আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৩৭

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : আগস্ট ০২, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
আমার আব্বার ক্লাসেও একবার বিশাল এক কাণ্ড করে ফেলেছিলেন আরমান ভাই। পড়তে বসলেই নাকি তিনি ঝিঁমোতেন। এমনিতে গ্রামে যাত্রাগান হোক, নাটক হোক, কবিগান হোক, তিনি সারারাত জেগে সেসব দেখতে-শুনতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু রাতের বেলা কোনো পড়া মুখস্ত করা— হোক না সেটা সন্ধ্যারাত কী ভোররাত— আরমান ভাইয়ের চোখজুড়ে নেমে আসতো ঘুম। তো, সেই ঘুম ঘুম চোখেই তিনি কারক কত প্রকার ও কী কী— মুখস্ত করতে করতে ঘনগভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিলেন। পরদিন যখন ক্লাসে এলেন, আব্বা প্রথমেই তাকে পড়া জিজ্ঞেস করলেন, কারক কত প্রকার ও কী কী।

আরমান ভাই তার উত্তর দিতে গিয়ে গড়গড় করে আওড়াতে লাগলেন, কাক দুই প্রকার। দাঁড় কাক ও পাতি কাক। আব্বার হুংকার, তুই কাক পেলি কোথায়? আরমান ভাই চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন, বইয়েই তো আছে স্যার। আব্বা হুকুম দিলেন, বের কর। আরমান ভাই তখন তখনই বইয়ের সেই পৃষ্ঠাটা বীরদর্পে বের করে মুহূর্তেই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। ভারি অবাক হয়ে যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য কোনো জিনিস দেখছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, এইটা কেমনে হইলো? কালকে রাতে না দেখলাম কাক? এইটা কেমন হইলো স্যার! আরমান ভাইয়ের আত্মবিস্ময় কিছুতেই আর ভাঙে না।

আরেকবার কী হয়েছিল, স্কুলের কোনো এক পরীক্ষার সময়, প্রথম সাময়িক না দ্বিতীয় সাময়িক— আব্বা হঠাৎ তার অফিস কক্ষ থেকে বের হতে গিয়েই দেখলেন যে, পরীক্ষা রেখে আরমান ভাই বেরিয়ে আসছেন ক্লাসরুম থেকে। তিনি টয়লেটে ঢুকেও ঢুকলেন না, এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা বাঁক খেয়ে সড়কের দিকে যেখানে বটগাছের নিচে দু’একটি দোকান আছে, সেদিকে চলে গেলেন। বড়ই সন্দেহজনক আচরণ! কী ব্যাপার, আরমান ওদিকে গেল কেন? নকল-টকল করছে নাতো? হয়তো বই ছিঁড়েটিড়ে আনতে পারে! আব্বা পা টিপে টিপে একটু পরই পৌঁছে গেলেন সেখানে। আব্বাকে দেখেই কী যেন একটা লুকিয়ে ফেললেন মানুষটা, ক্লাস নাইন না টেনের ছাত্র শ্রীমান আরমান ভাই। আব্বা কী আর ছাড়ার পাত্র। মুখোমুখি হয়ে জানতে চাইলেন, কীরে, তুই এখানে কি করস?

আরমান ভাই আর কথা বলেন না। মুখ ঠেসে চেপে ধরে আছেন। আব্বা আবার জানতে চান, কী হলো? কথা কানে যায় না? এখানে কি করতেছিস পরীক্ষা রেখে? তবুও আরমান ভাই চুপ। জোর করে যেন মুখ বন্ধ করে আছেন। কথাগুলো ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য যেন তেড়েমেড়ে আসতে চাইছে, তবু তিনি বলছেন না, গালটাল ফুলেটুলে একেবারে সারা। একে তো পরীক্ষার হল ছেড়ে এভাবে বাইরে বেরিয়ে আসা, তার মধ্যে আবার কথা না বলা, এত চরম বেয়াদবি! আব্বা আবার ভয়াবহ রাগী মানুষ। তার হাতের বেতটা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো উপর দিকে উঠে গেল। রহমান স্যারের বেত, শরীরের যেখানে একবার বসে, মুত্যুর পরও সে জায়গা বারবার হাতড়াতে হয়। আরমান ভাইয়ের মুখ অটোম্যাটিকই খুলে গেল ভয়ে। আর অমনি দেখো, একরাশ সিগারেটের ধোঁয়ায় ঢেকে গেল আরমান ভাইয়ের সারা মুখ।

কীরে তুই সিগারেট খাইছস? নকল করা তবু মেনে নেয়া যায়, সিগারেট খাওয়া? সেটা কোনোমতেই বরদাস্ত করা অসম্ভব। ততক্ষণে নুয়ে পড়া আব্বার হাতের বেতটা আবারো চিরিক মেরে ওঠে যাচ্ছে ওপরে। আরমান ভাই শেষ খুড়কুটোটুকু আঁকড়ে ধরতে চাইলেন। আবারো শুরু হলো তার সেই চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া টাইপের কথাবার্তা, শোনেন চাচা। আগে আমার কথা শুইনা লন।

আব্বার হাতের বেতটা থামে। কী? কী বলতে চাস?
চাচা, মারতে যদি চান আমার মায়রে মারেন!
ক্লাসরুমের বাইরের আব্বাকে তিনি চাচাই বলতেন, ক্লাসরুমে অবশ্য স্যার। আব্বা আরমান ভাইয়ের কথা কিছুই বুঝতে পারলেন না, কেন? তর মায়রে মারবেন কেনো?
হেয়ই তো আমারে স্কুলে আসার সময় চুলার থেইকা নামাইয়া গরম গরম ঝাউ খাওয়াইয়া দিছে। কী যে গরম ধোঁয়া খালি বাইর হইতেই আছে। আর থামতেছে না।
এমন কথা শোনে আব্বার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল আর সেই সুযোগটাই নিয়ে নিলেন আরমান ভাই। খর্বাকৃতি এক পা নিয়েই এমন ঝাড়া দৌড় দিলেন যে, হাসির ধকল কাটিয়ে আব্বার পক্ষে আর সম্ভব হলো না এই কৃতিমান ছাত্রের পিছনে পিছনে দৌড়ানো! তিনি শুধু নিমিষেই অন্তর্হিত হয়ে যাওয়া আরমান ভাইয়ের গতিবেগ মাপার সুযোগটুকু পেলেন। জানি না, পরের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি আরমান ভাইকে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য পীড়াপিড়ি করেছিলেন কীনা, আব্বার কাছে আর সে-প্রশ্নটা করা হয়নি, গল্পটাই যা শুনে গিয়েছি।  

মোদ্দা কথা, আরমান ভাই যদি জরুন গ্রামে না জন্মাতেন আমার শৈশব অনেকটাই বর্ণহীন থাকত, বিভাহীন হতো। এই বিশ্বকাপের কথাই চিন্তা করুন, অনেক অনেকদিন পর আপনার চোখে কী কী দৃশ্য ভেসে ওঠতে পারে? নেইমারের মাঠে গড়িয়ে পড়া, এমবাপ্পের তিন তিনটি গোল, মেসির হতাশ বিবর্ণ হয়ে ফিরে যাওয়া, রোনাল্ডোর আহত কাভানিকে ধরে ধরে মাঠ থেকে বাইরে পৌঁছে দেয়া, ফাইনালের দিন বৃষ্টি মুখরতার ভেতর ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্র্যাভার কিটোরিভিচের (আহ! কোলিন্দা আই লাভ ইউ!) সমস্ত খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলিঙ্গন!

সেদিন যদি কোলিন্দা মঞ্চে না থাকতেন সন্দেহ নেই, অনেকটাই ফিকে হয়ে যেত ফাইনালের সব স্মৃতি। যেমন ফিকে হয়ে গেছে অপরাপর বিশ্বকাপ ফাইনালের তাবৎ দৃশ্যপটই। তারপরও কিছু কিছু দৃশ্য ফিরে ফিরে আসে, আপনি না চাইলেও এসে যায়। যেমন ধরুন গিয়ে ম্যারাডোনার সেই কান্না! আরমান ভাই আমার শৈশবের জন্য তেমন কিছু বিশেষ দৃশ্যপটই তৈরি করে গেছেন।

মাঝে মধ্যেই বাড়িতে চরম বিভীষিকা হয়ে সাইকেল নিয়ে হাজির হতেন নিধু ডাক্তার কী অধীর ডাক্তার। তারা বাড়িতে আসামাত্রই মনে হতো যেন সাক্ষাৎ যমদূত সামনে দাঁড়িয়ে। অথচ দুজনের চেহারার মধ্যেই ছিল খাঁটি বাঙালিয়ানার ছাপ। সৌম্য, শান্ত, ধীর মুখশ্রী। অধীর ডাক্তারের মুখের ছাঁচটা ছিল ঠিক কমলকুমার মজুমদারের মতো। তেমনই লম্বাটে, চোখে চশমা, কপালের সামনের দিকটায় চুল নেই। আর নিধু ডাক্তারের চেহারায় ছিল বনেদিপনা। ভারি গোঁফটায় ছিল স্টাইলিস্ট ছাট। চেহারায় এমন কৌলিন্য থাকলে কী হবে দুজনেরই হাতে ধরা কালো ডাক্তারি ব্যাগটা যে ছিল পুরোই অ্যাডগার অ্যালান পো-র কালো বিড়াল! যার ভেতরে নানান ওষুধের সঙ্গে সাজানো থাকত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। তারা বাড়িতে কারোর অসুখবিসুখের খবর শুনলেই সাইকেল চালিয়ে ছুটে আসতেন। আর অসুখেরও যেন তখন কমতি ছিল না। সিজন বদলানোর ফাঁকফোকরেই ঢুকে পড়ত সর্দি, জ্বর, পেটের অসুখ— এটা সেটা। চৈত্র মাসের প্রকোপেই বোধহয় আসত জলবসন্ত। আর, অসুখবিসুখ যাই-ই হোক, হয় অধীর ডাক্তার নয় নিধু ডাক্তারকে ডেকে আনো।

তারা আসুক, ভালো কথা, কিন্তু ওই যে হাতের ইনজেকশনটা! সেটাকে নিয়েই যত ভয়। কত বার আর্তি ঝরে পড়েছে আমার— ওষুধ খেলে হবে না? না, না, ডাক্তার সাহেবদের এক কথা, ইনজেকশন নিতেই হবে। সেজন্য ডাক্তার সাহেবরা বাড়িতে এলে মনে হতো আমি আর নেই, আমি গেছি!

চলবে