আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ১১

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
গাবতলা থেকে আমাদেরকে নিয়ে ছইঅলা নৌকাটি যখন কোপাকান্দির বিল ছাড়িয়ে জেলেপাড়ার পাশ ঘেঁষে নদীতে পড়তো, অমনি দেখো শুশুকের দল শুরু করে দিত ডুব ডুব খেলা। অতলান্ত জল থেকে লাফিয়ে উঠে নিজেকে এক ঝলক দেখিয়েই আবার কোথায় হারিয়ে যেত শুশুকটা। বর্ষার নদী নিম্নাাঞ্চলের সঙ্গে মিলেমিশে বিশালাকার যেন সমুদ্রর রূপ ধারণ করত। তা সত্ত্বেও মাঝি নদী দিয়েই চালাত নৌকা। কোথায় আবার কোন চরায় গিয়ে ঠেকে!
আমাদের এই তুরাগ নদী ছিল চিতল মাছের জন্য বিখ্যাত। বড় বড় সব চিতল মাছ পাওয়া যেত উন্নায়। প্রতি বছর বিশাল একটা চিতল কিনত আব্বা। চিতলের ভাজা পেটির স্বাদ এখনো লেগে আছে জিভে। বড় বড় আইড় বোয়ালও মিলত বেশ। আরও কত বিচিত্র মাছ যে ছিল! ফেউয়া মাছ বলে একটা মাছ ছিল শুধুই ভাজা খাওয়ার জন্য। বাচা মাছ, শিলং মাছ, পোয়া মাছ, কাজলী মাছ, পাবদা, প্রতিটি মাছই স্বাদে-গুণে চেহারায় আলাদা স্বতন্ত্র! গলদা চিংড়ি, পুটি-ট্যাংরাতো ছিলই। আরো অনেক মাছই ছিল, নাম মনে করতে পারছি না, চেহারাও ঝাপসা হয়ে গেছে। এভাবেই চিরকালের মতো হয়তো বিস্মৃত হয়ে যাবে কোনও কোনও মাছ। আমাদের নানা গল্প করে বেড়াতেন, তুরাগ নদীর মাছের আলাদা একটা স্বাদ আছে।

তুরাগ নদী, নদী ছাড়িয়ে বামদিকের আদিগন্ত জলমগ্ন প্রান্তর, ডান পাড়ের কালাকুরসহ গ্রামের দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে কখন যে পৌঁছে যেতাম কড্ডা, বলতে পারব না। মুক্তিযুদ্ধের সময় কড্ডার ব্রিজটা পাকবাহিনীর আগ্রাসন ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর দু’তিন বছরের মধ্যেই সে ব্রিজ অবশ্য পুনঃনির্মাণ করা হয়। ব্রিজ হওয়ার আগপর্যন্ত সময়ে চলাচল করতে হতো ফেরিতে। একবার টঙ্গীতে কোনো এক বাড়িতে আব্বা-মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বিএডিসির এক পরিবারের সঙ্গে মিলে তাদেরই জিপে চড়ে। ওহ! বিএডিসি কী সেটা বোধ হয় একটু ভেঙে বলা দরকার। বিএডিসি হলো বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন। আমাদের কাশিমপুর এক সময় জমিদারি যুগের কারণে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। সে যুগ শেষ হবার পর অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এর ঠিক কেন্দ্রেই বিশাল এলাকা জুড়ে বিএডিসি প্রতিষ্ঠার ফলে এলাকাটি আবার নতুনভাবে চাঙা হয়ে ওঠে। বিএডিসিতে যারা চাকরি করতেন সবাই ছিলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ। তখনকার সময়ে আমাদের এলাকায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা একেবারেই ছিল না বলে আব্বার একটা বিশেষ কদর ছিল। আব্বা ছিলেন এলাকার প্রথম ডিগ্রি পাশ মানুষ। বেশ চোস্ত ইংরেজি বলতেন। একটি মাদ্রাসাকে তিনি হাই স্কুলে রূপান্তরিত করেছিলেন এবং বছরের পর বছর সে স্কুলটি অতি সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করে গেছেন। বিএডিসি-র অনেক কর্মকর্তারাই আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং আব্বার সঙ্গে তাদের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

তো, সেদিন সেরকমেরই এক বন্ধু তার জীপে করে আমাদের পরিবারকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন টঙ্গীতে। সেই বেড়ানোর স্মৃতি বড্ড ঝাপসা আর অস্পষ্ট হয়ে গেছে। একটি বাড়িতে বেড়িয়েছিলাম মনে আছে। অনেক খাওয়াদাওয়া হলো। তারপর একটা সিনেমা হলে যাওয়া হলো, সিনেমা দেখলাম। সেই সিনেমাতে ভয়ংকর সব ব্যাপার ছিল। বাঘ ধরে ধরে মানুষ খাচ্ছিল। আর সব জন্তু জানোয়ার ছিল। টারজান টাইপের কোন ছবি ছিল মনে হয়। আব্বা আমাদেরকে ছোটবেলায় অনেক সিনেমা দেখিয়েছেন। সিনেমা দেখা তার কাছ থেকেই শিখেছি। যা হোক, সে রাতের কথা আর কিসসু মনে নেই, শুধু মনে আছে অনেক রাতে আমাদেরকে সে-ফেরিটা পার হতে হয়েছিল। আমরা যখন নদীর কাছে পৌঁছেছিলাম, ফেরিটা ছিল অন্য পারে। কিছুতেই আর ওটা এ-পারে আসছিল না বা আসতে পারছিল না, ওদিকে রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছিল, আকাশে বুঝি মেঘও ছিল সেদিন। অন্ধকার আকাশ দেখে আমার গা কেমন ছম ছম করে উঠেছিল।  সে-রাতে কেমন যেন লালচে এক রকম আভা ছিল আকাশে। কী যে টেনশন আর উদ্বেগের মধ্যে কেটেছিল সময়টুকু। সেই উদ্বেগটুকুই কেবল স্মৃতি হয়ে আছে। আর সবকিছু ব্ল্যাক আউট। সেদিন আমরা বাড়ি ফিরতে পারব কী পারব না, এমন একটা অনিশ্চয়তার দোলাচল আমাদেরকে তাড়িয়ে ফিরছিল। যা হোক, কড্ডা থেকে আমরা বাসে যেতাম গুলিস্তান। এলেম দ্বারা চোর ধরা হয়। একটা চোরকে বেঁধে হাঁটিয়ে নেয়ার দৃশ্য। বহু বছর পর্যন্ত সাইনবোর্ডটা চোখে পড়েছে ফুলবাড়িয়া বাস স্টেশনে ঢোকার মুখেই। এলেম জিনিসটা তখনো আমার কাছে দুর্বোধ্য ছিল এবং এখনো আমি সে-বিষয়ে অজ্ঞাত। এলেম জিনিসটা আসলে কি? সেটা দিয়ে কীভাবে চোর ধরা হয়, সে প্রশ্নটা কখনো কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, এখনো জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না। অথচ আমি এর মানেও জানি না! অথচ শব্দটা মাথার ভেতর কুট কুট করে মরে। এলেম দ্বারা চোর ধরা হয়! মনের কী যে প্রকৃতি!

গুলিস্তান থেকে কখনো রিক্সা কখনো বা বেবিতে সোয়ারিঘাট পৌঁছালেই মিলে যেত রাজাবাড়ির নৌকা। শ’ শ’ সারিবাঁধা নৌকা থেকে মাঝিরা পাল্লা দিয়ে শুরু করত ডাকাডাকি। এর ভেতর থেকেই রাজাবাড়ির নৌকাকে ভালোভাবেই শনাক্ত করা যেত। মাকে দেখেই এগিয়ে আসতো গ্রামের চেনা কোনো মাঝি। ব্যাগট্যাগ নিজের হাতে নিয়ে নৌকায় রাখত। তারপর সারি বাঁধা নৌকার ভিড় থেকে এ নৌকাকে ঠেলে ও নৌকাকে ধাক্কিয়ে, কারো মাথা অন্য নৌকার গলুইয়ে লাগলো কিনা গা বাঁচিয়ে বেরিয়ে আসতো খোলা নদীতে। সেখানে এসেই মাঝি যেন নতুন করে একটা দম নিতেন। তারপর সজোরে চালাতে শুরু করতেন বৈঠা। কখনো কখনো অল্পবয়সী এক সাগরেদ পেছনের গলুইয়ে বসে উল্টো দিক থেকে বৈঠা বাইত। আমরাও যেন নতুন আনন্দে উজ্জীবিত হতাম। জলে বেজে উঠত ছলাৎ ছলাৎ ছল এক নেশা ধরানো শব্দ। দুলতে দুলতে নৌকা মাঝনদীর দিকে এগোত। ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেত হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি, সোয়ারিঘাট, শহরের সব কোলাহল চিৎকার আর নৌকার দঙ্গল। কখনো ফাগ মাখানো রোদ কখনো বা মেঘের ছায়ায় ছায়ায় নৌকাটা কোনাকোনি ছুটে যেত তির তির করে। মাঝির উদ্দেশ্য নদীর ও-পারের দিকে থাকা। সেটা যে ভালোই হতো আজ বেশ উপলদ্ধি করি, যতই ওপারের দিকে এগোত নৌকা সৌম্য নীরবতার বুক ফুঁড়ে বেজে উঠত পাখির কাকলির মূর্ছনা। এক সময় ঢাকার বিল্ডিংগুলো হয়ে উঠত সব চৌকোনা বাক্স। একটার ওপর আরেকটা বাক্স ঠাসাঠাসি করে রাখা। তারপর সেই বাক্সগুলোও একসময় দৃশ্যপট থেকে ক্রমশ অদৃশ্য হতো। নৌকাটো তখন ঢুকে পড়েছে অফুরান সবুজের এক রাজ্যে! ডানে বামে যেদিকেই তাকাও গাছগাছালি, তারই মাঝে টলটলে বুড়িগঙ্গার জল, মাছরাঙার ওড়াওড়ি। তবে হঠাৎ হঠাৎই চিরে যেত এই সৌম্যতা। কোথা থেকে সিনেমার ভিলেনের মতো বিকট শব্দ তুলে হাজির হতো বড় কোন স্টিমার বা লঞ্চ। আর সবকিছুকে চাপা দিতে দিতে এক সময় ওটা মিলিয়ে যেত আমাদের সামনে থেকে। শুধু কি শব্দ! সেই স্টিমারের ঢেউয়ের ধাক্কায় আমাদের ছোট্ট নৌকাটাও আলোড়িত হতো। প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠত ওটা, নাচত কাঁপত, এমনকি ডুবে যাওয়ার ভয়ও দেখাত।

বুড়িগঙ্গার সঙ্গে এইসব নানান খুনসুটি শেষে একসময় আমাদের ছোট নৌকাটা বরিসুর দিয়ে ঢুকে যেত সরু খালে। খাল তো নয়, যেন এক সুড়ঙ্গপথে ঢুকলাম। দু’পাশে ঘিঞ্জি ঘনবসতি। লতাগুল্মের জঙ্গল। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে টং-এর পায়খানা। জঙ্গলে তেলাকুচা পেকে লাল হয়ে আছে। গণ্ডায় গণ্ডায় পিটকেল ভাসছে পানিতে। মাঝে মধ্যেই কাঁঠের সাঁকো পড়ছে মাথার উপর। সে সাঁকোয় দাঁড়িয়ে গল্প করছে পাড়ার ছেলেরা। তবে দৃশ্যপটে আছে বৈচিত্র্যেরও বাহার। কোথাও বা লতাগুল্মের বদলে খালের কিনার ঘেঁষে এলোমেলো মাথা নুয়ে শুয়ে আছে আখগাছ। আখের পাতার ধার এসে শরীরেও লাগত। কী যে নৈঃশব্দের এক অপূর্ব গান বাজত তখন। বৈঠার একটানা ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মাঝে মধ্যে কোথা থেকে ভেসে আসত কাকের ক্লান্ত স্বর।

চলবে...