অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম রূপম

অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম রূপম

আমার ভ্রমণিয়া দিন (১)

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৭, ২০১৭

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি পর্ব-১
কবে থেকে শুরু হয়েছিল আমার ভ্রমণ আনন্দদিন, বলতে পারব না। তবে সূচনাটা যে ছিল নানাবাড়ি দিয়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার বেড়ানোর কথা বলতে গেলে নানাবাড়ি যেমন সবার আগে আগে চলে আসবে, তেমনি কতবার যে কতভাবে বেড়িয়েছি, কত ঋতুদিনে, তাও বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু বহু ভ্রমণেও সে-আমার ভ্রমণআনন্দদিন একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি কখনো। বরঞ্চ চিরকালের অমূল্য রঙিন স্মৃতি হয়ে আছে এবং থাকবেও সবসময়; বলতে দ্বিধা নেই, আমার মনের মণিকোঠায় যেটুকু সুখস্মৃতি রয়েছে, তার অনেকটাই এই ভ্রমণ আনন্দদিনকে ঘিরে!
দাদাবাড়ি, গাজীপুর সদর থানার কাশিমপুরস্থ জরুন গ্রাম থেকে নানাবাড়ি কেরাণিগঞ্জ থানার রাজাবাড়ি গ্রামে আসাযাওয়ার মধ্য দিয়েই পার হয়েছে আমার শৈশব। বছরে চার-পাঁচবার তো হবেই, আরো বেশিও হতে পারে! আর এই যাত্রাপথের মাঝখানে পড়তো শহর ঢাকা। ফলে ঢাকার ক্রমবিকাশের ধারাটাও লক্ষ্যগোচর হয়েছে। কীভাবে বদলে গেল এর ল্যান্ডস্কেপ, কবে কোন মাঠটার মৃত্যু ঘটল, জলের কোন ধারা গেল থেমে, চেনা-অচেনা গাছগুলো হারিয়ে গেল কোথায়, নির্জন স্বচ্ছ সুন্দর পথ ফুটপাত ভরে উঠল অজস্র মানুষে। সব যেন ধারাবাহিক এক দৃশ্যপট! অবশ্য পুরো ঢাকার নয়, যেটুকু আমার চোখের আয়তসীমার মধ্যে ছিল, যেতে-আসতে পথে দৃশ্যমান হতো। জরুন গ্রাম থেকে কোনাবাড়ি বাস স্টেশন, কোনাবাড়ি থেকে ঢাকার গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া, সেখান থেকে সোয়ারিঘাট, সোয়ারিঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা-জিনজিরা হয়ে রাজাবাড়ি- এই যাত্রাপথের দু’ধার, দু’ধার ছাপিয়ে হয়তো আরো দূর দিগন্ত, যত দূর চোখ যায় সেই প্রান্তবর্তী সীমানা! তবে মুক্তিযুদ্ধের আগের কোনও স্মৃতিই মনে নেই, তখন আমার বয়স ছিল তিন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কিছু স্মৃতি জেগে আছে, তা পরে যথাস্থানে বলা যাবে।
শৈশবে যখন আমি আমার নানাবাড়ি বেড়াতাম, সেটা ছিল হারিকেনের যুগ। হারিকেনের আলো টিমটিম করে জ্বলত। আমাদের নিজেদের গ্রামে যেমন রাস্তাঘাট ছিল না, আমার নানাবাড়ির গ্রামের অবস্থা ছিল আরো সকরুণ। অথচ দুটি বাড়িই রাজধানী ঢাকার অতি কাছে। দাদাবাড়ি ঢাকা থেকে মাত্র ২৬ মাইল পশ্চিমে গাজীপুর জেলার জরুন। আর নানাবাড়ি রাজাবাড়ি ঢাকা থেকে মাত্র ১৫ মাইল দক্ষিণে কেরাণীগঞ্জে। ঢাকার এতো কাছাকাছি হলে কী হবে, উন্নয়নের কোনো চিহ্নই ছিল না। দুটোই ছিল যাকে বলে অজপাড়াগাঁ।
আমি কি কখনো পালকিতে চড়ে কোথাও গিয়েছি! বোধহয় না! তবে আমার জ্ঞান হওয়ার আগে আগেই যে পালকির অস্তিত্ব ছিল, তা আমি আমার নানাবাড়িতে পালকি দেখে ঠিকই অনুভব করেছিলাম। তখনো উন্নায় বুড়ো মানুষদের পালকি বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। আমাদের কখনো চড়া হয়নি। তবে ঘোড়ার গাড়িতে যে দু’এক বার ভ্রমণ হয়েছে, সে আমার খুব মনে আছে। সেটা আমার দাদাবাড়িতে। কাশিমপুর-কোনাবাড়ির ঘাসমুড়ানো কাঁচা মাটির রাস্তায় তখন ঘোড়ার গাড়ি চলতো। তবে সবসময় মনে হয় পাওয়া যেত না! যদি পাওয়াই যেত তাহলে আমাদেরকে প্রায় প্রায়ই কেনো হেঁটে যেতে হতো পুরো পথটাই। হ্যাঁ, কতো পথ যে হাঁটতে হয়েছে সেই কৈশোরে! মনে পড়লে আজো শরীর দিয়ে ঘাম ছোটে।
উন্নায় জরুন থেকে আমাদেরকে হেঁটে পৌঁছাতে হতো কোনাবাড়ি বাস স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতে আমার ছোটভাইবোন এবং আমার মায়ের দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসত। যদিও দূরত্ব ছিল মোটে দেড় মাইল। কিন্তু রোদগরমের ভেতর কখনো বা কাদামাটির রাস্তায় সেইটুকু পথ পেরুতেই নিজেদেরকে খুব অসহায় মনে হতো। পথে মুলান্দির বাড়ির তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসে আমরা জিরিয়ে নিতাম। কোনাবাড়ি বাস স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হতো বাসের জন্য। সেই সুদূর টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার বাস আসা যাওয়া করতো। ভুয়াপারের বাসও দেখেছি। উত্তরবঙ্গের বাসের অস্তিত্ব ছিল না তখন। কীভাবে থাকবে? বিশাল বিপুল যমুনা দু’পারকে দুটি আলাদা দেশ বানিয়ে রেখেছিল। যমুনা পার হওয়াটা ছিল তখন একটা ফ্যাক্টর। যমুনার ওপারের মানুষ লঞ্চ বা ফেরি পার হয়ে টাঙ্গাইল বা ভুয়াপুর বা বাহাদুরাঘাট পর্যন্ত এসে, সেখান থেকে বাসে বা ট্রেনে চড়ে পাড়ি দিত ঢাকা। কালিয়াকৈর থেকেও ঢাকায় বাস আসা-যাওয়া করতো। সে বাসকে বলা হতো মুড়ির টিন। দরজা-জানালা ছিল কাঠের। বেশ লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বাস! এক্ষুণি ভেঙে পড়বো, চারদিকে ছড়িয়ে দেবো নিজেকে। এমনই একটা হাবভাব বা হুশিয়ারি বডি ল্যাঙ্গুয়েজে। বাসের অবস্থা শোচনীয় থাকলে কী হবে। তখনো বাসের ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টরদের মধ্যে মনুষত্ববোধ বলে কিছু একটা ছিল। হাবেভাবে কখনোই বোঝাত না, দুনিয়ায় টাকাই সব। তারা আমাদেরকে অতি যত্ন করে বাসে উঠিয়ে সিটে বসিয়ে দিত। সিট দিতে না পারলে উশখুস করতো। আজকের দিনের মতো হেলাফেলার আচরণ করতো না, রূঢ় ব্যবহারে মন বিষিয়েও তুলতো না। বাসে চড়ে পথের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বেশ আরামেই চলে যেতাম ঢাকা। বাইমাইল-কড্ডা-বোর্ডবাজার-চেরাগ আলী-টঙ্গী-উত্তরা-এয়ারপোর্ট-কুর্মিটোলা-জোয়ার সাহারা- মহাখালী। শাহবাগ-কার্জন হল হয়ে গুলিস্তান, পরে ফুলবাড়িয়া! সেখান থেকে রিক্সা বা বেবি নিয়ে সোয়ারিঘাট।
দূর থেকে বুড়িগঙ্গা দেখলেই মনে বয়ে যেত শীতল বাতাস। লাল নীল কত রঙের পালতোলা নৌকা এদিক-ওদিক ছোটে চলেছে। তার মধ্যেই আবার ভট ভট করে চলছে স্টিমার বা লঞ্চ অথবা জাহাজ! জীবনের একটা চলমান গতিচ্ছবি। যা আমার জীবনকেও যেন নতুন গতির সঞ্চার দিত। মাঝিদের হাঁকেডাকে অস্থির হয়ে যেতাম। বুড়িগঙ্গা তখন এতোটাই স্ফীতিময় ছিল যে, এপার থেকে ওপার প্রায় দেখাই যেত না। পানি ছিল টলটলে পরিষ্কার আর ভরা। আব্বা আামাদেরকে নৌকায় বসিয়ে রেখে মাংস-পরোটা নিয়ে আসতেন। অতুলনীয় স্বাদের সেই পরোটা-মাংস খেতে খেতেই পৌঁছে যেতাম মাঝনদী। নদীর মধ্যে নানান রঙের মাছরাঙার দেখা মিলতো। তবে ভয়ে থাকতাম কখন না আবার বড় স্টিমার বা জাহাজ এসে পড়ে। তার ঢেউজল আছড়াতে আছড়াতে যে আমাদের ছোট্ট নৌকাটাকেও বেসামাল করে দেয়। ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতাম আমরা। তারপরের যাত্রাটা ছিল দুবির্ষহ। ওপারের জিনজিরা থেকে শুরু হতো হাঁটা। কত গ্রাম কত দীঘল পথ যে হাঁটতে হতো আমাদের। জিনজিরা থেকে মনু ব্যাপারীর ঢাল হয়ে বাঁকা চরাইল, মুক্তিরবাগ, করদিঘির পার, কাঠুরিয়া, কাজিরগাও, দিধপুর, নামারহাঁটি তারপরই রাজাবাড়ি! দিধপুর গ্রামের ছবিটা এখনো চোখের সামনে ভাসে। সম্ভবত মঠের কারণে। একটা বিশাল বড় মঠ পথের পাশে দাঁড়িয়েয়ে থাকতে দেখেছি। পুরনো, ভাঙাচুরা, গাছে আকীর্ণ। মঠটির কারণে পরিবেশটা একটা ভিন্ন রূপ পেয়েছিল। পথের দু’পাশে সরু খাল। খালের ওপারে এলোমেলো সব বাড়ি। এতোটা স্পষ্ট মনে পড়ে না আর কোনো গ্রামকেই। তবে ছোট ছোট নানা ইমেজ, পথের কোনো বাঁক, ধুধু মাঠের সর্ষে ক্ষেতের শিহরিত হলুদ, কোনো একটা খালের মধ্যে মাছ মারার দৃশ্য, মাছরাঙার ওড়োওড়ি, পুকুরঘাটে অসংলগ্না কোনো নারী এসব অনেক দৃশ্যই চোখে ভেসে ওঠে। আমাদেরকে প্রায় সাত আট মাইলের এক দীর্ঘপথ হেঁটে যেতে হতো। ছোটরা প্রায়শই এতোটা পথ হাঁটতে গিয়ে বিদ্রোহ করে বসতো। তখন হতো ভারি মুশকিল। ওদেরকে সামলাবে, নাকি নিজের হাঁটবার ক্লান্তির ধকলটুকু কাটাবে! অগত্যা একটু জিরিয়ে নেওয়া। কোনো বাড়ির মানুষের কাছে জলতেষ্টার পানি চাওয়া। তারপর পিচ্চিটাকে নাও কোলে বা কাঁধে! নিজের ভারই যখন বওয়াটা কঠিন, তখন আবার বুটকো মোটা আরেক পিচ্চির ভার নেওয়া। ব্যাপারটা যে কী দুর্বিষহ, আশাকরি তা কারোর কাছেই দুর্বোধ্য থাকার কথা নয়। এতো যে কষ্ট, হাঁটার অত্যাচার, তবু যখন দূর থেকে নানাবাড়ির মসজিদের গম্বুজ আর নিবিড় গাছপালাবেষ্টিত বাড়িটা চোখে পড়ত, আনন্দে হৃদয়মন অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে যেত! সব ক্লান্তি ঘুচে যেত কোথায়! আর যেন অপেক্ষার পালা সহ্য হতো না! হাঁটা ফেলে দৌড়ানো শুরু করতাম। বাড়িটাও যেন আমাদেরকে হাতছানি দিতে দিতে সরে যেত আরো দূর থেকে দূরে! মেতে উঠত নিষ্ঠুর এক লুকোচুরি খেলায়!
চলবে...