আশ্রয়

৫ম পর্ব

সুলতানা পারভীন

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৯

 
এখন যেভাবে অবাক হয়ে মোহনাকে দেখছি ঠিক তেমনি ভাবে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম যেদিন প্রথম দেখেছিলাম। ভার্সিটির নবীন বরণে ওর সাথে আমার প্রথম দেখা। ওদের নবীনবরণের আয়োজনটা করেছিলাম আমাদের ৩য় বর্ষের ছাত্ররা। আর এই নবীনবরণেই মোহনা নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে এসেছিল। একেবারে ডানাকাটা নীলপরী যাকে বলে আর কি!
 
আমি এতোটাই মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম সারা অনুষ্ঠানটা। বোধ হয় ওইদিনই ব্যাপারটার গুজব আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছড়িয়ে যায়।।
 
যদিও মোহনার ব্যাপারটা মোহ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত-কিন্তু তা আর হল কই। মোহনার প্রতিটা কাজই প্রতিনিয়ত আমাকে ওর দিকে আকৃষ্ট হতে বাধ্য করত। মিলমিশ স্বভাব-অসাধারণ বাচনভঙ্গি- শান্ত মেজাজ- অখন্ড যুক্তিবাদীতা- আর অসাধারণ একটা দৃষ্টিভঙ্গি।
 
আর ওর প্রতিটা কাজের অবাক দর্শক আর সাপোর্টার বলেই কিনা কে জানে ওর সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচয়টা হয়ে গেল। পরিচয়-বন্ধুত্ব-সবশেষে ভালোবাসা।
 
কিভাবে কেমন করে মোহনা যে আমার জীবনের সাথে এতোটা মিশে গেছে নিজেও ভেবে পাই না।
সকলকে কন্ট্রোল করার অসাধারণ একটা ক্ষমতা মোহনার ছিল। আর বন্ডিংও। কিভাবে কিভাবে দুটো পরিবারকেই ম্যানেজ করে ফেলল। অথচ ওই সময়টাতে আমার চাকরি বাকরি তো দূরের কথা পড়াই শেষ হয়নি।
 
বেশ ভালোই কাটছিল সময়টা। অন্তত মোহনার ফাইনালের আগ পর্যন্ত। আমিও ততোদিনে মানানসই একটা চাকরি পেয়ে গেছি। এদিকে পরীক্ষায় দিন দিন পড়ার চাপ বাড়ার সাথে সাথে মোহনার শরীরটাও খারাপ হতে থাকে। বাসা থেকে বার বার বারণ স্বত্বেও মেয়েটার পরীক্ষার টেনশন যেন না কমে বেড়েই চলেছে। ফলে যা হবার তাই হল। মোহনা মোটামুটি ভালোভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। যদিও ততোদিনে ফাইনাল এক্সাম শেষ। বাসা থেকে শেষমেশ জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার বললেন:-কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে। বেড়ানোও হবে। আবার মনটাও ফ্রেশ হবে। তাড়াতাড়ি সুস্থও হয়ে উঠবে।
মোহনা যাবে না যাবে না করেও আমাদের সবার কাছে শেষমেশ হার মানল।
 
মোহনা বাবা মা আর বোনের সাথে সিলেট ঘুরতে গেল। পাহাড়ি জায়গা-ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। থাকার কোন সমস্যা নেই। মোহনার কোন এক দুষ্সম্পর্কের এক আত্মীয় থাকে। তাই চিন্তারও কিছু নেই।
মাসখানেক অনায়াসেই কাটিয়ে দেয়ার কথা।
 
কথায় বলে- মানুষ যা ভাবে হয় তার উল্টো। এইবারেও তাই। মাসখানেকের প্ল্যানিং করে গেলেও আমি ঠিক জানতাম মোহনা একসপ্তার বেশি থাকতে পারবে না। হলোও তাই। সাত-আটদিন পর হঠাৎ মোহনার কল এলো একদিন। গলা শুকনো। কণ্ঠস্বরে হাসিখুশি ভাবটা নেই। তেমন কিছু না বললেও বেশ বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। তবে ঠিক যে কি হয়েছে সেটাই বুঝলাম না।
 
মোহনা বিকেলে বাসায় যেতে বলেছিল। ছুটির দিন। কি করব ভেবে সময়ের একটু আগেই বেরিয়ে গেলাম। এদিক ওদিক ঘুরে তারপর মোহনার বাসায় যাব-এই খেয়ালে।
 
মোহনার বাসায় এসে একটু অবাকই হলাম। অন্য সময় আমি যাব জানলে সবাই অপেক্ষা করার মতো করেই বসার ঘরাটাতে বসে থাকত। এইবার মনে হল বাড়িটা একেবারে নিশ্চুপ। কেমন মনমরা মনমরা ভাব আজকে বাড়িতে।
 
আমাকে দেখে মোহনার ছোট বোনটা এল। অন্যদিনের মতো "দুলাভাই-দুলাভাই" করে পাগল করে দিল না। আমাকে বসতে বলে পাংসু মুখে মোহনাকে ডাকতে রুমে চলে গেল।।মোহনাটা নিজের রুমে থাকত খুবই কম। আমার কলের অপেক্ষায়ই হোক বা অন্য কোন কারণে-সারাক্ষণ বসার ঘরে ঘুরঘুর করত। আজ সেটাও একটু অদ্ভুত ঠেকল। আমি উল্টাপাল্টা কিছু করলাম নাকি! মনে তো পড়ছে না। আসতেও দেরি হয়নি। তাহলে কি হতে পারে? এসব ভাবতে ভাবতে খেয়ালই ছিল না কিছু।
 
-কেমন আছো আকাশ?
 
মোহনার কথায় যখন বাস্তবে ফিরলাম তখন মোহনাকে দেখে যে কতোটা অবিভূত হলাম সে আর কি বলব।
 
মোহনার মাতৃমূর্তি!
 
একদম পিচ্চি একটা বাচ্চা মোহনার কোলে। বাচ্চাটার বয়স সর্বোচ্চ দু-তিন দিন। মাথায় অনেক প্রশ্ন খেলা করছে। অথচ এর মধ্যেও আমি অবাক হয়ে মোহনার নতুন রূপ দেখছি।
বাচ্চাটাকে ঠিক করে সামলাতে পারছে না। অথচ কি অপরূপ মানিয়েছে দুজনকে!
 
 
 
চলিবে