অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম

অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম

ঈশ্বর ভাবনা

অতনু সিংহ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৩, ২০১৮

প্রভু শব্দটিকে প্রতিপালক শব্দে প্রতিস্থাপিত করতে পারেন। যদি আপনি আপনার পারিপার্শ্বিক শোষণ, বঞ্চণা ও আধিপত্য তথা কর্তৃত্বের ধারণা থেকে মুক্তি চান, তাহলে আস্তিক আর বস্তুবাদী ও নাস্তিক নির্বিশেষে প্রতিপালক শব্দটিকে নিয়ে ভাবতে পারেন।
আস্তিকরা ঈশ্বর বা আল্লাহকে প্রতিপালক হিসেবে ডাকতে পারেন। আর বস্তুবাদী ও নাস্তিকরা ভেবে দেখতে পারেন, প্রতিপালক শব্দের ভিতর কীভাবে প্রকৃতি বা মহাবস্তু ছেয়ে আছে!
প্রভু, লর্ড, এসব শব্দের ভিতর যে সুউচ্চ কর্তৃত্ব আছে, তা প্রতিপালক শব্দে নাই। বরং আছে নৈর্ব্যক্তিক এক সমতার ইঙ্গিত! ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রভু শব্দে আসলেই আছে এক কর্তৃত্ব, যা বিমূর্ত ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে ধর্মীয় ব্যাখ্যায় ফ্র‍্যাঞ্চাইসি হিসেবে ঈশ্বরের লোকাল এজেন্সি চার্চ, মসজিদ, মন্দির, মঠ ইত্যাদির ওপর অর্পণ করে। এবং বিশপ, ফাদার, আলেম, মৌলবি, পুরোহিত প্রমুখেরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের কর্তৃত্ব নিপীড়িত মানুষ বা মজলুম জনতার ওপর কায়েম করেন। অন্যদিকে আধুনিক রাষ্ট্র ধারণায় সরকার, আমলাতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থাই যে কেন্দ্রীভূত ধারণা তৈরি করে, সেই ধারণাই দৈব প্রভুত্বের শাসন ও শোষনের কর্তৃত্ব তৈরি করে। আর তাই আদলতে গিয়ে আজও লর্ড, মহামান্য ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করতে হয় আমাদের। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বাজার বা পুঁজি প্রভু হিসেবে সেই কর্তৃত্ব কায়েম করে ভোক্তা সমাজে। আর কমিউনিস্ট রাষ্ট্র স্বয়ং তার কাঠামো দিয়ে ব্যক্তি মানুষের সকল অধিকার ও উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে থাকে।
প্রতিপালক শব্দের ভিতরে অধিবিদ্যার কোনো মাহাত্ম্য নাই। আছে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বা বাস্তুসাম্য। উৎপাদিত বস্তুর সুষম বণ্টন, মৈত্রী ও বস্তুতে সকল জীবের হক। আরো ভেঙে বলা যায়, জল/পানি, বাতাস, মাটি, উদ্ভিদ, খনিজ ইত্যাদি সকল কিছুতে সকল জীবের অধিকার, হক... বস্তুতন্ত্রের নির্ধারণ ক্রমে যে অধিকার তা যদি ন্যাচারাল রাইটস হয়, তা মহাবস্তু বা প্রকৃতিক্রমে অর্পিত হয়েছে জীবজগতে। এসকলই প্রতিপালন করছে জীবজগতকে। এই আকাশ, পানি, গাছ, মাটি এসবকে আপনি নানা ক্রিয়াবিক্রিয়ায় সৃষ্ট বস্তু জগৎই বলেন অথবা খোদাতায়ালার উপহারই বলেন, এই সকল কিছুই বাস্তুশৃঙ্খলায় ভারসাম্যে রেখেছে আমাদের ও গোটা জীবজগৎকে।
ধর্ম প্রতিষ্ঠান, পুঁজি ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বই বরং এই ভারসাম্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে নানা সময়। এবং ব্যক্তির দৈহিক, মানসিক, নান্দনিক বা আধ্যাত্মিক হককে বঞ্চিত করেছে। শোষক বা জালেমরা নৃত্য করে গেছে আর বঞ্চিত-নিপীড়িত বা মজলুম জনতা ঝরিয়েছে অশ্রু। আজ যদি অশ্রু মোছার কথা ভাবতে চান তবে নতুন করে সে কথা ভাবতে হবে, যে ভাবনা ভাবিয়ে গ্যাছেন বাংলার লোকদার্শনিক মওলানা ভাসানি। যিনি আস্তিক্য ও বস্তুবাদ এই দুই পথকেই প্রত্যক্ষ করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বাংলার এক মুক্তির পথ, বাংলার লিবারেশন থিয়োলজি, বাংলার প্রতিপালনবাদ।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক, জন্ম পশ্চিমবঙ্গে