আমার বন্যা বিষয়ক অবদমন আছে

পর্ব ২

প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:

সরফরাজ: আপনার সাহিত্যে বিশেষ করে ‌`গোসলের পুকুরসমূহ` উপন্যাসে ৯৮ সালের বন্যা নিয়ে বয়ান নানাদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। উপন্যাসে ‌`মনসামঙ্গল` অধ্যায়ে তা দেখতে পাই। বন্যার সময়টাও তো শৈশবেই?

মেহেদী: হ্যাঁ। ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। আমার দাদার লাঠিটার কথা মনে করিয়ে দিলেন। যেটাকে প্রাথমিক বন্যার দিনগুলিতে আমি অলস পড়ে থাকতে দেখতাম, যেন ওটারই একটা অবলম্বন দরকার হয়ে পড়েছিল, অথচ যেটা আমার দাদার অন্ধের যষ্ঠি! আমাদের দাদার বয়স তখন নব্বই পার হয়ে গেছিল। তিনি একটা ছোট চৌকিতে বইয়ের সঙ্গে ঘুমাতেন। মাথা দিতেন পশ্চিম দিকে। তার বাম হাতের বাহু থেকে বাম পায়ের হাঁটু পর্যন্ত দেয়াল লাগোয়া চৌকির কিনারে ছিল বিভিন্ন ভাষার বই। তিনি আরবি-ফারসিসহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন। সারাদিন শুয়ে-বসে পড়তেন। আর অবসর সময়ে বিশেষ করে বিকেলে তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে বের হতেন। কিন্তু বন্যার পানি বাড়ির  ভিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকলে তার হাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। লাঠিটা ঘরের সদর দরজার উপর থেকে ঝুলে থাকত। ওটার কোনো কাজ ছিল না তখন।

আমার বন্যা বিষয়ক অবদমন আছে। অর্ধেক বন্যা দেখেছিলাম। বন্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার আশঙ্কায় আমাদের আম্মা আমাদের আব্বাকে প্রস্তাব দেয়, বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ার। এতে বন্যা অসমাপ্ত রেখেই আমাদের পরিবার চাঁদপুর থেকে নোয়াখালী চলে যায়। নোয়াখালী গিয়ে বন্যার সাথে সম্পর্ক একেবারেই শেষ হয়ে যেত, যদি না বিটিভি থাকত। বিটিভির রাত আটটার খবরে বন্যা-পরিস্থিতি দেখানো হতো। বন্যা-সতর্কতার বিশেষ বুলেটিনে একটা বন্যা-কবলিত টিনের ঘর দেখানো হতো। যার জানালার ধারে ছোট শিশুসহ বসেছিলেন মা। খাটের ওপরে। একটা করুণ সুর বাজত ব্যাকগ্রাউন্ডে। সেই বন্যা-কবলিত ঘর আর জানালার মা ও শিশুর চোখ আজও আমি ভুলতে পারিনি। চোখে ভাসে।

নোয়াখালি গিয়ে খুব মিস করতাম আমাদের ঘরের সামনের হরিতকি গাছটাকে। যার নিচে বেতের চেয়ার-টেবিলে বসে থাকতাম কত দিন-দিপুর। সেই হরিতকী গাছের ছায়া আমার মাথার ভেতর ঢুকে গেছে! আজও সে আমাকে ছায়া দেয়। আমার অশান্ত মনকে শান্ত করে তোলে। বন্যার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নয়, এর অবদমনের প্রভাবই পড়ছে আমার সাহিত্যে। অর্ধেক বন্যা, পরিণত বন্যা না দেখায় সেটা আমি কল্পনা করে নিই, যেহেতু প্রথম অংশ দেখেছি। অর্থাৎ তিন মাস দেখেছি, তিনমাস দেখিনি।

বন্যা শেষে আমরা চাঁদপুরে ফিরে এলাম। সে এক বিরল দৃশ্য! চারদিকে দাগ আর দাগ। গ্রামের সমস্ত গাছের গায়ে পলিমাটির দাগ। নিচ থেকে যে পর্যন্ত পানি উঠেছিল সে পর্যন্ত। এ দৃশ্য ভোলার নয়। আজও চোখে লেগে আছে। মনে হলো, কেউ যেন গ্রামময় গাছে গাছে সমান রঙ করে দিয়ে গেছে এক প্রগাঢ় রাত্তির আন্ধারে। ফলে বন্যা আমার কাছে বাস্তব ও কল্পনার মিশেল। বাস্তবতা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে কল্পনা শুরু। সেই মিশ্র প্রভাবে লিখিত গোসলের পুকুরসমূহের ‌`মনসামঙ্গল` অধ্যায়।
 
বন্যা আমার কাছে একটা পরিবর্তনের সূচক, গ্রামের মানুষের জন্য। মানে, বন্যার আগে ও পরে, সময়ের বিভাজন। এমনকি আমার জীবনেও। বন্যার পর কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকেনি আমাদের গ্রামে। রাস্তা পাকা হয়েছে, বাঁশের সাঁকোর জায়গায় ব্রিজ-কালভার্ট হয়েছে, মানুষ খুব সহজে দলে দলে ঢাকান্তরিত হয়েছে। এরপর বিদ্যুৎ এসেছে, গ্যাস এসেছে। বাবুই পাখি আর কোনোদিন বাসা বানায়নি তাল কিংবা নিমগাছে। গ্রামে তাদের দেখা যায়নি। চড়ুই পাখিরা ঘরের কোণাগুলো থেকে কোথায় চলে গেছে! ব্রিজ-কালভার্ট নিচু করে নির্মাণ করায় বন্ধ হয়ে গেছে নৌপথ। বিশেষ করে ছইঅলা নৌকা আর কোনোদিন চলতে পারেনি! ইঁদুরের গর্তগুলো রাস্তার কোল থেকে দূরে কোথায় হারালো!
 
বন্যা নিয়েই একটা উপন্যাস লেখার কথা ছিল আমার। বেশ কয়েকটি অধ্যায় লিখে ডিলিটও করে দিয়েছি। ভয় পেয়েছি, অবদমন থেকে ভালো কিছু যদি জন্ম না নেয়। গোসলের পুকুরসমূহ যে ধরনের লেখা, সে অনুযায়ী ঠিক আছে। এখানে একটা ইউটোপিয়া আছে, ঘোর আছে। তার সঙ্গে অবদমনজনিত উদ্ভব ভালোই মানিয়ে গেছে। কিন্তু শুধু বন্যা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার বেলায় অবদমনকে প্রশ্রয় দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এই অবদমনটা কেটে যাক, তারপর হয়তো লিখব। যে বিষয় নিয়ে লিখতে চাই সেটার বাস্তব অভিজ্ঞতা যে থাকতেই হবে, এমন না। না থাকলেও লেখা যায়। কিন্তু অন্যদের অবদমন নেই, অভিজ্ঞতাও নেই, তাই তারা কল্পনার আশ্রয়ে বা জ্ঞান থেকে লিখতে পারেন। আমিও পারব তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে। সেক্ষেত্রে ভালো হয় অবদমন কাটলে। জানি না বন্যার অবশিষ্ট অংশ দেখার বা মোকাবেলা করার অপূর্ণ সুতীব্র ইচ্ছাটাকে কিসের ওপর দিয়ে প্রবাহিত করতে পারব?

চলবে...