আর্ট এবং আর্টিস্ট কথন

ফ্রি থিংকিং ২

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০১৮

আর্ট নিয়ে গতপর্বে কথা হচ্ছিল আর্টিস্ট সর্বভূক হয়। নিজের আকৃতি তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে দেন। এখন আর্টের ক্ষেত্রে আর্টিস্ট কতটুকু স্বাধীনতা পান সেটাও বিবেচ্য। আমরা যে ধরণের ইন্ড্রাস্টি গড়ে তুলেছি, মানে এই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় আসলে চক্রাকারে চেইন-সিস্টেমে আর্ট বিক্রি হচ্ছে। লোকাল থেকে গ্লোবালি কোথাও আর্টিস্ট আসলে একেবারেই ইন্ডিপেন্ডেন্ট না হলে কারো না কারো কাছে নিয়ম মেনে অনুগত থাকেন। যার প্রভাব থাকে তার কাজে। নিজের কাজ বেচতে তাকে মাস-কালচার ফলো করতে হয়। যেটাকে পপুলার-কালচার হিসেবেও ধরা হয়। রেনেসাঁ যুগ থেকে যে ধারা শুরু হয়েছে তা থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের কন্টেম্পরারি পর্যন্ত যত আর্ট আছে, সেগুলোতে সবচেয়ে প্রশংসিত কাজগুলো স্বকীয়তার ছাপ রেখেছে।

ভ্যান গঘ কিংবা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো প্রত্যেকেই স্বকীয়। চিত্রকর্মে, গানে, ফিল্মে, সাহিত্যে আমরা রেনেসাঁ যুগকে গুরুত্বপূর্ণ ধরি। কারণ তখন যে জোয়ার এসেছে আর্টের প্রত্যেক ধরণে, তা অভাবনীয় বৈপ্লবিক। তবে ধারা বা প্রথা ভাঙার যে রেওয়াজ, পুরোনো সব কাঠামো ভেঙে নতুন করে কিছু করার প্রয়াস, তা শুরু হয়েছে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। যেমন- ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ, ফ্রান্সের সিনেমায় রীতিমতো আর্টকে ফিল্মের ভেতর নিয়ে এসে সম্পূর্ণ নতুন ধারার ফিল্ম-জমানার সূচনা হয়। সেটা সম্পূর্ণ কয়েকজন সেকালের বিদ্রোহী-প্রথাভাঙা ফিল্মমেকার আখ্যা পাওয়া লোকেদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল। যারা মেইনস্ট্রিমকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের মতো করে একটা নতুন ধারার শুরু করে ফিল্ম-মেকিংয়ে। আর আজ সেটা ফ্রেঞ্চ-ফিল্মগুলোর আসল ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে।

তবে তার আগে কি আর্ট ছিল না ফিল্মে? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, ছিল। তবে একটা ধারা যখন বছরের পর বছর একটা মাধ্যমে চলতে থাকে, সেটা তখন নিজের নতুনত্ব আর স্বকীয়তা হারায়। তখন দরকার হয় নতুন কিছুর। আমাদের দেশে সাদাকালো সিনেমার যুগে যে আর্ট ছিল, তা এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে, আপনি যদি দেখেন, রঙিন যুগের সিনেমার শুরুর পর এ অবস্থা ছিল না। ফারুক-জসিম-ইলিয়াস কাঞ্চন-রুবেল এদের প্রত্যেকের সিনেমার ধরণ আলাদা। যদিও গল্পের প্লট সামাজিক কিংবা পারিবারিক। তাহলে এখন সেটা নেই কেন? সেটা এখনো আছে, তবে মিডল ক্লাস থেকে আপার ক্লাস এতে আগ্রহ হারিয়েছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর সব ধারায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার। না হলে সেটা ট্র্যাক হারাতে বাধ্য। আর্টিস্টের স্বাধীনতা আর পপুলার কালচার জড়িত একে অন্যের সাথে।

আমাদের দেশে ধারণা ছিল, যে ফিল্মে-নাটকে আর্ট আছে তা চলবে না। প্রযোজক সেখানে অর্থ বিনিয়োগ করবে না। আর্টিস্ট নিজের ধারা বা রুচিবোধের বাইরে গিয়ে তাই বাধ্য হন মানহীন জিনিসে কাজ করতে। কিন্তু মনপুরা ছবির পরও এ ধারণা বদলালো না। এখন আয়নাবাজি ব্যাবসাসফল হলো ২০১৭ তে এসে। কিন্তু তার সাথে অন্য আর্ট ফিল্মগুলো ব্যবসা করতে পারেনি। আর্ট-ফিল্ম মানে যদি আপনি আলো-আবছায়াতে মদের গ্লাস হাতে কবির ইংরেজি খিস্তি বোঝেন, তাহলেই মুশকিল। মেনস্ট্রিমের মতো আর্ট-ফিল্মের নামে বস্তাপচা ফিল্মেরও অভাব নেই, যেগুলোতে কোনো সাব্জেক্ট নেই। কোনও আর্ট নেই। পপুলার কালচারে যা চলছে তা-ই আপনি আর্ট দিয়ে উপস্থাপন করুন। মানুষ আর্ট বোঝে না বলে আমাদের ইন্ড্রাস্টিতে যে গৎবাঁধা কাজের শুরু হয়েছে, তা আসলেই ভয়ংকর।

দর্শককে অবহেলার চোখে দেখার উপায় নেই। আর্ট ফিল্ম মানেই গ্রামীণ প্রেক্ষাপট কিংবা একেবারে হাই-ক্লাস শহুরে ইন্টেলেকচুয়াল জীবন, তা ভাবতে গেলেই বিপদ। অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্প সিরিজের নাটকগুলোতে আর্টের কমতি দেখিনি। সেগুলো প্রশংসিতও হয়েছে। তাহলে আর্টিস্টকেই এখন ভাবতে হবে, তিনি কী ধরণের ছবি আঁকবেন। কী ধরণের সিনেমা বানাবেন। কী ধরণের কাজে অভিনয় করবেন। পুঁজিবাদী ইন্ড্রাস্টির মেইনস্ট্রিম কখনো আর্টের কদর করে না। পুঁজির সহজলভ্য, ঝুঁকিহীন বিনিয়োগ এদের আসল লক্ষ্য। কাজের মতো কাজ করে আত্মপরিচয়ের ছাপ রাখতে হলে, তৃপ্তি পাবার মতো কাজ রেখে যেতে চাইলে এ ধারা ভেঙে একটা ইন্ডি-ধারার সূচনা করার এখনই সময়। আর্টিস্টের সংগ্রাম প্রতিনিয়ত, নিজের সত্তার দ্বন্দের সাথে লড়াই জারি রাখতে হবে।

চলবে