অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৫

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২১, ২০১৭

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
ঝাঁকিজাল ছাড়াও শরিকদের মধ্যে এই মাছ ধরার প্রতিদ্বন্দ্বিতা টের পাওয়া যেত বড়শি দিয়ে মাছ মারার সময়। এক শরিকের দুজন যদি বড়শি ফেলে মাছ ধরতে আসতো, আরেক শরিক থেকে আসতো চারজন। যে শরিকের জনসংখ্যা বেশি, তাদের সুবিধা ছিল বেশি বেশি মাছ ধরার। সাধারণত বাড়ির ছেলেসন্তানরাই মেতে উঠত অলিখিত এই অদৃশ্য লড়াইয়ে। পড়ালেখা লাটে উঠুক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছিপ ফেলে বসে থাকো স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে। তবু শরিকদের চাইতে বেশি মাছ মারা চাই। অবশ্য বিকেলের দিকেই এই কাণ্ডটা বেশি হতো। তারপর একদিন শরিকের যদি কোনও কারণে বড়শি হাতে ঘাটলায় আসা বন্ধ হতো, অপরপক্ষের কাছেও ব্যাপারটা ক্লান্তিকর ঠেকত। তখন বড়শি হাতে মাছ মারার চেয়ে মাঠে গিয়ে ফুটবল, ভলিবল কিংবা হাডুডু খেলাটাই হয়ে উঠত আকর্ষণীয়। কাদার মধ্যে হাডুডু খেলাটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠত। দাঁড়িয়াবাঁধা, তিলোসপ্লে, বৌমাছি খেলাও খেলতে দেখেছি। খেলাধুলা ছাড়াও চলতো চরম আড্ডাবাজি। গ্রামের কোনও রাস্তার কিনারে বসে অথবা বাজারের পাশের কোনও দোকানকে ঘিরে রাজ্যের যত গল্প! কিন্তু এর সবকিছুই পানসে হয়ে যেত যদি শরিক বসে যেত ঘাটলায় বড়শি হাতে, তখন মাছ মারা ছাড়া আর কোনও কথা হবে না!
বড়শির আধার হিসেবে ব্যবহার হতো কেঁচো আর ময়দার দলা। আমি কখনোই বড়শিতে কেঁচো ব্যবহার করতাম না, কল্পনাও করতে পারতাম না কেঁচোর কথা। কিন্তু অন্যরা বিশেষ করে সেই নাসিম মামারা কী করে যেন মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে কেঁচো বের করে নিয়ে আসতেন। কেটে কেটে গেঁথে দিতেন বড়শিতে। আমি ময়দার দলা থেকে একটু করে নিয়ে পুটুলি বানিয়ে বড়শিতে গেঁথে ছিপটা পানিতে ফেলে চুপচাপ বসে থাকতাম। তারপর অপেক্ষা কখন পানিতে ভাসা সুতোর কাঠিটা নড়ে ওঠে, মাছের টান লেগে পানির ভেতরের দিকে ডুবে যায়! সেটা যেন পরম কোনও মাহেন্দ্রক্ষণ! মাঝে মধ্যে সেই ক্ষণটার জন্য অপেক্ষা বড় বেশি দুঃসহনীয় হয়ে উঠতো। মাছ আর কিছুতেই বড়শিতে ঠোকরায় না। এই অসহনীয় অপেক্ষার জন্য নয়, তখন আমি সত্যিকার অর্থেই ছিলাম বইয়ের পোকা। বড়শি দিয়ে মাছ মারার চেয়ে আউট বই পড়াটাই ছিল আমার কাছে অনেক বেশি আনন্দের। তাই ঘাটলায় যখনই বড়শি নিয়ে বসতাম হাতে অবশ্য অবশ্যই থাকত বই। শরৎচন্দ্র, ফাল্গুনী কী নীহাররঞ্জন অথবা আকবর হোসেন। নতুন কোনো ঈদসংখ্যা থাকলে তো কথাই নেই, পড়ার চেয়ে ওটা নাড়াচাড়াতেই অনেক বেশি আনন্দ! পূর্বাণী, রোববার, বিচিত্রা, সন্ধানী কিংবা চিত্রালী। গোগ্রাসে সব লেখা পড়তে পড়তে ইঁচড়ে পাকা হতাম। আব্বাই কিনে নিয়ে আসতেন এসব ঈদসংখ্যা। তখন সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল রোববার। প্রতি সপ্তাহে রোববারেই বোধ হয় বের হতো সিনে ম্যাগাজিন চিত্রালী এবং পূর্বাণী। দৈনিক পত্রিকার সাইজের সে দুটো কাগজ সত্যিই পরিভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসতে পারত স্বপ্নের রুপালি জগৎ থেকে। তবে এটাও ঠিক, মাছ ধরার কাছে প্রতিবারই মার খেতো আমার বই পড়ার মগ্নতা। নিবিড় পাঠ যখন মাখন হয়ে উঠত, তখনই অনুভব করতাম বড়শিতে গাথা মাছের টান। তারপর দেখো ডুবে যাচ্ছে পানিতে ভেসে থাকা বড়শির কাঠিটা, টেনেও বুঝি নিয়ে যাচ্ছে কতকটা দূর! আর নয় দেরি, দাও টান সজোরে! তারপর দেখো জীবন্ত এক পুঁটি মাছের কেমন হাঁসফাঁস করা তড়পানি!     
আমি পুঁটি ছাড়া অন্য কোনও মাছ গাঁথতে পারিনি কখনো। অন্যরাও যে পেরেছে, তা নয়। পুঁটি ছাড়া আর কোনও মাছ সে পুকুরে এইভাবে অকাতরে বিলিয়ে দিত না জীবন। মাছদের মধ্যে বোধ হয় পুঁটিই সবচেয়ে সহজ, সরল এবং বোকা। না না, বোকা শব্দটা আমি উইড্রো করে নিচ্ছি। কী নিষ্ঠুরতা যে লুকিয়ে রয়েছে এই শব্দটার মধ্যে। একজনকে চরমভাবে ঠকানো হচ্ছে, বঞ্চিত করা হচ্ছে, লাঞ্ছনা করা হচ্ছে, তারপর আবার তার গায়ে একটা ‘বোকা’র সিলও মেরে দেয়া হচ্ছে! যা হোক, বড় পুঁটি উঠলে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে হতো। প্রতিদ্বন্দ্বিরাও তাকাত হিংসের চোখে।
ঘাটলার নিচের দিকে পানির তলায় ইটের খন্দরে গর্তে কালাবাউশরা চুপ মেরে বসে থাকতো। আমার চাচাতো মামা নাসিম ছিলেন এই মাছ ধরার বিশেষ মাস্টার। কীভাবে যেন পানির নিচে ডোবে গিয়ে খানাখন্দ থেকে কালাবাউশ মাছ হাতড়ে ধরে উঠে আসতেন ওপরে। আরও কিছু অবিশ্বাস্য কারিশম্যাটিক গুণ ছিল নাসিম মামার। ঘাটলার চিকন দেয়ালের ওপর দিয়ে যেখানে হাঁটাটাই ছিল দুরূহ, তিনি সেই শ্যাওলা পিচ্ছিল সূক্ষ্ম দেয়ালের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ে দৌড়ে একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে পুকুরের প্রায় মাঝখানে লাফিয়ে পড়তেন। কী জানি কী ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যায় ভেবে আমি চোখমুখ বন্ধ করে থেকেছি। না, কোনোদিন তেমন কোনও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে দেখিনি। বরঞ্চ দিন দিন নাসিম মামার দোসর আরও বেড়েছে। যারা সবাই দলবেঁধে চিকন দেয়াল অতিক্রম করে মাঝপুকুরে লাফিয়ে পড়ত!
নানাবাড়ির পুকুরটার অভিজ্ঞতা থেকে যদি আমি পুঁটি মাছকে বলি পৃথিবীর সবচেয়ে সরল মাছ, তাহলে বাইলাকে বলতেই হবে মাছদের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট। খালা মামারা তখন বাইলাকে বলতো ব্যালিস্টার। সমাজে তখন ব্যারিস্টারের খুব মূল্য ছিল। সবাই যেন লেখাপড়াটা শুরু করত জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য। তো, এই ব্যালিস্টার সাহেবকে কোনোদিন আমি দেখিনি বড়শির ধারেকাছে আসতে, জালেও তেমন ধরা পড়ত না। অথচ আমাদের অতি নিকটে এসে যদি কোনো মাছ ঘুরঘুর করত, সে ওই ব্যালিস্টার সাহেবই। যা আর কোনও মাছ কখনোই সাহস করতো না। ঘাটলার যে সিঁড়িটা জেগে আছে তার নিচের সিঁড়িতেই হঠাৎ দেখতাম কোনও একটা বাইলা মাছ যেন বেণী দোলাতে দোলাতে সিঁড়ির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাচ্ছে, খুব স্প্রিডে নয়, নিশ্চিন্তে, পাড়াবেড়ানো মেয়ের স্টাইলে! এত যে ভদ্র আর শান্ত ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ধরতে যাও, পানি ঘোলা করে মুহূর্তের মধ্যেই কোথায় উধাও হয়ে গেছে, টেরটিও পাওয়া যাবে না! আমি নিশ্চিত, পুকুরের ভেতর যদি প্রাণীদের কোনও সাম্রাজ্য থেকে থাকে, এই বাইলা মাছ ওদের হয়ে ঘাটলায় গোয়েন্দাগিরি করতে আসতো মানুষের খোঁজখবরাদি নিতে!  
বর্ষার পানি চলে যাবার পর, যখন শুরু হতো উন্না, রাজাবাড়িসহ আশপাশের গ্রাম থেকে আসতো টিকিটের বিনিময়ে মাছ ধরার আমন্ত্রণ। একটা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে সারাদিনের জন্য বসা যেত কোনও পুকুরের পারে। বড়শি নিয়ে বসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও থাকত। তারপর ফেলো বড়শি, দাও টান, মারো যত খুশি মাছ! কারো বড়শিতে মাছের পর মাছ উঠত, ফি-র টাকা উঠে গিয়ে লাভের পর লাভের অংক শুধু বাড়তেই থাকত। কেউবা আবার সারাদিন বসে থেকেও সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরত শূন্য হাতে, ভাগ্যের দোষ দিয়ে লুকাতে চাইত নিজের ব্যর্থতার গ্লানি।
একবার নানা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন চরের এক পুকুরে। তখন মাঠে মাঠে কেবল লাঙল দিয়ে চাষ দেয়া হয়েছে। এবড়ো থেবড়ো পড়ে আছে বড় বড় মাটির ঢেলা। কোনও কোনও ক্ষেতে মাটির সেই সব ঢেলা মুগুর দিয়ে গুড়ো করা হচ্ছে। আমরা কখনো জমির আইল ধরে আরামে, কখনো বা ঘোরা হয় বলে জমির ওপর দিয়েই যাচ্ছিলাম মাটির ঢেলায় পায়ে খামচি খেতে খেতে। দূরে কোনো কোনো ক্ষেতে আগুন জ্বলছিল। বর্ষা যাবার সময় যে শুকনো লতাপাতা ক্ষেতে রেখে যায়, আমন ক্ষেতের যে গছাগুলো শুকিয়ে পড়ে থাকে, সে সব আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে ফেলা হতো। ক্ষেত থেকে ক্ষেতের আগুনের ধোয়ায় উন্মুক্ত প্রান্তরে দিগন্তে দিগন্তে তৈরি হতো এক অপার্থিব মুহূর্তের ব্যঞ্জনা। এ যেন বাস্তবতার বাইরে অন্য কোনও এক অচেনা জগত।
অনেক পথের হাঁটা, প্রান্তরের ডাক আর দিগন্তের মায়াবী হাতছানির পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা অবশেষে দেখা পেয়েছিলাম সেই পুকুরটার। চারদিকে উঁচু পাড়ের ভেতর মাঝখানে কী সুন্দর টলটলা স্বচ্ছ পানি। এক নিটোল জগতের দোলা। যেন রূপকথার মায়া সরোবর। পদ্ম ফুলও ফুটেছিল চার পাঁচটা। পাড়ে পাড়ে প্রতিযোগীদের জন্য বসার আয়োজন করা হয়েছে। যারা টিকেট কেটেছেন, কেবল তারাই বসতে পারবেন। নানা একটা আসন নিয়ে বসে গেলেন বড়শি হাতে, তার পেছনে বসে পড়লাম আমার ছোট মামা আর আমি। তারপর শুরু হলো মাছের জন্য আমাদের তিন প্রাণীর অন্তহীন অপেক্ষা।
সকাল থেকে ভরদুপুর, বড়শি হাতে বসে রইলেন নানা। রুই গরমা কী একটা পুটি মাছও গাঁথল না। মানইজ্জতের প্রশ্ন যতটা না বড়, তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাড়ির মানুষগুলো যে সবাই উন্মুখ হয়ে থাকবে নানা বিশাল একটা গরমা কিংবা ভেটকি হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, সে আশায়। কারণ, অতীতে বরাবর এমনটাই ঘটেছে। খালি হাতে নানা কখনোই ফিরেননি। খালি হাতে ফিরবার মানুষও তিনি ছিলেন না। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। ফেরার সময় নানা জবরদস্ত এক গরমা মাছ জোর করেই আরেকজনের কাছ থেকে কিনে নিলেন! বাড়িতে ফিরে নানিকে কী বলেছিলেন, সেটা অবশ্য আমরা কেউ জানতে পারিনি কখনো, আদৌ জানবার চেষ্টাও করিনি।
চলবে...