উত্তর জানা নেই

মোজাফ্ফর হোসেন

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০১৮

রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্যার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইংরেজি বিভাগ, রাবি) সরাসরি শিক্ষক। আজ সকালে চাপাতির আঘাতে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। আরকে স্যারের অভিজিৎ-নিলয়-রাজীব-দীপন-বাবু এদের মতো কোনো ব্লগ বা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল না। অল্প কিছু কবিতা, ছোটগল্প আর চলচ্চিত্র রিভিউ লিখেছেন। খুব খ্যাতনামা কোনো পত্রিকাতে সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। তার কোনো লেখা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক না। সামাজিক বক্তব্যধর্মী লেখা লিখতেন। সংস্কারবাদী মানুষ ছিলেন, ধর্মীয় কিংবা সামাজিক। সিটিজেন কেইন, বাইসাইকেল থিপ, পথের পাঁচালি-চোখের বালি-মেঘে ঢাকা তারা, অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, সিনডার লিস্ট- এসব ক্লাসিক ছবি নিয়ে লিখেছেন। ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাদের কয়েকজনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও স্যারের অনুপ্রেরণায় শাশ্বতিকী পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। স্যার কয়েকটি সংখ্যায় গল্প-কবিতা-রিভিউ লিখেছেন। সংস্কৃতি-অন্তপ্রাণ এই মানুষটাকে এভাবে নির্মমভাবে খুন করা হলো কেন? অন্তত আমার কোনো উত্তর জানা নেই। রেজাউল করিম স্যারের মোটাদাগে দুটি `সমস্যা` ছিল। আমাদের বর্তমান সমাজে ‘চিহ্নিত’ সমস্যা।

এক. তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করতেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল শিক্ষক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে অনেক টাকা আয় করেন। ইংরেজির শিক্ষকদের কদর এমনিতেই বেশি। রেজাউল করিম স্যার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একবার কথা বললেন। তারা যখন বলল, ছাত্ররা যাই লিখুক মার্কস দিতে হবে; তিনি আর রাজি হলেন না। স্যার এভাবে টাকা পয়সার কাছে বিক্রি হননি। আমি সততার প্রশ্নে এমন একগুঁয়ে-জেদি-স্পষ্টবাদী মানুষ কম দেখেছি।

দুই. তিনি খুব সংস্কৃতিমনা ছিলেন। আমাদের ইংরেজি বিভাগে এটা ছিল একেবারেই বেমানান। রাবির ইংরেজি বিভাগের স্যাররা যেখানে কর্পোরেট মাইন্ডেড, উনি সেখানে বছরে একটা লিটলম্যাগ প্রকাশ করতেন নিজ খরচে। নাম দিলেন কোমলগান্ধার। ঋত্বিক ঘটকের ছবির নামে। ঋত্বিক ঘটকের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন তিনি। সেই ম্যাগে তরুণদের লেখা ছাপা হতো। আমি একবার স্বনামধন্য এক লেখকের লেখা সংগ্রহ করে দিলাম। উনি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখান করে বললেন, ‘এখানে নতুনরাই লিখুক। নিজের পটেকের টাকা খরচ করে পত্রিকা করি। কারো তো কাজে লাগতে হবে?’

কোমলগান্ধার থেকে ইংরেজি বিভাগে নানা সময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বিভাগের নৃত্যশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী ছেলেমেয়েরা স্যারের অনুষ্ঠানে অংশ নিতো। একবার বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসিক সিনেমা দেখানোর প্রকল্প হাতে নিলেন। অফিস থেকে প্রজেক্টর কেনার অর্থ না পেয়ে নিজের টাকায় প্রজেক্টর কিনলেন। বিকেলে দু’চারজন ছাত্রছাত্রীদের জোর করে বসিয়ে প্রিয় সিনেমাটা দেখাতেন। তখন তার চোখে-মুখে কি যে তৃপ্তি লেগে থাকত, তা বলে বোঝানো যাবে না! আমরা হু ইজ অ্যাফ্রেইড অব ভার্জিনিয়া উলফ পড়ে কিছু বুঝছিলাম না, স্যার চলচ্চিত্র ভার্সন নিজে ডাউনলোড করে আমাদের দেখান। নিজের রুমে ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে আমাদের সাথে টরেন্ট থেকে মুভি ডাউনলোড করা শিখে নিয়েছিলেন। ছাত্রদের শেখাতে এবং প্রয়োজনে ছাত্রদের কাছ থেকে শিখতে তার ছিল সমান আগ্রহ। গ্রামের বাড়ি বাগমারায় শিশুদের জন্য একটি গানবাজনার স্কুল করেছিলেন বলে শুনেছি। গ্রামে গিয়ে ঘুড়ি উৎসব, ঘোড়দৌড়সহ বিভিন্ন খেলার আয়োজন করতেন। বিজয়ীদের পুরস্কারও দিতেন নিজের টাকায়।

এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো ভিডিও করে রাখবেন বলে দামি ক্যামেরাও কিনেছিলেন। অনুষ্ঠান চলত আর তিনি ছাত্রদের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও করতেন। শখ ছিল সেতারের। কলকাতা থেকে হাজার পঞ্চাশেক টাকা দিয়ে ভালো মানের সেতার আনালেন। বেশ কষ্ট করে রপ্ত করেছিলেন। সুযোগ পেলেই বাজাতেন। ভালোবাসতেন খেলাধুলাও। ইংরেজি বিভাগের সবধরণের খেলাধুলায় তার মাঠে থাকা চাই। আমাদের বিভাগ ঐতিহাসিকভাবে খারাপ খেলতো। তিনি জানতেন হেরে যাবে তবুও ছেলেদের সাহস যোগাতে মাঠে যেতেন। বিরক্ত হয়ে গালিগালাজ করতেন, কিন্তু উঠে পড়তেন না। শেষটা যেনেও মাঠে বসে থাকতেন। তার এসব আচরণের কারণে আমরা তাকে আড়ালে ‘ম্যাড’ বলে ডাকতাম।

আমরা বহুবার স্যারের বাসায় গেছি। পুরনো লেখা পড়াতেন। সেতারটা বের করে বলকতেন, শুনবে নাকি! তখন হয়তো বিরক্তই হতাম। স্যারের বাসায় যেতে অনীহা হতো। আজ বুঝি, পুত্রের মতো স্নেহ করতেন বলেই `গুরুত্ব` পেতেন না! স্যারের মৃত্যুর পর অনেক মিডিয়া দেখি বলছে, তিনি ‘নামাজও পড়তেন’। এলাকার অনেক মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান রয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। এসব কথা বলা হচ্ছে কেন? আমি জানি তিনি নামাজি বলতে যা বোঝায় তা ছিলেন না। তিনি ধর্মপ্রাণ না। এবং তা না হলেই বা সমস্যা কোথায়? এজন্য তাকে হত্যা করা হবে? আমি জানি না, এই খুনের খেলা শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে। যেভাবে সকলে তাকে জোর করে নামাজি বানাচ্ছে, সেই একইভাবে কেউ যদি এখন তার নামে ব্লগ খুলে প্রচার করেন তিনি ‘নাস্তিক ব্লগার’ ছিলেন, তাহলে আমি আশ্চর্য হবো না। মোটের ওপর নানাদিক থেকে নানা কথা হবে, মাঝখান থেকে আমরা কোনোদিনই জানবো না স্যারকে কারা এবং কেন খুন করা হলো। অভিজিৎ রায়-বিজয়-রাজীব-দীপন-বাবু-নিলয় এদের হত্যা করার কারণ পরিষ্কার। খুনিরা তাদের পক্ষে `প্রমাণ` দেখাতে পেরেছে। ধর্মান্ধ জাতি সব দেখে বলেছে, ‘ও আচ্ছা, নাস্তিক ছিল!’ মানে খুনটা জায়েজ। কিন্তু ওই ধর্মান্ধদের জন্য রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্যারের মৃত্যুর কোনো যুৎসই কারণ দেখাতে পারছে না। তার মতো সহজ সরল সত্যনিষ্ঠ মানুষকে হত্যা করাটা `জেহাদি` বা `জান্নাতি হওয়া` কাজ হলে তো দেশে কয়েক কোটি মানুষকে খুন করতে হবে! নিশ্চয়ই জেহাদি মুসলমান খুনিরা প্রস্তুত তো?

স্যার অনার্স-মাস্টার্স মিলে আমাদের অনেককিছু পড়িয়েছেন। আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে মানসফিল্ডের ‘এ গার্ডেন পার্টি’ ও জয়েসের ‘এরাবি’ গল্পদুটির কথা। তখন বোধহয় প্রথম বর্ষে পড়ি। এরাবি গল্পটা এত ডিটেইলে পড়িয়েছিলেন যে, এখনো আমার সেটি মুখস্ত আছে। পরে গল্পটি অনুবাদ করতে একটুও সমস্যা হয়নি সেই পাঠের কারণে। গার্ডেন পার্টি গল্পের প্রধান চরিত্র কিশোরী Laura নিজেদের বাড়ির পার্টি শেষে উপরি খাবার দিতে যায় পাশের বস্তিতে। সে খাবার দিয়ে বের হয়ে আসার সময় দেখে একটা ঘরে একটা মৃতদেহ রাখা আছে। মৃতের বর্ণনাটা এভাবে এসেছে: There lay a young man, fast asleep–sleeping so soundly, so deeply, that he was far, far away from them both. Oh, so remote, so peaceful. He was dreaming. Never wake him up again. His head was sunk in the pillow, his eyes were closed; they were blind under the closed eyelids. He was given up to his dream. What did garden-parties and baskets and lace frocks matter to him? He was far from all those things. He was wonderful, beautiful.

স্যার নিশ্চয়ই আজ সেই লোকটির মতো প্রশান্তি মেখে ঘুমিয়ে আছেন! আমি ব্যক্তিগতভাবে স্যারের কাছে অনেকভাবে ঋণী। তার কারণে আমাদের জন্য শাশ্বতিকী সাহিত্যকাগজ প্রকাশ করা সহজ হয়েছিল। তিনি লেখা দেয়া ছাড়াও নানা পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আমার লেখক হয়ে ওঠার কালে স্যারের ঋণ কোনোভাবেই ভোলার নয়। রাজধানী চলে আসার পরও তিনি অভিভাবকের মতো আমার খোঁজ নিয়েছেন। কোথাও লেখা প্রকাশিত হলে পড়ে ফোন দিয়েছেন। আমার লেখা নাটকটি বৈশাখি টেলিভিশনে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়ে শিশুর মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। পরদিন আবার ফোন দিয়ে কিছু সমালোচনাও করছেন। এই হলেন তিনি, আমার সমস্ত ছাত্রজীবনের প্রিয় শিক্ষক।

স্যার, যেখানেই থাকুন আপনি ভালো থাকুন। বাংলাদেশ আর আপনার বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত দেশ ছিল না। ইংরেজি বিভাগে একমাত্র আপনার জন্যেই গানবাজনা হতো। বাংলা সংস্কৃতির বিশেষ বিশেষ দিনগুলো উদযাপন করা হতো। কি দরকার ওসব করে? ভালোই হলো আপনি চলে গিয়ে... ! আফসোস কেবল, আপনার হাতের ক্যামেরা, সেতার আর প্রজেক্টরটা হেলায় পড়ে থাকবে! খুনিরা যদি ওদের আগে নষ্ট করে ফেলত, বেশ হতো। ওদের জন্যেই আমার যে একটু খারাপ লাগছে!