আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ১৬

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি

রূপকথার বইয়ের বাইরে কোনো দৈব ইশারায় আমার প্রথম পড়া হয়ে যায় বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাস। তারপর ছবিওয়ালা বইয়ের বন্ধন থেকে মুক্তি মিলল আমার! ছবিছাড়া বইতে যে আরো বড় পৃথিবী আরো বড় কল্পনার জগত! আমি আবার ট্রাঙ্কটা খুলে লুকিয়ে লুকিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুঁজে বেড়াই। হ্যাঁ, পেয়েও যাই, অপরাজিত। পথের পাঁচালীরই দ্বিতীয় খণ্ড। ওটাও গোগ্রাসে পড়ে ফেলি। পড়তে পড়তে উপন্যাসের প্রতি বিমুগ্ধতা ও টান উভয়ই বেড়ে গেল রাতারাতি। উপন্যাস এবং উপন্যাসই হয়ে উঠলো আমার নেশা, চৌম্বকীয় আকর্ষণ! বিভূতিভূষণকে পাই না বটে, কিন্তু শরৎচন্দ্র আমার মন দখল করে ফেলে! না, শরৎজগতে ঢোকার আগেই পড়া হয়ে যায় খড়কুটো। যেহেতু ওটা বাইরেই ছিল মাটির আলমিরায়। যেহেতু ওটার প্রথম প্যারা দেওয়ালির বাজি পোড়ানোর বর্ণনা পড়েই আমি বিমুগ্ধ, তখন সেটার পড়া অব্যাহত থাকে এবং আমার সত্তা এক নতুন উত্তেজনায় মোচড় খায়। জীবন সম্পর্কে সেই বুঝি হোক না কাঁচা হোক না কৈশোরমগ্নতা, একটা বোধ আমার মানসলোকে তৈরি হয়। আমি ভ্রমরের মতো একটা মেয়েটি খুঁজি। যে বলেছিল, মানুষ বড় নিষ্ঠুর, ভালোবাসতে জানে না। আমি ভ্রমরের সে-কথার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করি। আমি অনুভব করি মৃত্যুকে। পথের পাঁচালীর দূর্গার মৃত্যু ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়েছিল। খড়কুটোয় এসে আবার আমি মৃত্যুর অভিজ্ঞান লাভ করে। ভ্রমরের মুত্যুকে আমি অনেক অনেকদিন মেনে নিতে পারিনি। এমনকি গুমরে গুমরে আমার কান্না পেয়েছে, অমলের মতোই যেন অনেকটা। সে কান্না কি আসলে অমলের হয়ে ভ্রমরের জন্য, নাকি আমারই সব অচরিতার্থতা, আশেপাশের পরিবেশ থেকে জারিত জীবনের কঠিন সব চাবুকের আঘাতের জর্জর, বোধ হয় সেটাই।

যা হোক, আমি বলছিলাম পড়ার কথা। মাটির দেয়ালের আলমারিতে শরৎ তো ছিলই, ট্রাঙ্কের ভেতরও শরৎয়ের যেন বিপুল খনি পেয়ে গেলাম। প্রায় সবই চটি সাইজের। রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে, বড়দিদি, মেজদিদি, বিপ্রদাস, দেবদাস, পরিণীতা- আরো যেন কী কী। ভুলে গেলাম দেখছি। তবে ঢাউস সাইজেরও আছে বেশ ক’টা। দত্তা, গৃহদাহ, শেষপ্রশ্ন, শ্রীকান্ত তিন খণ্ড। সব বইয়ের প্রচ্ছদ একই রকম। এক কালারের। উপরের দিকে বই আর লেখকের নাম। মাঝখানে গোল বর্ডারে শরতের প্রোফাইল ভঙ্গির ছবি। শরৎচন্দ্রের নামটা কি তার স্বাক্ষরযুক্ত থাকত? মনে হয়। পড়তো পড় মালির ঘাড়েই, প্রথম বইটাই ছিল রামের সুমতি! একজন লেখক এভাবে কাঁদাতে পারেন? পড়তে পড়তে সেকি কান্না আমার! ভ্রমর সত্যিই বলেছিল, ‘মানুষ খুব নিষ্ঠুর। ভালোবাসতে জানে না।’ একজন শিশুর প্রতি বড়দের আচরণ এত অমানবিক কীভাবে হতে পারে? একজন কোমল চেহারার শিশু, যার নিষ্পাপ মুখচ্ছবি, যে এখনো অবুঝ, তার গালে কীভাবে কঠিন হাতের থাপ্পড় পড়ে, তার নরম চুলে কীভাবে টান পড়ে রাগী এক কঠিন হাতের? কীভাবে পারে পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ তার শরীরে লাথি তুলতে? কীভাবে সম্ভব রুক্ষ কঠিন গালি আর বিদ্রুপে শিশুর সেই কোমল শৈশবকে দুমড়ে মুচড়ে এলোমেলো করে দিতে?

এমন একজন মানবদরদী লেখক আর একজনও জন্মায়নি। এখনো এবং তখনো। আমি শরৎচন্দ্রকে বুকের গহীনে তুলে নিই। তারপর গোগ্রাসে পড়ে ফেলি তার প্রায় সব উপন্যাস। এমনকি দত্তা এবং গৃহদাহ-র মতো পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য লেখা উপন্যাস পর্যন্ত! শ্রীকান্ত তিন খণ্ড ছিল! কী যে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল শ্রীকান্ত-র প্রথম খণ্ড! কত যে গল্পের পর গল্প রয়েছে বইটাতে, কত যে জীবনের গোপন বিস্তার, দার্শনিক অনুসন্ধিৎসু বর্ণনা, ইন্দ্রনাথ-অন্নদাদি-গহর কবি! কোন এক জগতে আমাকে নিয়ে যেত। রাজলক্ষ্মী এখনো আমার কাছে এক মহিমান্বিত নারী। শ্রীকান্ত-র জগৎ আমাকে এতটাই মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল যে, আমি বাস্তবেও সেই গ্রাম, সেই জায়গা পরিবেশ এবং মানুষগুলোকে খুঁজে বেড়াতাম। আমাদের দাদাবাড়ি জেলেপাড়া পেরিয়ে তুরাগ নদী পার হলেই ওপারের ঘন গাছপালা ছায়াঘেরা পথটিতে গেলেই মনে হতো, আমি বুঝি শরৎচন্দ্রের মামাবাড়ি সেই ভাগলপুরে এসেছি! ঘন গাছপালার ছায়ায় পথ, পথের পাশেই সেই রকম বর্ণনারই বাড়ি। কাশিমপুরের হিন্দুপাড়ার অনেকের চেহারার দিকে তাকালেই মনে হতো ও বুঝি ইন্দ্রনাথ! শরৎ পড়ে পড়েই সনাতন ধর্মের মানুষের প্রতি আমার অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম হয়। মনে হতে থাকে, তারা একটু সংস্কৃতিজীবী, গানমুগ্ধ, শিল্পসাথি এবং ধীরে ধীরে যখন আমি বড় হই, বেড়ে উঠি, আমি উপলদ্ধি করতে থাকি, আমার ধারণাই সত্য। তবে আমি যেমন শৈশব থেকে অদ্যবধি কারোর সঙ্গেই গভীরভাবে মিশতে পারিনি, নিজের মুদ্রাদোষে একা একা হতেছি  আলাদা, কাশিমপুরের কোনো সনাতনধর্মী মানুষের সঙ্গেও আমার সখ্য বা বন্ধুতা গড়ে ওঠেনি। তবে সুভাষ স্যারের স্নেহে আমি বিশেষভাবেই পেয়েছি, এবং আমি যখন কৈশোর ছেড়ে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে প্রবেশ করি, তখন স্যারের কাছ থেকে নিমাই ভট্টাচার্যের বইগুলো একে একে প্রায় সবই পড়ার সুযোগ পাই। গোধুলিয়া, মেমসাহেব এসব। নিমাই ভট্টাচার্য্য, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। না, থাক এসব বইয়ের কথা, এখনই নয়। সেসব আসবে জীবনের আরেক অধ্যায়ে।

আগে থেকেই বইয়ের কীট ছিলাম, শরৎ পড়তে পড়তে হয়ে উঠলাম পুরোদস্তর বইপোকা! মা আর বাঁধা দেন না। শরতের পরই ট্রাঙ্কের সেই ভুবনের আধিপত্য ছিল নীহাররঞ্জন গুপ্তের। তার হাসপাতাল উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সামাজিক উপন্যাসের পাশাপাশি তার কিরীটী অমনিবাসও পেয়ে যাই। মোহাবিষ্ট করে রাখে এ সিরিজের ময়ূরমহল আর অপরিচিত উপন্যাসটি। রহস্য উপন্যাসে জায়গার এমন সুন্দর বর্ণনা আমি প্রথম নীহাররঞ্জনেই আবিষ্কার করি। সেই বর্ণনার স্বাদ আজো আমার স্মৃতিজুড়ে রয়ে গেছে। এছাড়া ছিল রবীন্দ্রনাথের তিন চারটে উপন্যাস- যোগাযোগ, নৌকাডুবি, শেষের কবিতা। তখন সেই কচি লেবুপাতার ঘ্রাণসিক্ত শৈশবে শেষের কবিতাটাই শুধু রসিয়ে রসিয়ে পড়তে পেরেছিলাম। অন্য দুটো উপন্যাস আমার এখনো পড়া হয়নি। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ার সময়েও পড়া হয়নি। রবীন্দ্র উপন্যাস আমার সিলেবাসে থাকা সত্ত্বেও পড়া হয়নি। ফটোকপির মাধ্যমে ক্লাসবন্ধুদের কাছ থেকে নোট এনে তা মুখস্থ করে করে পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। কেন পড়তে পারিনি, তার কোনও সদুত্তর আমি দিতে পারব না। তবে শেষের কবিতা একবার নয়, তিন চারবার পড়া হয়েছে। ও উপন্যাসটি পড়েই শিলংয়ের প্রতি আমার অনুরাগ জন্মায়। এবং আমি সেই অনুপ্রেরণা থেকেই মূলত পরবর্তী জীবনে শিলং থেকে বেড়িয়ে আসি।

আমেরিকার চেয়ে রুশ সাংস্কৃতিক অগ্রাসন যে শক্তিশালী ছিল, তার বড় প্রমাণ আব্বার ট্রাঙ্কটা। বেশ কয়েকটি রুশ বাংলা উপন্যাস থাকলেও আমেরিকা বা পশ্চিমা লবির কোনও বইয়ের অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। না, ছিল। ও হেনরির একটি মূল ইংরেজি উপন্যাস ছিল। মনে থাকার কারণটি হলো, প্রচ্ছদে প্রায় অর্ধ নগ্ন নারীর একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনের দৃশ্য ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে যে, ছবিটা এই কিশোরটিকে বিভ্রান্ত করেছিল। সেই ট্রাঙ্কের মধ্যে ছিল ম্যাক্সিম গোর্কির মা। তখনো আমি রুশ বিপ্লব, কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র এসব বিষয়ে কোনো কিছুই জানি না। সেই ইতিহাস না জেনেই ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটা পড়ে ফেলি। পড়ে রুশ জাতটার প্রতিই আমার এক ধরনের সমীহ এবং শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে। শ্রমিকদের কী দুবির্ষহ সংগ্রাম, সাধারণ মানুষের ওপর কী নিষ্ঠুর বর্বরতা। তারপর কীভাবে কীভাবে বিদ্রোহ দানা বাঁধে, কীভাবে মা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন, পাভেলের ঋজু এবং বলিষ্ঠ চরিত্র, এমনকি মদখোর বাবার ওপরও যে হাতুড়ি তুলে ধরে, আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। আমি মুগ্ধ হয়ে পাঠ করি নাতাশাকে। কী নির্মোহ চরিত্রের এক নারী। কঠিন সত্তার আড়ালে যে ঢাকা রাখতে চায় নিজের মানবিক সত্তাকে, তবুও পাভেলের  প্রতি যার প্রেম অন্তত পাঠকের চোখ এড়ায় না। নাতাশা, নাতাশার  মতো সংগ্রামী আরো কজন নারীর পরিচয় জেনে, তাবৎ পৃথিবীর নারীদের চেয়েই সোভিয়েত নারীদেরকে আমার বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মনে হয়েছিল। তাই আজ যখন দেখি আইপিএল নাচনেওয়ালীগুলো হয় সব রাশিয়ান মেয়ে, মুম্বাইয়ের নায়িকাদের পেছনে যখন দেখি সব এক্সট্রা মেয়েগুলো রাশিয়ান, ব্যাংককের ওয়াকিং স্ট্রিটসহ পৃথিবীর যাবতীয় বিখ্যাত সব বেথেলহামগুলোতে যখন শুনি রাশিয়ান মেয়েদের ভিড়, তখন আপন প্রেমিকার অন্যের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যেমন বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা লাগে, আমার মনের মধ্যেও তেমনি জর্জর উপস্থিত হয়।

 

চলবে...