ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

একটি চিঠি কী লেখা যায় একুশের জন্য

তোফাজ্জল লিটন

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৮

শিরোনাম দেখে যে কেউ ভেবে বসতে পারেন, ভাষার মাসে পত্রসাহিত্যকে জিইয়ে তোলার জন্য এই ‘আকুল আবেদন’। না, পৃথিবীতে যোগাযোগের সহজতর এত মাধ্যম থাকতে কাউকে কষ্ট করে চিঠি লেখার কথা বলছি না। মানুষ স্বভাবতই কষ্টকর বিষয়গুলো এড়িয়ে চলে। আবার প্রয়োজনে কষ্টকর জিনিস পরিশ্রম করেও আয়ত্ব করে নেয়। এমন কী, জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। তেমনই ভাষার প্রশ্নে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সব ভুলে ৫২ সালে একত্রিত হয়েছিল বাঙালি জাতি। নিজের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য জীবন দেয়া; এর পিছনের শুধু আবেগই একমাত্র প্রভাবক ছিল না। নিজের অর্থনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষাও ছিল অন্যতম কারণ।

আন্দোলনটি অসফল হলে? আমাদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হতো উর্দু ভাষায়। শিক্ষা গ্রহণে উর্দু, ব্যবসা-বাণিজ্যে উর্দু, চাকরি-বাকরিতে উর্দু, অফিস-আদালতে উর্দু, ব্যাংক-বীমায় উর্দু। উর্দু এবং উর্দু...। যোগাযোগ স্থাপনে আমরা হয়ে পড়তাম পক্ষাঘাতগ্রস্থ এবং জীবিকা নির্বাহ হতো অনিশ্চিত। আমাদের প্রজ্ঞাবান পূর্বপুরুষরা জীবন দিয়ে হলেও অধিকার আদায়কে শ্রেয় মনে করেছিলেন। ভাষা সৈনিক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৯৯ সালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, সে জাতি তা প্রচার-প্রসারের জন্য কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের এ বক্তব্যের অনেক পরে হলেও এ বিষয়ে সরকার একটি অনন্য উদ্যোগ নেয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন ২০১০ প্রণয়ন করে। এ আইনের প্রথমেই বলা হয়েছে, যেহেতু ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবস এবং ইউনেস্কো উক্ত দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে, এবং যেহেতু উক্ত দিবসকে সমুন্নত রাখা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য; এবং যেহেতু দেশের অভ্যন্তরে মাতৃভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা এবং বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারকল্পে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নামে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়। এ আইন প্রণয়নের পর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক একরের একটু বেশি জায়গা নিয়ে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এর কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির। এজন্য এখনো হাবিবুর রহমানের আক্ষেপের সাথে লাখ লাখ আক্ষেপ প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে।

বাঙালির জাতীয় উৎসব খুব বেশি নাই। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বাণিজ্যের স্বার্থে। দেশের মানুষ বুঝে অথবা না-বুঝে যুক্ত হয়েছে শোককে ‘উৎসবে’ পরিণত করার মিছিলে। জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিভক্তি থাকলেও মানুষ সর্বজনীনভাবে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় দেশে ও প্রবাসে। আমি যত দূর যাই আমার ভাষা আর দেশ যায় তত দূর। দেশের সুনাম প্রবাস থেকে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন ২০১০ এর ধারা আর ৭ এর উপধারায় সে বিষয়ে কার্যক্রম নিতে বলা হয়েছে। (১) দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে প্রয়াজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ। (৩) বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা-আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেস্কোর সদস্য দেশসমূহের মধ্যে এ সংশ্লিষ্ট ইতিহাস প্রচার। (৪) বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ। আইনে এত কিছু বলা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নাই সিকি আনাও।

বিশ্বব্যাপী ৩৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। তবে বাংলা ভাষা বলতে বিশ্ব বাংলাদেশকেই বোঝে। লন্ডনের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক পিটার কে অস্টিনের মতে, ‘পৃথিবীজুড়ে বিদ্যমান সাত হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় চার হাজার ভাষাই এখন বিপন্ন।’ অসংখ্য ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। বাংলা ভাষা সেখানে এগিয়ে চলেছে বীরদর্পে। মাতৃভাষা বিবেচনায় বাংলা এখন চতুর্থ। ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরেলা ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ানো হয়। বাংলা ভাষার এত গৌরবময় বিষয় থাকার পরও সারাবিশ্বে তার কোনো প্রচারের ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। অথচ আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী শুধু ভাষার নয়, বাংলাদেশ নামটির অতিসহজভাবে একটি ইতিবাচক প্রচার করা যেত। কীভাবে? এ উত্তরটি দেয়ার আগে বলে নেই, তাতে দেশের কী লাভ হতো। মোটাদাগে বলতে গেলে, মানুষ সবসময় তার পরিচিত গণ্ডির মধ্যে থাকতে চায়। আপনি বাজারে একটি পণ্য কিনতে গিয়ে পরিচিত দেশের পণ্যটাই কেনেন। তেমনি বিশ্ববাজারে সমমানের কোনো পণ্য যদি অপরিচিত কোনো দেশের হয়, মানুষ তাতে নির্ভর না করে পূর্বপরিচিত দেশের জিনিসে আস্থা রাখে।

কী ভাবে? উত্তরে বলা যায়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বাংলাদেশের মানুষ আছে। দেশের আদলে অস্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা জাতীয় শহিদ দিবস পালন করে একুশে ফেব্রুয়ারি। দেশে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেও প্রবাসে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ সীমিত। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে দিবসটির আয়োজন করতে বাধ্য হয়। বিচ্ছিন্ন আয়োজনটা যদি প্রতিটা দেশে সম্মিলিতভাবে বিদেশিদের সম্পৃক্ত করে ব্যাপক আয়োজনে করা যেত তাহলে কী হতে পারতো? স্থানীয় প্রতিটা দেশের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক জায়গা দখল করতে পারতো। তা ঘটতে পারতো বিশ্ব গণমাধ্যমেও। যার ফলে আমাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির কথা বিশ্ববাসী জানতে পারতো। কিছু দিন আগে সরকারের একজন দায়িত্ববান মানুষ বলেছেন, ঢাকায় ‘ইসলামিক পর্যটন’ চালু করা হবে। মানুষ পাখির বাসা খুঁজলে বাবুই পাখির বাসাই খোঁজে। চড়ুই পাখির নয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন ও রাতারগুলের মতো আরো অনেক দর্শনীয় স্থান ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া প্রতিটা জেলায় কিছু না কিছু আছেই দর্শনীয়। শুধু বিশ্বব্যাপী প্রচারের অভাবে আমাদের পর্যটণের করুণ অবস্থা। আমাদের গৌরব আর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি বিশ্ব দরবারে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে পর্যটন শিল্পে সুবাতাস বইয়ে যেতে পারতো।

প্রশ্ন আসে সম্মিলিত আয়োজন করাটা কী এতই সোজা? হ্যাঁ, একেবারেই সোজা। প্রতিটা দেশে বাংলাদেশের হাই কমিশন এ কাজটি সহজেই করতে পারে সবাইকে নিয়ে। বাংলাদেশ হাই কমিশন অফিস যদি সেই দেশে যারা নিয়মিত একুশের আয়োজন করে এবং কমিউনিটির  নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে, তাহলে অধিকাংশ প্রবাসীই সম্মানিতবোধ করবে কাজটি করতে। তখন অর্থনৈতিক বিষয়টাও বড় কোনো ব্যাপার হবে না। পাশের দেশ ভারতের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘দেওয়ালি’ এক সময় নিজে বড় করে আয়োজন করতো। এখন আমেরিকা সরকার নিজে তা উৎসব আকারে উদযাপন করে। চীন সরকার তাদের নিজের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিশ্বব্যাপী। এসব আয়োজনে সেসব দেশের কী লাভ হচ্ছে, তা সরকার ভালো করেই জানে। এমন অসংখ্য নজির চোখের সামনে থাকার পরেও আমাদের সরকারের এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নাই। অন্যান্য দেশের এসব সম্মিলিত আয়োজন দেখে বাংলাদেশি প্রবাসীদের আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত কেউ নিজে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার চেয়ে কোনো দায়িত্ব পেলে তা পালন করতে বেশি পছন্দ করে। এছাড়া পরনিন্দা আর পরশ্রীকাতরতা তো আছেই। এজন্যই হয়তো কোনো হাই কমিশনার নিজে উদ্যোগী হয়ে এ ধরনের কাজ হাত দ্যায় না। যারা প্রবাসে সরকারিভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তারা প্রত্যেকেই দেশপ্রেমী, তাতে সন্দেহ নেই। তারা প্রত্যেকে দেশের জন্য কিছু করতে পারলে গর্ববোধ করে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি একটি চিঠিতে একুশের আয়োজনটি সম্মিলিতভাবে করার কথা বলা হয়, তাহলে প্রতিনিধিরা প্রবাসীদের সাথে নিয়ে উদ্যোগটি স্বাচ্ছন্দে করতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি চিঠি কী লেখা যায় একুশের জন্যে?