‘এত বড় চমক খাব, ভাবিনি’

কামরুল আহসান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮

গাড়িতে ওঠে দেখি, কলম আনি নাই। না দাগিয়ে আমি বই পড়তে পারি না। আগের রাতে বইটা ব্যাগের ওপর রেখে দিছিলাম, ব্যাগে সাধারণত আমার দুএকটা কলম থাকে, কলম গেল কই? মনে পড়ল, আগের বইয়ের ভিতরে একটা ছিল, আরেকটা ছিল খাতার ভিতরে। সেই খাতা ও বই রেখে এসেছি। এখন কলম আনি নাই বলে তো এ বই আমি না পড়ে থাকতে পারি না।

কতদিন ধরে এ বই পড়বো ভাবছি, সুযোগ হচ্ছিল না, কেনার পরও কয়েকদিন রেখে দিয়েছিলাম, অবশেষে সেই সুযোগ এলো, বোনজামাইয়ের ভাগ্নির বিয়ে খাওয়ার উপলক্ষে হঠাৎ কুমিল্লা যাওয়ার প্রয়োজন হলো, তখন ভাবলাম, বেশ হয়েছে, গাড়িতে বসে এই বই পড়া শুরু করবো আর কুমিল্লা যে-দুদিন থাকবো এর মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেলবো। এখন সাথে কলম নাই বলে মেজাজটা একটু খারাপ হলো। গাড়ি থেকে নেমে কলম আনারও সুযোগ নাই, সাথে বোন ভাগিনা-ভাগ্গী আছে, তাদের ছেড়ে গাড়ি থেকে নামার সুযোগ নাই, ভাগিনা আমার কোল থেকে নামে না, আর গাড়িতে আমড়া-শশা- চানাচুর বেচে, কলম তো বেচে না।

যাই হোক, কাচপুর ব্রিজ পার হয়ে ভাগিনাকে বোনের কোলে দিয়ে আমি বইটা পড়তে শুরু করলাম। প্রথম দুএক পাতা আগেও দুএকবার পড়েছিলাম। আবার প্রথম থেকে শুরু করলাম। তিনপাতার মধ্যে আমি তন্ময় হয়ে গেলাম। আমি আর তখন গাড়ির মধ্যে নাই, আমি তখন সুহাসিনী গ্রাম। মেঘনা পর্যন্ত যেতে পনেরো-বিশ পাতা পড়ে ফেললাম। তখন ভাগ্নীকে মেঘনা নদী দেখানোর জন্য তাকে ডেকে কাছে আনলাম। কিন্তু, আমি যে-পাশে বসেছি, বাঁ পাশে, সেখান থেকে আর মেঘনা নদী দেখা যায়, সেদিকে এখন নতুন একটা ব্রিজ হচ্ছে, আবার ভাগ্নীকে দাঁড় করিয়ে ডান দিকে নিয়ে গেলাম, বললাম, দেখ মেঘনা, দেখ কতো বড় নদী! মেঘনা নিয়ে আমার অনেক নস্টালজিয়া আছে। ছোটবেলায় এ নদী ফেরি দিয়ে পার হতাম। ফেরিতে গাড়ি উঠলে আমরা গাড়ি থেকে নামতাম। আব্বা চানাচুর, শশা খাওয়াতেন। তখন মেঘনাকে মনে হতো অকূল দরিয়া। ফেরির পাশ দিয়ে কচুরিপানা ভেসে যেতে দেখে ভাবতাম, ওরা কোত্থেকে আসে, কোথাই-বা যায়!

মেঘনা পার হওয়ার পর ভাগ্নিনীকে আবার তার মার পাশে বসিয়ে দিয়ে পড়া শুরু করলাম। ইলিয়েটগঞ্জ গিয়ে আমরা নামলাম। সে পর্যন্ত আরো দশ-পনেরো পাতা পড়তে পারলাম। তারপর বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া পর্যন্ত আর পড়ার সুযোগ হয়নি। একটা বিস্তীর্ণ বিল পাড়ি দিয়েছিলাম নৌকায় করে, প্রকৃতির শোভা দেখতে হবে আর বই খুলিনি। বোনজামাইয়ের বাড়ি যাবার পরও বিকেলটা কাটিয়ে দিলাম বিকেলে বিলে নৌকায় ঘুরে। বইটা পড়া শুরু করলাম আবার সন্ধ্যার পর এবং তখন ক্যারেন্ট চলে গেল। সেই ক্যারেন্ট আর আসে না। পল্লী বিদুৎ। সৌরবিদ্যুতের আলো অছে, কিন্তু, তা এতোটাই ম্লান তা দিয়ে বই পড়া যায় না। সে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। রাত আট-সাড়ে আটটার দিকে গিয়ে আমি বহুদূরের এক টংয়ের দোকান থেকে পাঁচটা মোম কিনে নিয়ে আসলাম। ক্যারেন্ট কখন আসে না আসে তার তো ঠিক নাই, রাতে তো আমাকে এই উপন্যাস পড়তেই হবে। এর মধ্যে ঘরের ভিতর প্রচণ্ড গরম, কুরবানী ঈদের দুদিন পর, দুদিন গরুর মাংস খেয়ে শরীর আরো গরম হয়ে গেছে। রাত এগারোটার দিকে উঠানে গিয়ে বসে রইলাম চেয়ার পেতে। চারদিক শুনশান নিস্তব্ধতা, গাছপালার ফাঁক- ফোকর দিয়ে চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ছে। সে রাতে পূর্ণিমা ছিল। আর যে-বইটা আমি পড়ছি সেই বইটার নামও, সে-রাতে পূর্ণিমা ছিল।

বইটা কিনেছিলাম মেহেদীর সামনে, আর মেহেদী তখন থেকেই জোর দিয়ে আসছিল, ভাই, বইটা পড়ছেন? ভাই, বইটা পড়ছেন? আমি বলি, পড়ি নাই, কী হইছে সেই বইয়ের? সে বলে, খুব অসাধারণ বই, ভাই। পড়ার পর আপনার কথা শুনবো। আমি তখন ছটফট করছি মেহেদীর সাথে কথা বলার জন্য। এদিকে আমার মোবাইলে চার্জও নাই, ব্যালেন্সেও নাই। ভাবলাম, ক্যারেন্ট আসলে মোবাইল চার্জ দিয়ে মেহেদীকে ফোন করব। রাত বারোটা বেজে গেল, ক্যারেন্ট আসে না। রাত বারোটায় মোবাইলে ১২ পারসেন্ট চার্জ ও ১৭ টাকা ব্যালেন্স নিয়ে আমি মেহেদীকে ফোন দিয়ে দেখি তার নাম্বার বিজি। তখন আমি জি এইচ হাবীব স্যারকে ফোন দেই, এ বইটা নিয়ে কারো সাথে তো আমার একটু কথা বলতেই হবে এক্ষুণি। হাবীব স্যারের সাথে দুমিনিট কথা বলতেই মেহেদীর ফোন আসতে থাকে, ওদিকে হাবীব স্যারের সাথেও কথা এগিয়ে যাচ্ছে, ব্যালেন্স কমে যাচ্ছে, তার সাথে কমে যাচ্ছে চার্জ, আর তার সাথে বাড়ছে মেহেদীর অস্থিরতা, সে এরমধ্যেই আরো দুবার ফোন দিয়েছে। আমি দ্রুত হাবীব স্যারের সাথে কথা শেষ করে মেহেদীকে ফোন দিয়ে বলি, মেহেদী, তোমার মোবাইলে ব্যালেন্স আছে, থাকলে ব্যাক করো। সে কল কেটে দিয়ে দ্রুত ব্যাক করে। তখন তাকে আমি আমার বর্তমান পরিস্থিতি পরিবেশ সম্পর্কে সব জানিয়ে বলি, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল পড়ছি মেহেদী! মেহেদী শিহরিত হয়ে বলে, ও তাই! কেমন লাগছে বলেন? আমি বলি, অসামান্য। এমন উপন্যাস বাংলাভাষায় লেখা হয়েছে এটা একটা কল্পনাতীত ব্যাপার। আমি এতো বড় চমক খাব ভাবিনি।

যদিও উপন্যাসটা পড়তে পড়তে বারবারই মনে পড়ে মার্কেজের কথা, অনেক বাক্যই প্রায় হুবহু মার্কেজীয়, তবু, মার্কেজীয় আদলে বাংলাভাষায় যে এমন একটা উপন্যাস রচিত হতে পারে তা আমি কল্পনা করি নাই। মার্কেজীয় আদলে হলেও তা একেবারে মৌলিক। আমি বলবো মার্কেজেরও দুর্ভাগ্য এই উপন্যাস তিনি পড়ে যেতেন পারেন নাই। আমি এমনও বলবো, নিঃসঙ্গতার একশ বছর বছর যদি নোবেলে পুরস্কার পেতে পারে সে রাতে পূর্ণিমা ছিলও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিল।

তখন আমি যতটুকু পর্যন্ত পড়েছিলাম ততোটুকু নিয়ে মেহেদীর সাথে কথা বলতে থাকি। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা জানতে পারি এক পূর্ণিমা রাতে মফিজউদ্দিনের পুরো পরিবার খৃুন হয়ে গেছে। সেসব নিয়ে গ্রামের লোকজন বলাবলী করছে বহুবছর পর। মফিজউদ্দিনের ছোট ছেলে রফিকুল ইসলাম প্রেমে পড়েছিল জান্নাত আরার। তখন তারা মাত্র ক্লাশ টেনে পড়ে। বাবার চাকরি সূত্রে মাত্র এক বছরের জন্যই ওই স্কুলে পড়তে এসেছিল জান্নাত আরা। রফিকুল ইসলামের মৃত্যুর খবর শুনে সবার সামনে সে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে, তার পরের বছরই সে ওই স্কুল ছেড়ে চলে যায়, গ্রামের লোকজন পরবর্তীতে বলাবলী, জান্নাত আরা এখানে এসেছিল শুধু রফিকুল ইসলাম নামে এক ছেলের জন্য একটু কান্না করার জন্যই।

আমি কোনো বইয়ের রিভিউ লিখতে চাই না। এটা আমি লিখছি মেহেদীর জোরাজুরিতে। সে সেই প্রথম থেকে বলে আসছে এ বই নিয়ে আপনি কিছু লিখেন ভাই। এরকম অসাধারণ উপন্যাস নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু লেখা যায় না। জান্নাত আরার সাথে সাথে আমিও তখন ফুপিয়ে উঠেছিলাম তা আমি কেমন করে লিখবো? কেমন করে লিখবো দুলালীর দুঃখকথা!

পরদিন বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। সে বহুদূরের পথ। একটা থানা থেকে আরেকটা থানা। আমার হাতে সারাক্ষণ বইটা ধরা । একটু ফাঁক পেলই বইটা পড়ছি। একটা প্যারা হলেও পড়ছি। যখনই সময় পাচ্ছি তখনই পড়ছি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পড়ছি, রিকশায় বসে বসে পড়ছি। একটা বাজারে গিয়ে আমাদের কিছুক্ষণ থামতে হলো আরো কিছু মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। আমাদের সাথে বোন-ভাগিনা-ভাগনীসহ একদল বাচ্চাকাচ্চা। আমি সবগুলোকে একটা হোটেল চা খেতে বসিয়ে দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপন্যাসটা পড়ছি। বিয়ে বাড়িতে গিয়েও একটা গাছতলায় বসে আমি উপন্যাসটা পড়ছি। লোকজন পাশ দিয়ে যাচ্ছে আসছে আমার কোনোদিকে বিকার নাই। আমি একদম উপন্যাসে ডুবে আছি। এমন কি বিয়ের পড়ানোর পর মোনাজাত ধরার সময়ও আমার কোলে বই, চোখ বইয়ের পাতার দিকে।

সেদিন বিকেলেই ঢাকা চলে এলাম। আর দশ-বারো পাতা বাকি ছিল। আমার সারাজীবনের অভ্যাস উপন্যাস আমি সব সময় রাতে শেষ করি। রাতে শেষ করার জন্য পাঁচ-দশ পাতা রেখে দেই। উপন্যাসটা শেষ করেই মেহেদীকে আমি ফোন দিলাম। বললাম, মেহেদী, বহু বছর এমন অসাধারণ একটা উপন্যাস পড়লাম। আমার প্রিয় পাঁচ-দশটা উপন্যাসের মধ্যে এটা স্থান করে নিল। মফিজউদ্দিন না, চন্দ্রভান না, নাসিরুদ্দিন না, দুলালী না, নয়নতারা না, আমার কান্না পাচ্ছে কেবল শহীদুল জহিরের জন্য। কতোখানি ধ্যানস্থ হলে এমন একটা উপন্যাস লেখা সম্ভব এটাই ভাবি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার

একুশে বইমেলা ২০১৮