আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ১৩

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
জরুন থেকে এনায়েতপুরের মাঝখানে বিশাল যে খোলা প্রান্তর ছিল, যতদূর চোখ যায় কোনো ঘরবাড়ি দেখা যেত না, সেখানে জরুনের শেষপ্রান্তে একটা গাম্বুরি গাছ একা একাই দাঁড়িয়ে থাকত। ও গাছটার কাছ দিয়ে গেলেই বুকের ভেতরটা কেমন ঢিপ ঢিপ করতো আমার। শোনা কথা, এ গাছে নাকি ভূত থাকে। কথাটা কীভাবে রটেছিল জানি না, কিন্তু কথাটার মধ্যে যে একবর্ণও মিথ্যে নেই, নিজের চোখেই একদিন প্রমাণ পেয়ে গেলাম। সে এক চৈত্র্যের দিন, যখন প্রচণ্ড রোদের তাপে খা খা করছিল চরাচর, শূন্যতা যেন ধোঁয়ার মতো দৌড়ে ছোটে, তেমনই একদিনে একটা অদ্ভূতুড়ে পাখি সেই গাম্বুরি গাছের মগডালে ডানা গুটিয়ে বসেছিল। ওটার বিশাল নাকটা থ্যাবড়ানো, গোল দুটো চোখ অস্বাভাবিক রকমের বড়, দেখতেও সেটা বেশ ডাগরডোগর। কার্টুন টাইপের শরীর। কেমন মানুষের মতো জীবন্ত একটা ভাব প্রকাশ করে আমার দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। যেন কোনও মস্ত পণ্ডিত, চোখমুখ খিচিয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করছে। ভয়ে আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছিল, শরীর কাঁপছিল থরথরিয়ে। দৌড় যে দেব, সে ক্ষমতাও লোপ পেয়েছিল। কোনোমতো পা দুটো জোর করে ফেলে গাম্বুরি গাছটার সীমানা পেরিয়েছিলাম। এরপর চিকন বাতরের মধ্যেই ভো দৌড় দিয়ে কোনোমতে নিজের জীবন রক্ষা!

তিনটা কী সাড়ে তিনটার দিকে স্কুল থেকে ফেরার পথে আমি আর একা ছিলাম না। আমার সঙ্গে ছিল গ্রামের আরও চার পাঁচটা ছেলেমেয়ে। ভূতের গল্পটা স্কুলের বন্ধুদের কাছে বেশ রসিয়ে রসিয়েই করেছিলাম। আর কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম যে, বন্ধুদের মধ্যে কেবল আমি একাই সত্যি সত্যি ভূত দেখার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি! কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একটু বুঝিবা বাড়িয়েও বলেছিলাম কোনোকিছু। যা হোক, স্কুল থেকে ফেরার পথেও দেখলাম ভূতটা গাম্বুরি গাছের সেই মগডালে একই ভঙ্গিতে বসে আছে। আমি যে মিথ্যে বলিনি, বন্ধুদের কাছে প্রমাণ করার এরচে বড় সুযোগ আর কী আছে, তবে আমার কৃতিত্বে ওরাও ভাগ বসাচ্ছে দেখে গৌরব হারানোর একটা চিনচিনে ব্যথাও হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও আমি ওদেরকে ফিসফিস করে গাম্বুরি গাছের দিকে তাকাতে বললাম। ওরাও চরম উত্তেজনা নিয়ে সেদিকে তাকাল এবং নিমিষেই ভূত দেখার সমস্ত কৃতিত্ব আমার ধুলোয় ভূলুণ্ঠিত হলো। আরে এটাতো হুঁতোম প্যাঁচা। একজন বেশ রাগ করেই জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল! দুর্দান্ত একটা থ্রিল এভাবে নষ্ট করে দেয়ার জন্য হুঁতোম প্যাঁচাটার ওপর সেদিন ভারী রাগ হয়েছিল আমার।

বলছিলাম ঝড়ের কথা! সেই ঝড়ের কথা বলতে গিয়ে কত ঘোরপথে ঘোরা। সে-কথাটিই এবার বলে ফেলি। স্কুল থেকে ফিরবার পথে একবার ঝড় তো ঝড়, হাতির শুঁড়ও দেখেছিলাম। হ্যাঁ, তখন হাতির শুঁড় নামবারও একটা ব্যাপার ছিল। চৈত্র্যের শেষপ্রান্ত থেকে আষাঢ়ের শুরু পর্যন্ত সময়টাতে সাধারণত ঘটতো এ ঘটনাটা। আকাশ যখন কালো মেঘে রুদ্র রূপ ধারণ করতো, যখন বিশেষ একদিক থেকে নেমে আসতো কালো মেঘের থাবা, এবং সেটা চক্রাকারে নিচের দিকে নামতে নামতে ঘুরে ঘুরে এগিয়ে আসতো গ্রামের দিকে, তখনই গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে সবাই থালাবাসন বাজিয়ে বাজিয়ে হাতির শুঁড় নামছে হাতির শুঁড় নামছে বলে আতংকের চিৎকার জুড়ে দিত। কেউ কেউ জোরে জোরে কলেমা পড়া শুরু করতো। কেউ দিত আজান। গ্রামবাসীর বিশ্বাস ছিল, এইভাবে তারা হাতির শুঁড় নামানো প্রতিহত করতে পারবে বা বদলে দিতে পারবে সেই প্রচণ্ড ঝড়ের গতিপথ। তা না হলে যে আর কিছুতেই রক্ষা পাওয়া যাবে না। কী যে ভয়াবহ ছিল সেই ঝড়ের তাণ্ডব। যেদিক দিয়ে যেত, সে-পথের সবকিছুই প্রায় লণ্ডভণ্ড করে যেত, গুড়িয়ে দিত সবকিছু ধ্বংসের মাতম তুলে।

স্কুল থেকে সেদিন আমি আকাশে কালো মেঘ নিয়েই রওনা দিয়েছিলাম বাড়ির পথে। হাতীমারা-কাশিমপুর কাঁচা রাস্তার (এখন অবশ্য পাকা হয়ে গেছে) যেখান থেকে বারেন্ডা গ্রামের শুরু, তার উল্টোদিক থেকেই আমরা নেমে যেতাম বাতরে। এরপর থেকে পুরো রাস্তাটাই আমাদেরকে যেতে হতো বাতরপথে। বাতর মানে ক্ষেতের আইল। যে আইল এক ক্ষেত থেকে আরেক ক্ষেতের মাঝখানের সীমানা নির্ধারণ করত। এসব বাতর ক্ষেত থেকে বেশ উঁচু করে নির্মিত হতো, সেই সঙ্গে থাকত পেটানো। ফলে রাস্তা হিসেবেও ব্যবহার হতো ভালোভাবেই। তো, সেই বাতরপথে আমি যখন কেবল হাতীমারা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে এনায়েতপুর গ্রামের প্রান্তে ঢুকে পড়েছি, তখনই হঠাৎ সামনের আকাশের দিকে তাকিয়ে পিলে চমকে উঠলো! কী বীভৎস কালো হয়ে আছে আকাশটা পিচাশের মতো। এমন কুচকুচে কালো আকাশ আমি আর কখনোই দেখিনি। আর সেই কালোর ভেতর থেকে যেন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অনেকটা হাতির শুঁড়েরই আকৃতি নিয়ে জান্তব একটা কিছু নেমে আসছে মাটির পৃথিবীতে! আর সেটা যেন প্রচণ্ড এক প্রলয়কাণ্ড ঘটাতে ঘটাতে ধেয়ে আসছে আমাদেরই গ্রামের দিকে! মনে হচ্ছে পুরো আকাশটাই যেন ধসে পড়ছে। তারপরই হঠাৎ দমকা বাতাস বইতে লাগলো। যথারীতি শুরু হলো গ্রামবাসীর চিৎকার, কলেমা পড়া, থালাবাসনের ঠনঠনানি। মুহূর্তেই ধুলোর ঘূর্ণিতে ছেয়ে গেল চারপাশ। জগতের কিছুই আর দেখা যায় না। আমি দৌড়ে দৌড়ে পাশের একটা বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। তারপর একটু পরেই যখন বাতাসের ঝাপটা কমে এলো, শান্ত হলো প্রকৃতি, আমি আবারো দৌড়ে দৌড়ে ছুটতে লাগলাম আমাদের বাড়ির পথে! কে জানে, কী অবস্থা হয়েছে গ্রামের! কিছু যে একটা আজ ঘটে গেছে, তাতে যেন কোনই সন্দেহ নেই।

গ্রামে ফিরে অবশ্য স্বস্তিই পেলাম। না, তেমন কোন ভয়ানক কাণ্ড ঘটেনি এবারকার মতো। আমি এনায়েতপুরে যে অবস্থায় ছিলাম এখানেও ঠিক তেমনই ঘটেছে। যৎসামান্য ঝড়োবাতাস বয়ে গেছে, ধুলোবালি উড়েছে, এই যা। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায়ই খবর এলো বোর্ডবাজারের কয়েকটা এলাকা প্রচণ্ড সাইক্লোনে বিধস্ত! মানুষও নাকি মারা গেছে দশবারোজন। পরের দিনের খবরের কাগজেও লিড নিউজ হিসেবেই ছাপা হয়েছিল খবরটা। এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের এলাকায় নাকি আগে কখনো হয়নি। এক এলাকার টিনের চাল দলামোচড়া হয়ে উপড়ে পড়েছিল আরেক এলাকায়। বেশ কয়েকটা বিল্ডিং ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়েছিল। পরদিন মানুষের পর মানুষের ঢল নেমেছিল ঝড়ের সেই তাণ্ডবলীলা দেখতে। বাড়িঘর, দোকানপাট, মিলইন্ডাস্ট্রি কোনোকিছুই রক্ষা পায়নি সেই প্রমত্ত ধ্বংসযজ্ঞ থেকে। মাসখানেক পর আমি যখন ঢাকা যাই, বাস থেকেও চোখে পড়েছিল বোর্ডবাজারের এই সাইক্লোনের ধ্বংসচিহ্ন। এর বছরখানেক আগে বা পরে ধামরাইয়ের কী যেন নাম জায়গাটার, বোধ হয় সাটুরিয়া, সেখানেও প্রায় পুরো একটা গ্রাম হঠাৎ টর্নেডোর আস্ফালনে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল। মানুষও মরেছিল অনেক। তখন বৈশাখী মৌসুম এলেই আমাদের দাদাবাড়ির মানুষগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকবছর হাতীর শুঁড়ের আতংক প্রবলভাবে কাজ করেছে।

আমি আগেই বলেছি, নানাবাড়ি যেতে কখনোই আমাদেরকে ঝড়ের মুখোমুখি হতে হয়নি; যেদিন আকাশ কালোদিনে বকদের ওড়াওড়ি দেখে মা বলেছিল ঝড় আসবে, না, সেদিনও ঝড় আসেনি। তবে সেদিন বকদের পাখনার সঙ্গে উড়ে যেতে যেতে হঠাৎ আমার চোখ আটকে গিয়েছিল প্রাচীন এক মঠে। জলমগ্ন শূন্য প্রান্তরে একা একা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে শুধু মঠটা। একা এবং চরম নিষ্ঠুরের মতো একা। একটু দূরেই দু’তিনটা পাকুড় গাছ, কয়েকটা বিষণ্ন ভাঙাবাড়ি। ডাহুকের ডাক আসছিল কোথা থেকে। পাখিরাও তাহলে এভাবে কালের জলছবিতে এচিং মেরে যায়! রেখে যায় স্মৃতির ছোপ! হ্যাঁ, বড়ই রমণীয় ছিল সেই যাত্রাপথ, সব সময়ই ছিল মাছরাঙাদের ভুবনডাঙা। কত রঙের মাছরাঙা যে দেখা হয়েছে। গাছের ডালে নয় যেন ইজেলে ইজেলে বসে থাকত এক একটা। আকাশে নয় যেন কোন বিশাল ক্যানভাসে কোনো শিল্পের তুলির নির্দেশে নির্দেশে উড়তে উড়তে উড়তে উড়তে উড়তে এক সময় হয়ে যেত শুধুই বিন্দু!

 

চলবে...