আহা কী রঙ্গ এই বঙ্গে

মোরশেদ হাসান

প্রকাশিত : এপ্রিল ১২, ২০১৮

কয়েকদিনে যা দেখলাম, তাকে রঙ্গ না বলে উপায় নেই। বলা যায়, আহা কী রঙ্গ এই বঙ্গে! পাঠক চলুন, এ রঙ্গের দুনিয়ায় আপনাকেও একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।

১. সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের জন্য ছাত্ররা যৌক্তিক আন্দোলন করছিল সরকারি। আওয়ামী অ্যাজেন্ডার বাইরে দেশে কোনো মিছিল করা অলিখিতভাবে নিষেধ। সে নিষেধের দুর্ভেদ্য দেয়াল পেরিয়ে ছাত্রদের দরকার ছিল জয়বাংলা শ্লোগান ও বঙ্গবন্ধুর ছবি। এই জয়বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর ছবি ট্রাম্পকার্ড হিসেবে খেলে ব্যবসা করে আসছে আওয়ামীরা।

২. এই প্রথম তাদের অপছন্দীয় আন্দোলনের গ্রুপের হাতে জয়বাংলা ও  বঙ্গবন্ধু দেখে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তাদের ট্রাম্পকার্ড অন্যের হাতে, এটা হজম করতে তাদের অপরিসীম কষ্ট হয়েছে। হওয়ারই কথা। ছাত্ররা জানতো, এছাড়া তারা রাজপথে টিকতে পারবে না। তাদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের প্রশংসা করতে হয়।

৩. দীর্ঘদিন ধরে এখানে পুলিশ মানেই ভয়াবহ আতঙ্ক। তারাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাদের সামনে আন্দোলনের প্রথমে ছাত্রদের চোখে ভীতির দেখা গেছে, দু’একটি ব্যতিক্রম। অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পুলিশকে বলতে শোনা গ্যাছে, তুমি আমাকে চেন? একেবারে খাইয়া ফালামু। পরে ছাত্ররা সে ভীতিকে মোকাবেলা করে জয়ী হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার ক্ষমা চেয়েছেন, পুলিশ যদি কোনো ভুল করে থাকে এজন্য।

৪. ভিসির বাড়িতে আগুন জ্বলে। ভিসির নিরাপত্তায় সবসময় পুলিশ থাকে। তারা ঘণ্টাখানেক ধরে চা খেয়েছে সেসময়। ভিসিও সাহায্যের জন্য কাউকে আহ্বান জানাননি। এর আগে ছাত্রদের যখন রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে আহত করা হয় তখন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। সরাসরি বললেন, তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষক সমিতি নিজেদের আহত ছাত্রদের কোনো খবর না নিলেও ভিসির জন্য মানববন্ধন করেছেন। পরে সবাই সুড়সুড় করে লাইনে চলে এসেছেন। ছাত্ররাই যে তাদের জানপ্রাণ, তা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দুদিন আগের চরিত্র ভুলে।

৫. সাধারণ ছাত্ররা চাকরি কোটার আন্দোলন শুরু করেছে সময়ের হিসেবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি মুহূর্তে, যেখানে কথা বলতেও মানুষ ভয় পায়। সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন মানেই জামায়াত-শিবিরের প্ররোচনায় রাজাকারি কর্মকাণ্ড। জয়বাংলা শ্লোগান এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি ও হাতে ব্যানার নিয়েও তাদের ট্যাগ খেতে হয়েছে অবধারিতভাবে রাজাকার হিসেবে। যে শাহবাগে একদা শ্লোগান হয়েছিল, ‘তুই রাজাকার’। আওয়ামী জনগোষ্ঠী ছাড়া যত্রতত্র অবাধে রাজাকার ও ছাগু বলার একচেটিয়া ঠিকাদারি ছিল তাদেরই। সময়ের হিসেবে সেই শাহবাগেই বুমেরাং হিসেবে সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখল, শতশত ছাত্রের কণ্ঠে ব্যাকফায়ার হয়ে আমরাই রাজাকার শ্লোগান।

৬. ছাত্রলীগ মানেই ছিল ক্যাম্পাসে যা ইচ্ছে তাই করবে। সেই ছাত্রলীগ নেত্রীকেও জুতার মালা পরতে হয়েছে তাদেরই বিস্ফোরিত চোখের সামনে। তাদেরই রামরাজত্বে। দু’দিন আগেও যা ছিল কল্পনার অতীত।

৭. এরপরের ভূমিকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যার পদচারণা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে দীর্ঘদিনের। তিনি সিচুয়েশন কন্ট্রোল করে নিয়ে এলেও ভাগ্যের ফেরে তা কার্যকর হয়নি।

৮. একে একে ছাত্ররা সব হার্ডল পেরিয়ে আসে। এটাই ছিল নিয়তির খেলা। মঞ্চে সরাসরি তার আবির্ভূত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। প্রভাস আমিনের সর্বশেষ ভরসা। মীর্জা নানক যেখানেই থাকেন সেখানেই ধুন্দুমার খেলা হয়। এ ব্যাপারে তার প্রসিদ্ধি আছে। কথায় বলে, যার যেখানে হাতযশ।

৯. এবং যথারীতি তিনি খেলে দিয়েছেন। যে সরকারকে জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে হয় না, তাদের স্বাভাবিকভাবেই ফ্যাসিস্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। ফ্যাসিস্ট অবকাঠামো ৯ বছরে তিলতিল করে গড়ে তোলা হয়েছে। সেই অবকাঠামোয় হেফাজতকে স্রেফ গিলে খেয়েছে রাতের আঁধারে। যা আত্মবিশ্বাসের পারদ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

১০. ভয়টি সেখানেই। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস! প্রয়োজন পড়লে মরণকামড় দেবেই। কিন্তু এ ঢাকা ইউনিভার্সিটি। অসংখ্য আন্দোলনের সূতিকাগার এ পীঠস্থান। এখানে জড়পদার্থও যেন সজীব। মধুর ক্যান্টিনে বসে থাকলেও অতীতের সব আন্দোলনের বারুদপোড়া গন্ধ ভেসে আসে। এ ইউনিভার্সিটির হিসাব-নিকাশ একেবারেই আলাদা। ইতিহাস বলে, এখানে অতীতের সব খেলা বুমেরাং হয়ে ফিরে গেছে। এ জন্যই ঢাকা ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশের ইতিহাস একসূত্রে গ্রন্থিত। ভয়টা সেখানেই।