একাত্তুর স্মৃতিকথা

মোহাম্মদ রইস

প্রকাশিত : মে ১২, ২০১৮

পুরোনো ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে খুব সাধারণ একটা পুরোনো বাড়ি | চুন সুরকির গাঁথুনি, কড়িকাঠ আর লোহার বিমের সিলিং বাড়িটার। একতলা এই বাড়িতে চারটে কামরা। সামনে দুটো, পিছনে দুটো। সামনের বড়টা আব্বার চেম্বার আর ছোটোটা আমাদের পড়ার ঘর। পেছনের দুটোর একটা আব্বা-আম্মার বেডরুম আর একটা আমাদের তিন ভাইয়ের বেডরুম।

মাঝে মাঝে মেঝো ভাই পড়ার রুমে গেস্টের জন্য যে বেড ছিল, তাতে ঘুমাতো। বাড়ির পেছনে রান্নাঘর, ছোট্ট বারান্দা আর ছোট্ট একটা উঠোন। সেই উঠোনের শেষে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে ছিল আম্মার প্রিয় লেবু, রজনীগন্ধা আর জামগাছ। আমাদের শৈশব কেটেছে এই বাড়িতে আর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় আমি এই বাড়িতে কাটিয়েছি। এখনো আমরা ভাইরা যখন ছেলেবেলার গল্প বলি ,তখন এই বাড়ির কথা উঠে আসে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমরা এই বাড়িতে অবরুদ্ধ ছিলাম অধিকাংশ সময়। অবরুদ্ধ ঢাকাতে কীভাবে আমরা সেই বাড়িতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছিলাম, তাই লিখবো। সেই সময় আমার বয়স পাঁচ কী ছয়। স্মৃতি হাতড়ে আর স্মৃতিশক্তির উপর ভর করে এই লেখা। বড় রাস্তার উপরে আমাদের বাসা। তাই যখন তখন বিক্ষিপ্তভাবে যেকোনো মিছিল বাসার সামনে দিয়ে যেত। আব্বার চেম্বারের সামনে লম্বা বারান্দাতে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখা ছিল আমার একটা প্রিয় কাজ।

মনে পড়ে, মার্চ মাসে প্রচুর মিছিল যেত আমাদের বাসার সামনে দিয়ে। মার্চের মাঝামাঝি লাল, সবুজ মাঝে হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা আমাদের বাসার সামনে বিক্রি হতো। আমার আবদারে আব্বা আমাদের একটা পতাকা কিনে দেন আর আমরা মহা আনন্দে সেটা একটা বাঁশের আগাতে লাগিয়ে বাড়ির ছাদে উড়িয়েছিলাম। পতাকাটা অনেক দিন ছাদে ছিল পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আগপর্যন্ত। আমাদের আশপাশে সব বাড়ির ছাদে সেই পতাকা উড়ছিল।

২৫ মার্চ রাতে প্রচুর গোলাগুলির শব্দের কথা মনে আছে। স্পষ্ট মনে আছে ২৬ মার্চের কথা। সেদিন সকাল থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। কারফিউ ভঙ্গ করলে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ ছিল। আমরা সবাই বাসাতে আটক ছিলাম। আমরা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম রাইফেলসহ আর্মিদের আনাগোনা আর তাদের মার্চ করে যাওয়ার সময় বুটের মচমচ শব্দ। এই নয় মাসে আর্মিদের বুটের মচমচ শব্দ আমার বহুবার শুনতে হয়েছিল। অসহ্য সেই শব্দ!

সারাদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জ্বালাও পোড়াও আর হত্যাকাণ্ড ঘটে। দুপুরের পর থেকে খবর আসে, নয়াবাজারে আগুন লাগানো হয়েছে। নয়াবাজার আমাদের বাসা থেকে দূরে, বিশাল কাঠ আর ফার্নিচার মার্কেট। বিকেল থেকে আগুনের লাল শিখা আমাদের বাসার খুব কাছে চলে আসে আর বাসাতে থাকা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। মনে আছে, আম্মা বলছিলেন, বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হচ্ছে গা পুড়ে যাচ্ছে!

আব্বা-আম্মা সিদ্ধান্ত নেন, আমরা সবাই আমাদের মসজিদে আশ্রয় নেব। বড়ো ভাইয়ের অনেকগুলো কবুতর ছিল আর আব্বা খুব শখ করে কবুতরের জন্য বেশ কিছু সুন্দর ঘর বানিয়ে দিয়েছেলেন। যাবার আগে সব কবুতরগুলি ছেড়ে দেয়া হয়, যদি আগুনে পুড়ে মারা যায়! ছেড়ে দিতে সত্যি খুব হচ্ছিলো। এতদিনের পোষা কবুতর! আম্মা উনার অলংকার আর আব্বা কিছু টাকা দিয়ে একটা পোটলা বানিয়ে শুধু সেটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, যেটা মোটেও সহজ ছিল না।

মসজিদ রাস্তার ওপারে একটু দূরে। কিন্তু কারফিউ আর দেখামাত্র গুলির নির্দেশের কারণে ব্যাপারটা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। আর্মিদের ট্রাক আর আর্মিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রথমে দৌড়ে রাস্তা পার, তারপর আরো দুই তিন দৌড়ে আমরা মসজিদে পৌঁছাতে সক্ষম হই। আম্মাকে ইমাম সাহেব মসজিদের দোতলায় উনার কামরা ছেড়ে দেন, আর আমরা সবাই মসজিদের দোতালায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। সে এক ভয়ঙ্কর রাত! সবার সারক্ষণ চিন্তা হচ্ছিলো, আমাদের বাড়ি বোধহয় পুড়ে গেল! ফজরের নামাজের পর আমরা বাড়ি ফিরে আসি। আল্লাহর রহমতে বাড়ির কোনো ক্ষতি হয়নি। আরো কিছু লোক মাসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল। নয়াবাজারের সেই আগুন নাকি বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বলেছিল।

এপ্রিল থেকে ঢাকার অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক অথবা জোর করে স্বাভাবিক  রাখার চেষ্টা করা হয়। তবুও ধরপাকড় আর হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকে। মনে আছে, আব্বা সাইনবোর্ড যারা লেখেন তাদেরকে দিয়ে উনার চেম্বারের দরজায় বড় একটা রেডক্রস আর রাস্তার দিকের অন্য দরজাগুলোতে কালিমা তাইয়েবা আর কালিমা শাহাদাত লিখিয়েছিলেন। বোঝানোর জন্য যে, এটা একজন ডাক্তার আর একজন সাচ্চা মুসলমানের বাড়ি। ঢাকায় তখন প্রায় বাড়ির প্রধান ফটকে কালিমা আর বিভিন্ন দোয়া লেখা দেখা যেত।

এ সময় ঢাকার অফিস আদালত আর স্কুল-কলেজ খোলা রাখার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সব জায়গায় উপস্থিতি ছিল খুবই কম। প্রায়ই ঢাকায় কারফিউ আর সন্ধ্যার পর অনেকটা সময় ধরে ব্ল্যাক আউট থাকতো। মানে এ সময় সব লাইট বন্ধ করে শুধু মোমবাতি আর হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা যেত। স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা ছিল আরেক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। আমাদের পড়ার রুম আর বেডরুমের মাঝের দেয়ালটা ছিল বেশ পুরু। আমাদের বড় খাট আর সেই পুরু দেয়ালের মাঝে একচিলতে জায়গায় আমরা সবাই জড়ো হয়ে আব্বার ছোট্ট রেডিওতে খুব অল্প ভল্যুমে খবর শুনতাম সন্ধে সাতটার পর। কোনো অবস্থায় শব্দ যাতে বাইরে না যায় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হতো।

আমাদের বাসার ঠিক পিছনে থাকতেন মোমবাতির ব্যাবসায়ী ফয়েজ আঙ্কেল। উনি সংগ্রামের শুরুতে পরিবারসহ উনার গ্রামের বাড়িতে চলে যান। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় কলাবাগান থেকে আমার বড় খালার ছেলেমেয়েরা নতুন ঢাকাতে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে সবাই আমাদের বাসাতে চলে আসে। অত মানুষ আমাদের বাসায় জায়গা হবে না বলে ফয়েজ আঙ্কেলের অনুমতি নিয়ে আমাদের সব মেহমান উনার বাসায় রাখা হয়। এই বিপদের সময়ও আব্বাকে সবার জন্য বাজার করা এবং আম্মাকে ব্যস্ত থাকতে হতো সবার জন্য রান্নাবান্না করা আর মেহমানদারি করতে। আমার কিন্তু সবার সাথে একসঙ্গে থাকতে ভালোই লাগছিল। এই সময় প্রতিদিন সন্ধ্যায় যথারীতি ব্ল্যাক আউট চলতে থাকে।

ডিসেম্বরের শুরুতে যখন এয়ার অ্যাটাক শুরু হয় তখন পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি হয়। এ সময় যত্রতত্র শেল ছোড়া হয়, এমনকি আমাদের বাড়ির উঠোনে একটা শেল এসে পড়ে। এয়ার অ্যাটাক থেকে বাঁচার জন্য এ সময় বাড়ি বাড়ি ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়। ছোট পরিবারের জন্য V  আর বড় পরিবারের জন্য W  shaper ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয় কোমর সমান গভীর। বোম্বিংয়ের সময় সবাইকে আত্মরক্ষার জন্য ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিতে হতো আর ট্রেঞ্চ ঢাকা হতো টিনশেড দিয়ে।

১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসের আগে সারা শহরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। আমাদের প্রতিবেশী এক ডাক্তার আঙ্কেলকে যেদিন ধরে নিয়ে যায় তার আগের দিন আঙ্কেল আব্বাকে সাবধানে থাকতে বলেন। আব্বা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন আঙ্কেলের ধরা পড়ার খবর শুনে। তারপর আসে সেই ১৬ ডিসেম্বর! এদিন বিকেলে রেসকোর্সের ময়দানে পাকিস্তানি আর্মিরা আত্মসমর্পণ করে। আমার মেঝো ভাই আর আব্বার কম্পউণ্ডার আত্মসমর্পণ দেখতে যান। আমি ছোট ছিলাম আর ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে পারি, তাই আম্মা আমাকে যেতে দেননি।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: স্মৃতিশক্তির উপর যথেষ্ট অত্যাচার করে আর ৫-৬  বছর বয়সের স্মৃতি খুঁড়ে এই লেখা বার করতে হয়েছে। আমার এ লেখা উৎসর্গ করছি নতুন প্রজন্মকে, যাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা আর ইতিহাস জানার অধিকার আছে।

লেখক: ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী