আমাদের গল্প, আমাদের বীজতলা

পর্ব ২

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৫, ২০১৭

উঠতি যৌবনে আমরা কয়েকজন গল্প নিয়ে একটা আড্ডা দিয়েছিলাম। যা কথাসাহিত্যের কাগজ ‘ব্যাস’ এ ছাপা হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সে আড্ডায় ছিল, মাজুল হাসান, মোর্শেদ শেখ, শিমুল বাশার, সজীব দে, কামরুল আহসান, রাহাদ আবির ও আমি। আজ প্রকাশিত হলো পর্ব ২

 

মোর্শেদ শেখ: যাদের লেখা আমার ভালো লাগে, পাঠক হিশেবে সাবলীল একটা ঢঙ আমি পাচ্ছি, অবশ্যই সে লেখা আমাকে বেশি টানবে। আমি প্রথমে তো একজন পাঠক, এরপর আমার লেখালেখি। তো পাঠাভ্যাসে যদি আমার মনে হয়, অমুক লেখকের লেখা আমাকে তেমন তাড়িত করছে না, তবে আমি কেন পড়ব সে লেখা? সচেতনভাবেই আমি এড়িয়ে চলব সে লেখকের লেখালেখি।

মাজুল হাসান: আমরা যে জায়গাটিতে আছি, মানে আত্মহত্যার মতো একটা জায়গা, এ কারণে আমরা পারছি না আমাদের কণ্ঠস্বরকে উচ্চকিত করতে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে, লেখকের একটা দায় রয়েই যায়। লেখক কি নিজেই বিচ্যুত হয়ে যাবে, নাকি বিচ্যুত হয়ে যাওয়া জাতিকে নিয়ে আসবে তার চিন্তার জায়গায়। কিন্তু যদি এমনটি হয়ে যায়, লেখক ব্যক্তিগতভাবে নিজেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তাহলে সে কি লিখবে? কিংবা লিখতে পারবে কীনা। আমি নিজে অবস্থান করেই আমার চারপাশটাকে তুল আনব। ফর্ম তো একটা স্ট্রাকচার। যার ভেতর ফেলে আমি আমার গল্পটাকে তৈরি করব। কিন্তু প্রথমেই ভেবে নেয়া দরকার, আমার বক্তব্যটা কি। সেটা যদি স্বচ্ছভাবে তুলে না আনা যায়, তবে ওইসব ফর্ম দিয়ে কী হবে? আমি আমার যে কথাটা বলতে চাচ্ছি, তা দিয়ে যদি পাঠকের ভেতর কোনও অনুভূতি তুলে দিতে না পারি, তবে এ সবের মানে কী দাঁড়ায় শেষপর্যন্ত? অনেকেই ভাবেন, অমুক এ রকম করেছেন। তমুক ও রকম করেছেন। এসব দিয়ে তো একজন লেখক তার মতো করে কিছু বলতে পারবেন না।

আবু তাহের সরফরাজ: কমিটমেন্টের জায়গায় একটু বলি। লেখকের যদি চিন্তা করার মতো নিজের একটা জায়গা না থাকে, মানে, সে কীভাবে দেখছে প্রতিবেশ কিম্বা চারপাশকে, তাহলে আসলে সে যে গল্পটা বলছে, সেখানে আরোপিত কিছু উপকরণ এসে দখল করে ফ্যালে। মানিক বন্দোপাধ্যায় একটা কথা বলেছেন, একজন সাধারণ মানুষ যখন মাছের বাজারে যাবে সে কিন্তু মাছই কিনতে যাবে। মাছ কিনবে এবং ফিরে যাবে বাড়িতে। কিন্তু একজন লেখক যখন মাছের বাজারে যাবেন, তার কিন্তু হাজারটা দায়িত্ব পড়ে যায়। মাছের বাজারের যে গলিটা দিয়ে সে ঢুকছে, তাকে দেখতে হয় গলিটা কীরকম। যে মেছুনির কাছ থেকে সে মাছটা কিনছে, দেখতে হয় তার কথাবার্তার ধরণ, কী পরে আছে এবং তার দরদাম করার স্টাইল। যারা মাছ কিনতে আসছে, তাদের কোন অংশ কী ধরণের মাছ কিনছে। তাদের কথাবার্তা ও স্ট্রাকচারও দেখতে হয় লেখককে। সাধারণ মানুষের অতটা দায় পড়ে না এসব দিকে চোখ দেয়ার, কিন্তু লেখকের পড়ে। কী জন্যে পড়ে? পড়ে এ কারণে যে, তাকে লিখতে হবে। মানিক বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, একজন কথাসাহিত্যিক একটি জাতির অভিভাবক। এটা কিন্তু অনেক বড় একটা কথা। সাধারণ পাবলিকেরও কিন্তু নিজস্ব জীবনদর্শন রয়েছে। চিন্তার একটা জায়গা আছে। মানুষ মাত্রই কবি এবং সকলেরই কমবেশি আত্মোপলব্ধির সেন্স আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজের অনুভূতিকে দোদুল্যমান। তারা মনে করে, সে যা ভাবছে, তা চূড়ান্ত নয়। লেখককে কিন্তু স্থির সিদ্ধান্তে আসতে হয়, আমি যা লিখছি কিম্বা যে দর্শনে জীবন-জগৎ দেখছি, তা মূলত একটি সত্য। কেননা তাকে ব্যাপক পাঠ দিতে হয়। তার সেন্স কিম্বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী এবং কালিক সময়ের সব রকম বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে যায়। তো, লেখকের যদি আত্মদর্শনের কোনও স্থির জায়গা না থাকে, তবে সে আসলে কি লিখবে? আর পাঠকই তার কাছ থেকে কী পাবে?

শিমুল বাশার: প্রত্যেকটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকটা সিকোয়েন্সের মধ্যে দিয়ে আমি সমৃদ্ধ হচ্ছি। এই যে আমার পরিবর্তন এবং আমি, বারবার নিজেকেই ধরে ফেলতে চাচ্ছি। এই মূলত আমার লেখালেখির স্থিরতা। তার ভাষা কি, কণ্ঠস্বর কি, এসব প্রশ্নের সোজাসাপ্টা কোনও জবাব দেয়া এই মুহূর্তে কি সম্ভব? তবে আমি ধারাবাহিক একটা চর্চার ভেতর দিয়ে এগোচ্ছি। আমি মনে করি, আমি পরিবর্তনশীল। এবং আগের লেখকেরা আমার চর্চার ভেতর অবস্থান করছেন। তাদেরকে ছাড়া তাদেরকে বাদ দিয়ে আমাকে আলাদা করে ভাবার আর সুযোগ নেই। আমি তো বিশ্বাসই করি, আমিই পাঠক। আর আমি যখন আমাকে ধরে ফেলব, আমার সঙ্গে আমি প্রকৃত অর্থেই কমিউনিকেট করতে পারব। এরপর আমি যা লিখি তখনই তা সকল পাঠককে নাড়া দেবে। সেক্ষেত্রে আগের লেখকেরা কী রকম ছিলেন, তা ভাবার আর কোনও অবকাশ নেই। এই যে নিজেকে ধরে ফেলার একটা চর্চা চলছে, এভাবে একসময়ে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেলে, আমি হয়তো আর লিখব না। এই চর্চার ভেতর দিয়েই আমার নিজেকে প্রকাশ। আমার পৃথিবী দ্যাখার অভিজ্ঞতা।

সজীব দে: আরেকটু ব্যাখ্যা দাবি করে আপনার বক্তব্য।

শিমুল বাশার: দুঃখিত, আমি হয়তো আমার ভাবনা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি না। আমি যখন এই মুহূর্তে এই সময়কার আমি, এই আমি কিন্তু সবাইকে নিয়েই আমি, আলাদা কোনও আমি না। আমি প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছি। এই বদলে যাওয়ার কারণে একটু আগের আমি এবং এখনকার আমি’র একটা পার্থক্যের দেয়ালে আলাদা হয়ে যাচ্ছি। একটু আগের আমার সঙ্গে এখনকার আমি অনুভূতির যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করছি। তখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, আমি কি আমিত্বকে ধরতে পারছি কীনা। আসলে আমি আমার ভেতরে একটা পরিভ্রমণ আরম্ভ করেছি।

রাহাদ আবির: এটা কি লেখককে পরিশুদ্ধ করার জায়গা?

শিমুল বাশার: না। লেখকের অনুভূতিগুলো আলাদা আলাদা করে ফেলার একটা জায়গা এটি। এটা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ যাত্রার ভেতর দিয়েই হয়েছে। একসময়ে গল্প লেখার খায়েশ থেকেই যা মনে আছে তা-ই লিখতে আরম্ভ করলাম। সারাদিন সারারাত যেসব কথা নিজেকে বলে বলে শান্ত করতে হবে, শান্ত করার পর যে শান্তি আসে, তা পেলাম। বলা যায়, নিজের সাথে নিজের গল্প বলা। লিখে লিখে বলা। কোনোরকমের দায়বদ্ধতা এখানে নেই। যে কোনও সময়ে লেখা ছেড়ে দিতে পারি। যেদিন পারব না, সেদিন কেউ কোনও দায়বদ্ধতার দোহায় দিয়ে আমাকে লেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। লিখতে গিয়ে আমি আমার সাথে আমাকেই একরকমভাবে পরিচয় করিয়ে দিই। প্রতিবার পরিচয়েই আমি নতুন করে জীবন পাই। তখন বেঁচে থাকা অনেক সুন্দর মনে হয়। টের পাই, আমার চারদিকে আরও আরও প্রাণ রয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় যেন হাহাকার, পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা। তাই এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই- এই বেদনা নিয়ে সারাদিন ঘুরি আর নিজের সাথে কথা বলি। পৃথিবীতে কী হলো, কী হচ্ছে, কী হতে পারে, এই নিয়েই যত আলাপ। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমি কিন্তু প্রতি সেকেন্ডেই নতুন এক আমি হচ্ছি। পুরনো আমাকে ধরার জন্যেই নতুন আমার এই লেখা। যখন ধরতে পারি, তখন মজা পাই।      

চলবে...