আমার ভ্রমণিয়া দিন

পর্ব ২২

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৯, ২০১৮

দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
এই নানাবাড়ির ভ্রমণ পথই যেন আমার পঞ্চ-ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে দিয়েছিল, সক্রিয় এবং ক্রিয়াশীলও। আমার চোখ যেমন অনেক রঙিন সবুজশ্যামল জগত স্পর্শ করতে পেরেছে প্রথমবারের মতো, আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ও তেমন পাখির ডাক, হাওয়ার গান, ঝিঁঝি পোকার স্বর কিংবা জল প্রবাহের শব্দে শব্দে নিসর্গের কাছ থেকে লাভ করেছে নতুন নতুন অভিজ্ঞান। একইভাবে আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ও পৃথিবীর ঘ্রাণে বিমুগ্ধ হওয়ার অনুভব অর্জন করতে শিখেছে। নানাবাড়ি যাওয়ার পথেই আমি পাট জাগ দেয়ার গন্ধ প্রথমবারের মতো আস্বাদন করি। সে-ঘ্রাণ আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢুকে যায়। নিজের অজান্তেই কখন যে প্রিয় হয়ে ওঠে, ভালো লাগে আমি বলতে পারব না।

পাট জাগ দেয়ার ঘ্রাণ কি কারোর প্রিয় হতে পারে? হ্যাঁ, হতে পারে। আর কারোর হয়েছে কীনা, জানি না। আমার হয়েছে। শুধু কি প্রিয়? ভীষণ প্রিয়। সে ঘ্রাণটা পেলেই আমি থমকে দাঁড়াই। মনে মনে আমি আমার ভেতরে নিতে থাকি, একেবারে যাকে বলে নিমজ্জিত হয়ে যাই, হারাই, আস্বাদ ভোগ করি। কীভাবে যে এই ঘ্রাণ আমার চেতনাকে বিবশ করে ফেলল, সে বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেয়ার ক্ষমতাও আমার নেই। তবে মনে আছে, বর্ষায় নৌকায় যেতে যেতে অথবা কখনো হেঁটে যাওয়ার পথে হঠাৎই ভেসে আসা সে ঘ্রাণ আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করে ফেলত। আমি মন্ত্রমুগ্ধ চোখে পানির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তিন-চারজন মানুষ হাঁটু-পানিতে দাঁড়িয়ে ভেজা শলা থেকে পাট ছাড়িয়ে নিচ্ছে কী একাগ্র ধ্যানে! অন্যকোনো দিকে তাকাবার যেন ফুরসৎ নেই কারো। পাটের সেই জাগ দেয়ার ঘ্রাণ নিশ্চয়ই তাদের কাছেও সহনশীল ছিল এবং আমার মতোই প্রিয় হয়ে উঠেছিল! তা না হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা জাগ দেয়া পাট এতটা গভীর মনোযোগ দিয়ে কীভাবে ছাড়াতেন?

আরেকটা ঘ্রাণও আমাকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সেটা হলো আটাকলের ঘ্রাণ। আমি গুলিস্তানে বাস থেকে নেমে যখনই সোয়ারিঘাটের রিক্সায় উঠে বসতাম, তখনই আটাকলের ঘ্রাণের জন্য যেন ভেতরে ভেতরে উন্মুখ প্রতীক্ষা অনুভব করতাম। বিশেষত বর্ষার বাইরের দিনগুলিতে, যখন বুড়িগঙ্গা পার হয়ে নৌকা থেকে জিনজিরায় নামতে হতো। মনে আছে, আসা-যাওয়ার পথে নৌকায় নয়, সেই ঘাটে আমাদেরকে খুচরো পয়সা দিতে হতো নৌকার ভাড়া হিসেবে। তিনচার জন লোক নদী থেকে উপরে যাওয়ার পথে ঢালুতে বাঁশের মাচা বানিয়ে তাতে পা জোড়াসীন করে বসে থাকত। সামনে পয়সা মেলানো। তাদের পোশাক যেমনই থাক না কেন, কাঁধে অনিবার্যভাবেই থাকত গামছা।

পয়সা দেয়ার সে-পাট চুকিয়ে নিচু পার থেকে উপরে উঠতেই, নাকে এসে ধ্ক করে ধাক্কা দিত আটাকলের সুতীব্র ঘ্রাণ। মস্তিষ্ককে পুরোটাই অধিকার করে রাখতো অনেক অনেকক্ষণ। যখনই ও জায়গাটায় পৌঁছাতাম, আপন মনেই আমি দাঁড়িয়ে পড়তাম। মা হয়তো চলে যাচ্ছে নিজের গতিতে, ভাইবোনরাও হাঁটছে তার সঙ্গে আপন ছন্দে। মাঝখান থেকে আমারই কেবল গোপন এক অভিসন্ধি। যেন পথই হাঁটছি এমন ছলে থমকে দাঁড়িয়ে ডুবে থাকতাম আটাকলের সেই ভ্রমণিয়া গন্ধে। ডুবে আছিতো আছিই, যতক্ষণ না পিছন ফিরে তাকাচ্ছে মা, যতক্ষণ না ভাইবোনরা এসে ওদের কোমল হাতে না টানাটানি করছে, ততক্ষণই চলতো নিজের সঙ্গে নিজের এই অদ্ভুত ঘ্রাণ-পানে নিমজ্জমান থাকা। কখনো মা কিংবা ভাইবোন ওরা হয়তো খেয়ালও করছে না, সামনের বাঁকটা ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেছে, তখনই হয়তো আমার হুঁশ হলো, আরে! ওরা কি চলে গেল নাকি? আমি নিজেকে তখন আবিষ্কার করতাম একা, সম্পূর্ণ একা! আমার ভয় লাগত, ভীষণ ভয়! তবু ঘ্রাণটাকে ছাড়তাম না, নিজের ভেতর আঁকড়ে নিয়েই পড়িমরি দৌড়ে বেড়াতাম ওদেরকে ধরবার জন্য!

এ দুটি ঘ্রাণে আমার নেশাসক্তি কাজ করলেও, আজো যখন শীতের মৌসুমে কোনো মাঠ পেরোই, আরেকটি ঘ্রাণে নিজের অজান্তেই থমকে দাঁড়াই। যেখানে সরিষা ক্ষেত আছে, পাশেই হয়তো কলুইয়ের ক্ষেত, পেঁয়াজ বা রসুনের ক্ষেত, দূর্বাঘাস- সেই উপচানো সবুজের গাঢ়তা থেকে অদ্ভুত সতেজ এক ঘ্রাণ বেরিয়ে আসে। মনকে যেন নিমিষেই ধুয়ে দেয়, কোনো এক দূর পৃথিবীর গন্ধে ভরিয়ে তোলে আকুলতা জড়ানো ভালো লাগার তীব্র বোধে। আমি জানি, এ-ঘ্রাণও আমার শৈশব থেকে পাওয়া, যা আমার হাফপ্যান্ট পরা ছোটবেলা দিয়েছে এবং আমাকে মোহিত করে রাখে, আচ্ছন্ন করে রাখে বিভোর করে রাখে অনেক অনেকক্ষণ ধরে, অনেকদিন জুড়ে।

পাকা ধানের ঘ্রাণে আমার নেশাসক্তি হতে পারত! সরিষার ঘ্রাণেও আমার নেশাসক্তি হতে পারত! কিন্তু তা হয়নি, হয়েছে পাট জাগার ঘ্রাণে আটাকলের ঘ্রাণে। অথচ ধানের সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা আরো আগ থেকেই যতটা গভীর ততটাই সুনিবিড়। সরিষার সঙ্গেও তাই। আমার জন্মের আগ থেকেই ধান, প্রতি বছর অন্তত দু’বার তো হবেই- সত্যিই কি তাই, ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে ক’বার ধানচাষ হতো আমাদের দাদাবাড়ির গ্রামে? আমার জানা নেই। তবে একাধিকবার যে হতো, সন্দেহ নেই। জন্মের পর থেকে যখন চোখমুখ ফুটতে থাকল, তখন থেকেই দেখেছি, গরুর গাড়ি মোষের গাড়ি ভরে ধান আসতো বাড়িতে। কী সুন্দর গুছিয়ে আঁটি বেঁধে যে নিয়ে আসা হতো ধানগাছ। প্রতিটি আঁটিই সমান মাপের। গরুর গাড়ি থেকে নামিয়ে সেই ধানের আঁটি অতি শিল্পীতভাবে একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা হতো। তারপর বিকেলবেলা চার পাঁচজন কামলা মিলে স্টিলের ড্রামে অথবা গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো খাটিয়ার মধ্যে ধানের আঁটিগুলো আছড়িয়ে আছড়িয়ে খড় থেকে ধান ছাড়াত।

ধান ছাড়াতে ছাড়াতে রাত হয়ে যেত। হারিকেনের আলোয় সেই ধান ঠেকি দিয়ে পাল্লায় ওজন করা হতো। এক ঠেকি থেকে তৈরি হতো আরেক ঠেকি, সেই নতুন ঠেকির ধান ডিশে ডিশে তুলে ভেতরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হতো বা ছালার পর ছালায় ভরে রেখে তারপর নেয়া হতো ঘরে। ধান যিনি মাপতেন, তিনি যেন নিজের কোনো এক সুরের ভেতর হারিয়ে যেতেন- এক অক্কে এক, দুই অক্কে দুই, তিন অক্কে তিন... ধান মাপার সুর সহজে তার থামতেই চাইত না। ধান মাড়াইয়ের সব কাজ কামলারা করলেও মাপার কাজটা করতো বাড়িরই কোনো লোক বা পাশের বাড়ির মুরুব্বি গোছের কেউ। এক জায়গায় স্থির হাঁটু মুড়ে বসে পাঁচ সেরি পাথর দিয়ে এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা ধরে ধান মাপার কাজটা কষ্টকর হলেও, সে কষ্ট কখনো তিনি টের পেতেন কিনা সন্দেহ! ধানের সোনালি সতেজতার যেন কী এক শক্তি আছে!

এই কামলাদের কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়। ধান বোনা এবং ধান কাটার মৌসুম এলেই যেন কোথ থেকে না কোথ থেকে- বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ এবং ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা দল বেঁধে আমাদের গ্রামে হাজির হতো। তারা যেমন বাড়ি বাড়ি খোঁজ করতো কামলা লাগবে কিনা, যাদের কামলার প্রয়োজন তারাও পথের দিকে তাকিয়ে থাকত। তারপর কত করে রোজ হিসেবে কাজ করবে তা নিয়ে একটা ছোটখাটো টাইপের দরাদরি হতো। সে নিয়ে অনেক নাটক। কখনো বা বনলো না ভাব দেখিয়ে বাড়ির খলা থেকে চলে গেল রাস্তা পর্যন্ত, গিয়ে আবার কামলারা নিজেরাই সে দামে বশ্যতা স্বীকার করে ফিরে আসতো মেজো চাচার কাছে। কখনো বা কামলারা ফিরে আসতো না, তারা মেইন রাস্তায় গিয়েও হন হন করে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে দেখে মেজো চাচা দ্রুত একটু এগিয়ে গিয়ে তার নিম্নমুখি কণ্ঠতেই জোরে চেঁচিয়ে উঠতো, অই মিয়ারা। খাড়াও! আহো! মিয়ারা যতই দ্রুত চলে যাওয়ার ভান করুক না কেনো, কান যেন পেছনের এই ডাকটার জন্যই পাতা থাকত! ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগত না।

চলবে