by Hawaii artist Donald K.

by Hawaii artist Donald K.

আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৩০

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জুন ১৪, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
আলু ও আখের চাষকে ঘিরেও কম মনোরম স্মৃতি ছিল না। কোপাকান্দির বিল আর তুরাগ নদীর মাঝখানের উঁচু জায়গাটায় দেশি আলুর চাষ আগে থেকেই হতো। সে যে কী আদরের মাটি! বালি আর সেঁদেলের মেলানো মখমল। হাতে নিলেই ঝুরঝুর করে ভেঙে যায়। আলুগুলো আলগোছেই মাটির নিচ থেকে উঠে আসে উপরে। আর মাটির ভেতর হঠাৎ একটা কিউট আলু পেয়ে যাওয়াটার আনন্দ যেন সাতঘড়া স্বর্ণের কলসি পাওয়ার মতোই কোনো ব্যাপার!

আলুক্ষেতের মাঝখানে মাঝখানে বাতরে বাতরে জন্মে উঠতো নানা আগাছা। সেই আগাছার ভেতর থেকেও কুড়িয়ে নেয়া যেত মানিকরতন। বউথা শাকের কথা বলছি। যেমন দেখতে কোমল, তার স্বাদটিও অপূর্ব। ভাতের সঙ্গে মিশে যেতে সময় লাগত না। আমরা বাতর থেকে বউথা শাক তুলে আনতাম কী যে মজা করে। আরেকটু দূরে হয়তো টমেটোর ক্ষেতে লাল সবুজ টমেটোগুলো বর্ণবিহ্বলতায় হয়তো মুগ্ধ করে দিচ্ছে! নানার বাড়ির ক্ষেতের বাতরেও মিলতো এই বউথা শাক। একটা সুন্দর মেয়ের মুখের দিকে তাকালে যেমন মনের ভেতরটা অনাস্বাদনীয় পুলকে ভরে ওঠে, নরম বালির মাটির ভেতর টমেটোর গাছে টমেটো দেখলে, মটরশুটির ফুল দেখলে, কিংবা বউথা শাক দেখলেও যেন মনে কেমন রোমাঞ্চকর শিহরণ তৈরি হতো তখন।

বাদাম বোনার মুহূর্তও কম রমণীয় ছিল না। কী যে যত্নে তৈরি করা হতো একেকটা ক্ষেত। তার জন্য যে কত খাঁটুনি! আজ চিন্তা করলেই তা বোঝা যায়। পুরো জমিটাকে চষে চষে মাটিতো ঝুরঝুরা করা হতোই, একবার উঁচু একবার নিচু এরকম ঢেউয়ের মতো বাঁক তৈরি করা হতো পুরো ক্ষেতেই। তারপর সেই প্রতিটি উঁচু সারির মধ্যেই নিবিড় হাতে বুনে দেয়া হতো বাদামের দানা। ক’দিন পরে দেখো বাদামি বা কিছুটা লালচে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কোনো পাতার ছাঁচ, তারপর দিনের পর দিন তা বড় হয়ে উঠছে, নতুন নতুন পাতা গজাচ্ছে, ঘন সবুজ পাতায় পাতায় ভরে ভরে একদিন হয়ে উঠছে বিশাল ঝোপড়া। ওদিকে মাটির নিচেও সংগঠিত হচ্ছে বাদামের কাচ্চাবাচ্চা!

বাদাম আর আলুর চাষ যেমন নদী-পারের নরম মাটিতে হতো, তেমনি টানের মাটিতেও পরে প্রচলিত হতে দেখেছি। বিশেষ করে টানের শক্ত মাটিতে আলু চাষের প্রবর্তনটা হয় অনেকটা আমার চোখের সামনেই, সেই হাফপ্যান্ট-পরা বয়সে ১৯৭৪-৭৫-এর দিকে। সেটা যেন এক রাতারাতিই ঘটে যাওয়া ঘটনা। একদিন হঠাৎ করেই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, কাশিমপুরের উদ্যোগে দেখি বাড়ি বাড়ি কর্মকর্তারা কৃষক সমাজকে টানের শক্ত মাটিতে নতুন পদ্ধতিতে আলু চাষের ব্যাপারটা বোঝাচ্ছে। প্রায় বিনামূল্যে সুদৃশ্য এক ডিব্বায় ভরা বীজও উপহার দিচ্ছেন। কেন যে বিএডিসি তখন এই নতুন জাতের আলু রোপণ করতে কৃষকদের পেছনে মরিয়া হয়ে লেগেছিল, তার কার্যকারণ আমার জানা নেই। ওদের ট্রাক্টর এসে চাষ করে দিয়ে যেত মাটি। বীজতো দিতই। কীভাবে চাষ করা হবে সে-আলু রীতিমতো হাতেকলমে শিখিয়ে দিয়ে যেত। কৃষকদের যেন লাভ নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারেও আশ্বস্ত করতো। ওরাই বোধহয় নির্দিষ্ট একটি দামে কিনে নিত কৃষকের কাছ থেকে ক্ষেতের সব আলু। সে-আলু গোডাউনের পর গোডাউনে সংরক্ষিত রেখে পরে একটা সময়ে বেশি দামে বিক্রি করে লাভ ওঠাতো।

আব্বা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হলে কী হবে, ক্ষেতে ক্ষেতে নিজেও কাজ করতেন, তার দেখাদেখি আমরাও ক্ষেতে ডুবে থাকতাম মাটি বুকে নিয়ে। আজ যেখানে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় জেলখানা এখানেই ছিল সেই আলুচাষের জমিগুলো। জেলখানা করার সময় সব জমি অধিগ্রহণ করে নিয়ে যায় সরকার। আমাদের সেই জমিতে এখন যে কত কয়েদি ঘুমাচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, তার কোনো হিসেব নেই। হয়তো এর মধ্যে রাজকীয় কয়েদিরাও রয়েছে। কখনো যদি আমারো সেখানে যাবার দুর্ভাগ্য হয়, অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা জুটবে যে, যাক, নিজের জমিতেই তো রয়েছি!

যেমন ঘটা করে সেখানে আলু চাষ হতো, আলু ওঠানোর মৌসুমেও ছড়িয়ে পড়ত উৎসব-মুখরতা। মাটির ভেতর থেকে আলু ওঠাতে যে কী মজা লাগত আমার। মা বিভিন্ন পদের রান্না তৈরি করতেন সেসব আলু দিয়ে। কোরবানির ঈদে যেমন মাংস দিয়ে তৈরি হতো মুখরোচক নানা পদের রান্না, আলু দিয়েও তেমন বাহারি রান্নার মচ্ছব বয়ে যেত। আজ যদি আলু ঘণ্টি করা হলো তো, কাল করা হবে আলুর দম পরশু করা হবে আলুর দোলমা। একের পর এক নতুন নতুন আইটেম আসতেই থাকত।

টানের জমির আলু আমার ভালো লাগত না। কেমন একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ পেতাম। নদীর পারের সেই নতুন আলুর মতো স্বাদ কিছুতেই মিলতো না। আহা! নরম কোমল মাটির সে আলু যেন ছিল আমার ঘরের উঠোনের দূর্বাঘাসের মতোই আপন। কিছু আলু হতো ক্ষুদে ক্ষুদে। সেসবের স্বাদও হতো ভিন্ন। কবুতরের মাংসের সঙ্গে জুড়িটা মিলতো ভালো। আর, নতুন পদ্ধতির চাষের আলুকে মনে হতো, কেউ হিজল গাছ মাড়িয়ে যেন বিদেশ থেকে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়ে দিল! তখন এই সব-ই কেবল শুরু হয়েছে। দেশের বদলে বিদেশি প্রজাতির মাছ আনা, গাছ আনা, ফুল আনা, সবজি আনা, মুরগি আনা। আমি প্রথম থেকেই বিজাতীয় কোনো জিনিস দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করতে পারিনি। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, মূলা এসব খাওয়াটা ধীরে ধীরে সয়ে গেছে। তবে তেলাপিয়া, ক্যাপ্টেন আরো যেন কী কী মাছ আছে কত রকম নামধাম, এখনো এসব খাই না, খেতে ভালো লাগে না। চাষের কই, পাঙ্গাস দেখলেই আমার অস্বোয়াস্তি হয়। ফার্মের মুরগির প্রতিও প্রথম প্রথম এমন বিবমিষা ছিল। ফার্মের ডিমের প্রতিও। খেতাম না। একেবারেই খেতাম না। এখন অবশ্য খেতে হয়। বাধ্য হয়েই খেতে হয়। দেশের মুরগিই বা কোথায় পাব দেশের মুরগির ডিমই বা কীভাবে মিলবে? দেশি মুরগির জাতটাকেও কি সংরক্ষণ করে রাখা গেল না? দেশপ্রেম দেখানোর জায়গা শুধু ক্রিকেট গ্রাউন্ডে!

সেই ধনেপাতার অদ্ভুত মাদকতা জড়ানো সুঘ্রাণ কোথায় হারিয়ে গেল? সেই গোলাপের ঘ্রাণ! একশো দুশো প্রজাতির গোলাপ রয়েছে এখন। কত বাহারি রঙ, সাজ। কিন্তু সবই ঘ্রাণহীন। আমার কেমন জানি এসব জিনিসকে প্লাস্টিকের মতো লাগে। সৌরভহীন ফুল কি আদৌ কোনো ফুল? আহা কাশিমপুর আসা-যাওয়ার পথে জিতার মোড়ে গেলেই প্রাণটা কাঠগোলাপের সুঘ্রাণে কী মাদকতাতেই না ভরে যেত! আজ যে কাশিমপুর এত ভালো লাগে, কাশিমপুরের স্মৃতি এত রমণীয় মনে হয়, তার পেছনের অন্যতম কারণ কি এই জিতার মোড়ের কাঠগোলাপের ঘ্রাণ? হতে পারে, ঋতুতে ঋতুতে গাছতলায় পড়ে থাকা সেই কাঠগোলাপের ঘ্রাণের একটা অদ্ভুত শক্তিতো আছেই, তার সঙ্গে মিশে আছে আরো অনেক কিছু— জমিদার বাড়ি, জমিদার বাড়ির সামনের বিশাল উঁচু উঁচু সেই দুটো ঝাউগাছ, জমিদার বাড়ির একপাশের বড় বড় গাছপালা ঘেরা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটা— যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে কবেই, বল খেলার মাঠ, তুরাগ নদীকে ঘিরে তো একটা উচু নিচু চড়াই উৎরাইয়ের ভয়াবহ সৌন্দর্য আছেই, এমন সুন্দর ঢেউখেলানো নদীসমৃদ্ধ বাজার আমি আর বাংলাদেশের কোথাও চোখে দেখলাম না, মাঝে মধ্যেই ঝুরিনামা বটগাছের ছায়াবাজি— বাজার থেকে নদীর তীর ঘেঁষা রাস্তাটা অনন্ত সৌন্দর্যের হাতছানি দিতে দিতে মিলিয়ে গেছে কোথায়, সেই হাতছানিতে কতদিন আলুথালু হেঁটেছি! শুধু কি প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যময়তা! কাশিমপুরে এটা সেটা উৎসবের ঘনঘটা লেগেই থাকত। দূর্গাপুজা হতো বিশাল আড়ম্বরে! ঘোষ বাড়ির সঙ্গে দত্ত বাড়ির, দত্ত বাড়ির সঙ্গে তমুক বাড়ির— একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা চলতোই— কার চেয়ে কে বেশি আকর্ষণীয় দূর্গা প্রতিমা বানাতে পারে! দশমীর দিন ছয় সাতটা প্রতিমা নিয়ে বিশাল বিশাল নৌকায় চলতো সেই প্রতিমা প্রদর্শনী। ঢোলের আওয়াজে আওয়াজে নৃত্যগীতের সেই উৎসবে মুসলমানরাও এসে ভিড় জমাতো। কাশিমপুর বাজারের নদীর তীর ভরে ওঠতো লক্ষ মানুষে।

চলবে