আলোর ফেরিঅলা পলান সরকার

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১২, ২০১৯

গ্রামের লোকেরা সকালে ঘুম ভেঙে দেখতে পায়, তাদের আঙিনায় হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছেন পলান সরকার। তার কাঁধে ঝোলা, ঝোলার ভেতরে বই। বয়স ৯৭ বছর, কিন্তু ৩০ বছরের যুবকের মতো সচল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে গ্রাম-গ্রামান্তরে যান। নিজের টাকায় কেনা বই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে পড়তে দেন। পড়া শেষ হলে দিয়ে আসেন নতুন কোনো বই। এভাবে একটানা ৩০ বছর ধরে তিনি এ কাজটি করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বিশটি গ্রামজুড়ে গড়ে তুলেছেন এক অভিনব শিক্ষা আন্দোলন। নিজের টাকায় বই কিনে তিনি পড়তে দেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ‘বইঅলা দুলাভাই’ হিসেবে। ১০ সেপ্টেম্বর ছিল সাদা মনের এই মানুষের জন্মদিন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তাকে জানাই শুভেচ্ছা।

১৯২১ সালে নাটোর জেলার বাগাতি পাড়া গ্রামে পলান সরকারের জন্ম। মাত্র পাঁচ মাস বয়সে বাবা হায়াত উল্লাহ সরকারের মৃত্যুতে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অর্থনৈতিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। এরপর তার নানা ময়েন উদ্দিন সরকার মা মইফুন নেসাসহ পলান সরকারকে রাজশাহীর বাঘার থানার বাউসা গ্রামে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণির পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন হারেজ উদ্দিন সরকার। তবে জন্মের পর থেকেই মা ‘পলান’ নামে ডাকতেন। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে পলান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস থেকে যায় আজীবন।

নানা ময়েন উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। যৌবনে পলান সরকার নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন এবং দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে ১৯৬২ সালে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান। নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন। যুবক বয়সে যাত্রাদলে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ করতেন পলান সরকার। মাঝে মাঝে প্রম্পটের কাজ করতেন মঞ্চের পেছনে। আর এই কাজটিই তার বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখে।

১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জন করত, তাদের বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তার কাছে বইয়ের আবদার করলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তাদেরও বই দেবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় বই পড়া আন্দোলনের ভিত।

সাদাসিধা এই মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর প্রচারবিমুখ পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। বাউসা বাজারে তার একটি চালকলও রয়েছে।

১৯৯২ সালে ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখন তিনি স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন। এছাড়া যারা তার চালকলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও তিনি বই উপহার দেন।

তার কর্মকাণ্ড সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এলাকার চায়ের দোকানি পর্যন্ত হয়ে ওঠে বই পাগল, প্রতি বিকেলে তার দোকানে বসে বই পড়ার আসর। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। পলান সরকার ২০১১ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন।

২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক `অবদান`। বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সকলের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির করার জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে `সাদা মনের মানুষ` খেতাবে ভূষিত করে।