহরণ।

রিফাত: মানুষের এই ভোগপ্রবণতা নিয়ে কিছু বলুন।
সরফরাজ: আজকের সমাজে ভোগ্যপণ্যের তুমুল আলোড়ন চলছে পৃথিবীজুড়ে। তার অভিনব সংস্কৃতি ও বিজ্ঞাপন পদ্ধতি ক্রমাগত চেষ্টা করছে মানুষের বাসনাকে উসকে দিতে ও বাজার বড় করতে। এরা বিশেষভাবে চেষ্টা করে যৌনবাসনাকে কাজে লাগাতে। এর জন্য আর্থসামাজিক যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, তা যেমন একদিকে অপূরিত আকাঙ্ক্ষার জন্য হতাশার জন্ম দিচ্ছে, তেমনই বাড়ছে বিভেদ, দুর্নীতি ও হিংসা। ফলে আজকের সময়ের বেশিরভাগ মানুষ ভোগকেই জীবনের মানে বলে জানে। অথচ জীবনের মানে হচ্ছে জ্ঞান অর্জন। নিজেকে জানা। স্রষ্টাকে জানা। এবং পৃথিবীতে মানুষের জীবনের মানে কি, তা জানা। মানুষ এখন অস্থির। ছুটছে। পাগলের মতো ছুটছে...

রিফাত: ‘দ্য লাভ লেটার’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু কি?
সরফরাজ: দ্য লাভ লেটারের বিষয়বস্তু হচ্ছে, বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তখন ব্রাসেলস এর মিউজিয়ামে বিশ্বের দুর্লভ সব চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়। এক রাতে প্রদর্শনী থেকে চুরি হয়ে যায় ডাচশিল্পী ভারমেয়ারের দ্য লাভ লেটার। এটি চুরি করে মারিও রয়ম্যান, যার বয়েস একুশ বছর। সে এতিম। টিভিতে দিনের পর দিন সে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অসহায় অবস্থা দ্যাখে, এই ছবি তার কোমল প্রাণ সইতে পারেনি। তাই সে তৎকালীন সময়ের দশ মিলিয়ন ডলারের চিত্রকর্ম দ্য লাভ লেটার চুরি করে তার মুক্তিপণ হিশেবে মোটা অঙ্কের ডলার দাবি করে। এবং জানায়, এ ডলার ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থা কারিতাসকে দিতে হবে। তারা পৌঁছে দেবে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধপীড়িত মানুষদের কাছে। গণমাধ্যমকে সে পরিচয় দ্যায় থিল ফন লিমবার্গ বলে। এ এমনই এক চরিত্র, যে কীনা ধনীদের সম্পদ কেড়ে এনে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দ্যায়।
প্রশাসন আটক করে মারিওকে। জনগণ মারিওর পক্ষে নানা সমাবেশ করতে থাকে। সরকার ছয় মাস পর মারিওকে মুক্তি দ্যায়। কিন্তু বিধস্ত মারিও বেরিয়ে আসে জেল থেকে। কিছুটা পাগল পাগল। বিয়ে করে প্রেমিকা অ্যানিকে। তাদের একটি মেয়েও হয়। অ্যানিকে মারধোর করতে থাকে মারিও। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর রাস্তায় রাস্তায় থিল ফন লিমবার্গের দিনরাত যাপন। অবশেষে করুণ মৃত্যু।

রিফাত: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
সরফরাজ: ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কোনও পরিকল্পনা নেই। একসময়ে করতাম, এখন আর করি না। এক সেকেন্ড পর আমার জীবনে কী ঘটবে, তা আমি জানি না। আমার পরিকল্পনায় কী এসে যায়! আমাকেসহ এই মহাবিশ্ব যিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনি যা চাইবেন, তা-ই হবে। আমাকে শুধু আমার কাজটা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে করে যেতে হবে। মহাগ্রন্থ কোরআনে আল্লাহ বলছেন, মানুষের জীবনে ভালো যা কিছু ঘটে তা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যা কিছু খারাপ আসে, তা মানুষের কৃতকর্ম বয়ে আনে। আকর্ষণ-বিকর্ষণ, নেগেটিভ-পজেটিভ, প্রতিটি প্রাণীর নারী-পুরুষ— জগৎ-সংসারের মূল সৃষ্টি উপাদান কিন্তু এ দুইটা। আমাদের প্রবৃত্তির জগতেও। কু আর সু। কু মানে নেগেটিভ হচ্ছে শয়তান, আর সু মানে পজেটিভ হচ্ছে পরম সত্তা। দেহধারী মানুষ জগৎটা মনে করে ভোগের। ফলে ভোগের দিকেই তার জীবনপণ। কিন্তু যদি প্রবৃত্তির জগতে ‘সু’কে ধারণ করে জীবনযাপন করা যায়, তবে তার দায়িত্ব পরম সত্তা নিজেই নিয়েছেন। এরপরও আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মানে কী থাকতে পারে?