আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ৯

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি  
এই শীত আর খেঁজুর রসকে ঘিরে আমার এক দারুণ রমণীয় স্মৃতি আছে। রমণীয় বলব নাকি ভয়াবহ, বুঝতে পারছি না। ঘটনাটা বললেই এর চরিত্রটা ঠিক কী বোঝা যাবে। সেটা আমার নানাবাড়িতে না, ঘটেছিল দাদাবাড়িতে। শহর থেকে আসা আমার এক দূর সম্পর্কের ছোটমামাকে চুরি করে খেঁজুরের রস খাওয়াতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে কী যে এক কাণ্ড ঘটেছিল, একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা। প্রশ্ন আসতে পারে যে, চুরি করে খাওয়ানো কেন? তার উত্তরে শুধু বলব, আমি ছোটমামাকে উপযুক্ত প্রতিদান দিতে চেয়েছিলাম। ছোটমামা আমাকে লালবাগের শায়েস্তা খাঁ অডিটরিয়ামের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকে চুরি করে বিয়েবাড়ির বিরানি খাইয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে, সেই ছোটমামা একদিন চার খালাম্মাসহ, তাদের সদ্য কেনা দামি টয়োটা নিয়ে শীতের এক দুপুরবেলা হাজির হলেন আমাদের দাদাবাড়িতে। ছোটমামাকে দেখেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল পাশের বাড়ির মস্তান খাঁ চাচাদের বিশাল বড় খেঁজুর বাগানটা। এক থেকে দেড় বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়েছিল সেই বাগান। আর মনে পড়েছিল বিরানি খাওয়ার প্রতিদান দেয়ার এই হলো উপযুক্ত সুযোগ।
সারা বিকেল আমরা গ্রামের এদিক সেদিক পই পই করে ঘুরে বেড়ালাম। সন্ধ্যার পর খাওয়াদাওয়া শেষে যখন সবাই ঘুমানোর জন্য বিছানায় গেল, তখন তো আবার হারিকেনের যুগ, গ্রামে সন্ধ্যাবেলাতেই নেমে আসত গভীর রাতের অন্ধকার, আমি মামাকে নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে গেলাম ঘর ছেড়ে। দাদাবাড়ির গ্রামে তখন এ-বাড়ি সে-বাড়ির মাঝখানে দেয়াল ছিল না, গেট ছিল না। এক বাড়ির ওপর দিয়েই আরেক বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া যেত। পুরো গ্রামের সব বাড়িই ছিল যেন একঘর। ফকফকা জোছনা রাত ছিল সেদিন। অনেক দূরের মানুষকেও আবছা চোখে পড়ে। তাই আমরা না হেঁটে ক্রলিং করার মতো বসে বসে পায়ের শব্দ বাঁচিয়ে আমাদের বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে মস্তান খাঁ চাচাদের জমির সীমানায় প্রবেশ করেছিলাম। জঙ্গুলে জমির খালি প্রান্তটা অতিক্রম করে একসময় ঢুকে পড়লাম মস্তান খাঁ চাচার সেই খেঁজুর বাগানে। খুব বেশি বড় বড় নয় গাছগুলো। তবু একটু তো গাছে উঠতেই হবে। এবং সেটা আমাকেই, কারণ, মামাতো আর গাছে চড়তে জানেন না, শহুরে মানুষ, এখানে যে এত রাতে আমার সঙ্গে এসেছেন সেটাই অনেক বেশি, বেচারা ভারী একটা স্যান্ডেল পরেছেন, ঠিকমতো হাঁটতেও পারছিলেন না। আমি আল্লাহ খোদার নাম বলে বুকে থুতু ছিটিয়ে উঠে গেলাম খেঁজুর গাছে। গাছের শরীরে ফুঁড়ে ওঠা গছায় পা ফেলে ফেলে ওপরে উঠে সবেমাত্র ঘটিটা খুলতে যাব, তখনই শোনা গেল মস্তান খাঁ চাচার বজ্রগর্জন, ওই খেজুর গাছে ক্যারা রে? গেলি! বলতে বলতেই যেন খেজুর গাছের ছায়ান্ধকারে তিনি এসে রুদ্রমূর্তির রূপ ধারণ করে আমাদের সামনে হাজির হলেন!
আমিতো তার গলার আওয়াজ শোনেই গাছ থেকে লাফ মেরে আমাদের বাড়ির দিকে না গিয়ে অন্যদিকে ভো দৌড়! আমার মামাটাকে বলতেই হবে, আমার চাইতে অপেক্ষাকৃত সরল। তিনি যে কেন আমারই মতো আমারই সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দেয়ার অ্যাটেম্পট পর্যন্ত নিলেন না, কে জানে! বোধ হয় আমাদের বাড়ির দিকে দৌড়ে পালানোর একটা মতলব করছিলেন, ভারী স্যান্ডেলটার জন্য হয়তো সম্ভব হয়নি, অথবা তার ভাবনার স্টাইলটা ছিল বিলম্বিত লয়ের, হয়তো থরহরিকম্পমান হয়ে পড়েছিলেন। মস্তান খাঁ চাচা তাকে সদম্ভপ্রকাশে পাকড়াও করে ফেললেন! শুধু কী পাকড়াও, একেবারে যাকে বলে গায়ের জাম্পার সাঁপটে ধরলেন! আমি একটা গাছের ছায়ার সঙ্গে মিশে গিয়ে গাছের আড়াল থেকে সবকিছু চাক্ষুস করছিলাম। মস্তান খাঁ চাচা তো আর কোনোদিন আমার সেই ছোটমামাকে দেখেননি। তিনি মামাকে চোরটোর যা খুশি গাল দিতে লাগলেন। তার হাতে একটা লম্বা ছেনিও থাকত সবসময়। যথারীতি সে-রাতেও সেটা সঙ্গে ছিল। তিনি সেই ছেনিটা মামার চোখের সামনে নাচাতে নাচাতে মামাকে ফরিদপুরের গাছিদের ক্যাম্পই বলি আর ঢ্যারাই বলি, সেখানে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। গাছের ছায়ায় মিশে থাকতে থাকতে আমার মনের মধ্যে চরম অনুশোচনা বোধ কাজ করতে লাগলো। কত বড় অকৃতজ্ঞ আমি। যে ছোট মামা আমাকে চুরি করে বিয়েবাড়ির বিরানি খাইয়ে একটা দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ উপহার দিয়েছেন, আমি কিনা তার বিনিময়ে উনাকে খেজুরের রস চুরি করে খাইয়েতো পারলামই না, উলটো গৃহস্থের কাছে ধরিয়ে দিয়ে উনাকে চোর বানিয়ে দূর থেকে তামাশা দেখছি! যা থাকে কপালে, মস্তান খাঁ চাচা যত ভয়ানক মানুষই হোক, আর তার ছেনিতে যতই ধার থাকুক, বুক ফুলিয়ে তার সামনে দাঁড়াব। আমি দৌড়ে দৌড়ে তাদের দুজনের মাঝখানে হাজির হয়ে বললাম, চাচা উনি আমার মামা হন। আপনি উনাকে ছেড়ে দেন।
চাচা আমার দিকে তাকিয়ে অবাক, তুমি আবার কইত থেইকা আইলা গো?
পালিয়ে যাওয়ার কথা বলতে আমার আত্মসম্মানে কেমন বাধলো। প্রাকৃতিক একটা কর্মের কথা বলে সেই আত্মসম্মানের আবরু রক্ষা করলাম।
তোমরা কি করতাছিলা বাবা? চাচার স্নেহরস চুইয়ে পড়ে। বোঝাই যাচ্ছে ঘটনাটিকে তিনি অন্যদিকে প্রবাহিত করতে চান।
মামাকে খেঁজুরের রস খাইয়াইতে চাইছিলাম। আমি যাহা সত্য তাহাই বলিব, সত্য বই মিথ্য বলিব না তরিকাতেই রয়ে গেলাম।
তা আমাকে বললেই পারতা? চাচার অনুযোগ।
আমি যা সত্য তাই বললাম, বললাম যে, খেঁজুরের রস চুরি করে না খেলে মজা লাগে না চাচা।
আমার কথা শোনে মস্তান খাঁ চাচা খুব আফসোস করেছিলেন, আমগো এত গাছ। চুরি করার কোনোদিন সুযোগই পাইলাম না। তারপর সেই আফসোস ঘোচাতেই যেন গলার সুর পাল্টে ফেললেন, ঠিক আছে, আমি যাই। তুমি তোমার মামারে চুরি কইরা রস খাওয়াও!
না। সেদিন আর খেজুরের রস চুরি করে খাওয়া হয়নি আমাদের। মস্তান খাঁ চাচা কোথ থেকে এসে সব রস ভঙ্গ করে দিয়ে গেলেন। তাকে জানিয়ে খাওয়াটার মধ্যে কি আর সেই চুরি করে খাওয়ার সেই রোমাঞ্চকর মজাটা মিলবে? পরদিন চাচা কাকভোরেই আমাদের বাড়ির জন্য এক কলস রস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গাছি দিয়ে। ঢাকা থেকে আসা আমার খালাম্মারা মন ভরে খেয়েছিলেন সে রস। মামাও খেয়েছিলেন অবশ্য। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, রসের আনন্দটুকু তিনি ষোলআনা পেলেন কিনা!  
নানাবাড়িতে সাতসকালে এই খেঁজুরের রস খাওয়ার কথা কখনো কল্পনাও করা যেত না। খেঁজর গাছই তো নেই সেখানে। তবে সকালবেলার নাস্তাটা ছিল অন্যরকম। আগের দিনের রেখে দেয়া নাকি থেকে যাওয়া, দুটোই হতে পারে, সেই ঠাণ্ডা ভাতের সঙ্গে বাসি তরকারির মন্থনে ভাত খাওয়ায় মিলতো দুর্লভ স্বাদের আনন্দ। সেই ভাতকে বলা হতো করকরা ভাত। বাসি তরকারির সঙ্গে কী যে জমত সে ভাত! মাঝে মধ্যে খানিকটা মুড়িও মেশানো হতো। ঠাণ্ডা ভাত ভাগাড় দিয়ে খাওয়ারও রেওয়াজ ছিল। কখনো পেঁয়াজ-মরিচ-সরিষা তেলের ঢলা দিয়ে আবার কখনো পিয়াজ মরিচের সঙ্গে ডিম ভেঙে তা দিয়ে ভাগাড় দেয়া হতো করকরা ভাত। কী যে অদ্ভুত স্বাদ লাগত খেতে, একমাত্র যারা খেয়েছেন, তারাই বুঝবেন। অন্যদেরকে এর কদর কিছুতেই বোঝানো সম্ভব না। আরেকটা খাবারের প্রচলন ছিল নানাবাড়ির নাস্তায়, যেটা আমার দাদাবাড়িতে কল্পনাও করা যেত না। কাউন চাউল দিয়ে খিঁচুড়ি পাকানো হতো। ঠিক খিচুড়ি না। অনেকটা ক্ষুদের ভাতের মতো। ক্ষুদের ভাত হতো আবার আমার দাদাবাড়িতে। নানাবাড়িতে এটার কোন প্রচলন ছিল না। দাদাবাড়িতে যেদিন ক্ষুদের ভাত রান্না হতো সেদিন যেন একটা উৎসবের আনন্দ বয়ে যেত। চার পাঁচ পদের ভর্তা তৈরি করা হতো ক্ষুদের ভাতের জন্য। মরিচ, কালিজিরা, ধনেপাতা, রসুন আবার কখনো বা দারা পাতা কখনো বা লাউপাতা, খুরকুন পাতারও ভর্তা হতো। তারপর কখনো এক ভর্তা দিয়ে আবার কখনো সব পদের ভর্তা মিশিয়ে যত খুশি চেটকাতে পারো চিটকিয়ে চিটকিয়ে খাওয়া হতো ক্ষুদের ভাত। যাকে বলে একেবারে রসিয়ে খাওয়া। ঝালে হয়তো চোখ দিয়ে পানিও ঝরতো। মনে আছে আমরা তখন কাঁসার থালায় ভাত খেতাম। খাওয়ার পরও সেই কাঁসার থালার মধ্যে লেগে থাকা ক্ষুদের ভাতের অবশিষ্টাংশ চেটে খেতে আমাদের অনেক অনেকক্ষণ লেগে যেত। নানার বাড়িতে অবশ্য কাউন চাউলের খাবারটাও খেতে হতো ভর্তা দিয়ে, ভর্তার সঙ্গে ডিমভাজাও দিত। কিন্তু ক্ষুদের ভাতকে যদি বলি খাঁটি দেশি, তুলনা করলে কাউন চালের বাকা ভাতকে বলতে হবে বিলেতি মেমসাহেব গোছের কিছু! বাকা ভাত ছাড়াও মাঝে মধ্যে নাস্তা হিসেবে দেওয়া হতো ছাতু, কোনদিন চিড়া। তবে সবচেয়ে স্পেশাল ছিল ঘিয়ে ভাজা মোটা পরোটা। ঘিয়ে তো না, ডালডা দিয়ে ভাজা হতো সে পরোটা। যেদিন বাড়িতে মেয়ের জামাইরা থাকতো সেদিনই নানি নাস্তায় পরিবেশন করতেন গরম গরম পরোটা। সঙ্গে ডিমের ঝোল। আহা! কী যে অমৃতের স্বাদ ছিল সেই  মোটা মোটা পরোটাগুলোতে! পরে তো ডালডা নিষিদ্ধই হয়ে গেল, নানি দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাতেন, ঘি দিয়ে পরোটা ভেজে!

চলবে...