কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হকের সঙ্গে কথোপকথন

প্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০১৪

: বুঝলেন ভাই, ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে তো আজকাল নতুন নতুন সব ব্যাখ্যা শুনছি।
হামীম কামরুল হক : কেমন?
: সেদিন এক আড্ডায় একজন বললেন, অ্যারাবিয়ান নাইটসে নাকি শত শত ম্যাজিক রিয়েলিজম। বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যও নাকি ম্যাজিক রিয়েলিজমের খনি।
হামীম : অ্যারাবিয়ান নাইটস-এ শত শত ম্যাজিক রিয়েলিজম! মজার তো!
: আপনিও মজা পাচ্ছেন?
হামীম : সে-রকম মজা পাচ্ছি। ফ্যান্টাসি ও ম্যাজিক রিয়েলিজমকে গুলিয়ে ফেললে মজা পাব না?
: তা আপনিই বলুন, ফ্যান্টাসি কোনটা আর ম্যাজিক রিয়েলিজম কোনটা?
হামীম : ম্যাজিক রিয়েলিজম বলতে আপনি কী বোঝেন?
: আমি একটা উদাহরণ দেই। যেমন, ‘রাগে-দুঃখে সারা দিন উপোস কাটাল ওসমান। রাতে খিদার চোটে টিকতে না পেরে মায়ের কাছে গিয়ে ভাত চাইল। কী আশ্চর্য, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিনা একটা হুতোম প্যাঁচা দেখতে পেল!’ হলো উদাহরণটা?
হামীম : যে কারণে ওসমানের সঙ্গে মায়ের ফ্যাসাদ, আগে পরে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে তো?
: আছে।
হামীম : তাহলে আপনি এটাকে ম্যাজিক রিয়েলিজম বলতে পারেন।
: যদি এভাবে লেখা হয়, ‘মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওসমান যেন একটা হুতোম প্যাঁচা দেখতে পেল’―তাহলে কি ম্যাজিক রিয়েলিজম বলা যাবে?
হামীম : কোনোভাবেই না।
: কেন?
হামীম : কারণ ম্যাজিক রিয়েলিজমে ‘যেন’, ‘হয়ত’ এসব চলে না। ম্যাজিক রিয়েলিজমের বক্তব্য একদম সরাসরি। নিঃসংশয়। ধনুক যেমন সোজাসুজি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে ঠিক তেমন।
: আপনি একটা উদাহারণ দেবেন?
হামীম : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘সরলা এরেনদিরা ও নির্দয় ঠাকুমার অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনি’ গল্পটা পড়েছেন নিশ্চয়ই?
: জি, পড়েছি।
হামীম : আমি ঐ গল্প থেকে উদ্ধৃত করছি : ‘গাছ ছাঁটবার যন্ত্রগুলি নিয়ে ইউলিসিস বাগান থেকে ফিরতেই ভদ্রমহিলা তাকে সামনের টেবিল থেকে বিকেল চারটের ওষুধগুলি দিতে বললেন। সে স্পর্শ করতেই জলের গেলাস আর ওষুধের রঙটা পালটে গেল। এখন সে সম্পূর্ণ খেলাচ্ছলে প্রথমে টেবিলের উপর রাখা কাচের পিকদানিটা ধরল। পিকদানিটা নীল হয়ে গেল।’ এটাই হচ্ছে ম্যাজিক রিয়েলিজম।
.

: বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসে অপরূপ সুন্দরী যে মেয়েটি―কী যেন নাম―নামটা মনে পড়ছে না। যাই হোক, ঐ অপরূপ সুন্দরী এবং বোকা মেয়েটা একদিন বাগানে কয়েকটি চাদর মেলতে গিয়ে নিমেশেই আকাশে উড়াল দেয়―ওটা তো ম্যাজিক রিয়েলিজম, তাই না?
হামীম : না না, এটা ফ্যান্টাসি। অনেকে এটিকে ম্যাজিক রিয়েলিজম বলে গুলিয়ে ফেলে।
: মার্কেস কিন্তু এটার চমৎকার একটা ব্যখ্যা দিয়েছেন। মারিয়ো বার্গাস ইয়োসার এক প্রশ্নের জবাবে মার্কেস বলেছেন, এ ঘটনার ব্যখ্যাটি বেশ সহজ, সবাই যেমনটি ভাবে তার চেয়েও অকিঞ্চিৎকর। বাস্তবে এরকম একটি মেয়ে ছিল যার সঙ্গে সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদে রেমোদিয়াস দ্য বিউটির যে বর্ণনা দিয়েছি তা হুবহু এরকম। বাস্তব জীবনের ঐ মেয়েটি একটি লোকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল আর তার পরিবার লজ্জার মাথা খেয়ে সত্যকে আড়াল করে বলেছিল, একই রকমের ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে, যে, তাকে, ঐ মেয়েটিকে, বাগানে কয়েকটি বিছানার চাদর মেলতে দেখা গিয়েছিল আর তারপর সে আকাশে উড়াল দেয়।’
হামীম : হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মার্কেস এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আসলে মেয়েটির পরিবার সত্যকে আড়াল করে একটা গুজব রটিয়েছিল।
: পরিবারের মান-সম্মান বাঁচাতে ফ্যান্টাসি সৃষ্টি করেছিল, তাই তো?
: ঠিক ধরেছেন, ফ্যান্টাসি। এটা ফ্যান্টাসি। কোনোভাবেই ম্যাজিক রিয়েলিজম নয়।
.

: আচ্ছা, বাংলাদেশের একজন লেখকের গল্প-উপন্যাসে তো ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদুবাস্তবতায় ভরা, তাই না?
হামীম : আপনি ছোট্ট একটা ভুল করেছেন।
: কেমন?
হামীম : ম্যাজিক রিয়েলিজম আর জাদুবাস্তবতা এক বিষয় নয়। ম্যাজিক রিয়েলিজমের বাংলা হচ্ছে জাদুবাস্তববাদ।
: ধুর ভাই, কী যে বলেন! দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ম্যাজিক রিয়েলিজমের বাংলা করেছেন জাদুবাস্তবতা। অথচ আপনি কিনা...।
হামীম : আমি সেসব অধ্যাপকের লেখা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না। যাই হোক, ঐ লেখকের লেখায়, আপনি যে লেখকের কথা বললেন, কোথায় আপনি ম্যাজিক রিয়েলিজম খুঁজে পেলেন?
: আমি খুঁজে পেয়েছি এটা তো বলিনি ভাই।
হামীম : আমিও তো খুঁজে পাইনি।
: কিন্তু লোকে যে বলে?
হামীম : লোকে তো কত কিছুই বলে। আপনি লেখক। লোকের কথা আপনি গ্রহণ করবেন কেন। আপনি বিচার-বিবেচনা করবেন না? দেখুন, ঐ লেখক আসলে চেতনাপ্রবাহের রীতি অনুসরণ করেছেন। জাদুবাস্তববাদী আবহ তিনি যতটা ব্যবহার করেছেন, বাস্তবের অন্তর্নিহিত জাদুময় বাস্তবতা পরিস্ফুটনে তিনি ততটা সফল হননি।
: ঠিক বলেছেন। এক আড্ডায় আমি ঐ লেখকের লেখায় ম্যাজিক রিয়েলিজম নেই, এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে জনৈক অধ্যাপক হেসে দিলেন। আড্ডাশেষে তিনি আরেকজনকে আমার সম্পর্কে বললেন, আমি একটা অকাট মূর্খ। লেখাপড়া কিছু নাই আমার। আমি শুনে গেলাম। তর্কে যাইনি। কারণ, লালন সাঁই বলেছেন, আপন সাধন কথা না কহিও যথাতথা।
.

: অমিয়ভূষণ মজুমদারের লেখায় কি আদৌ ম্যাজিক রিয়েলিজম আছে? তিনি তো বলেছেন তাঁর ‘তাঁতী বউ’ গল্পে ম্যাজিক রিয়েলিজম রয়েছে।
হামীম : অমিয়ভূষণ মজুমদার জাদুবাস্তববাদের উদ্দেশ্যটিকে স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু এই সময়ে জাদুবাস্তববাদ বলতে যা বোঝায়, সেটিকে তিনিও অবিশ্বাস্য বা অতিপ্রাকৃতের সঙ্গে একাকার করে দিয়েছেন। তিনি তার নিজের এবং যে যে রুশ উপন্যাসে জাদুবাস্তববাদ থাকার কথা বলেছেন এবং যে যে অর্থে বলেছেন, সেটি কোনোভাবেই প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে জাদুবাস্তববাদের আওতায় পড়ে না।
: আচ্ছা, বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম (জাদুবাস্তববাদ) আছে কিনা, সে বিষয়ে তো কিছু বললেন না?
হামীম : দেখুন, এ কথা এখন জোর দিয়ে বলা দরকার যে, বাংলার প্রাচীন সাহিত্যের ভেতর জাদুবাস্তববাদের লক্ষণ, আভাস বা বৈশিষ্ট্য খুঁজলে তা হবে আরোপিত। তদুপরি সাম্প্রতিক সময়ে বারবারই বাংলার প্রাচীন সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা সন্ধান করার মানসিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আপনি জানেন যে, জাদুবাস্তবতা আর জাদুবাস্তববাদ এক নয়। জাদুবাস্তবতা সব সময় সর্বত্র ছিল, কিন্তু জাদুবাস্তববাদের মাধ্যমে সেটিকে সচেতনভাবে শনাক্ত করার ব্যাপারটি সাম্প্রতিক। জাদুবাস্তবতাকে অনেক সমালোচকই জাদুবাস্তববাদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছেন। তারা জাদুবাস্তবতা বলতে জাদুবাস্তববাদকেই বুঝছেন বা বোধ করেছেন যে, জাদুবাস্তববাদ মানেই জাদুবাস্তবতা। এ জন্য প্রাচীন সাহিত্যের অলৌকিক বিষয়সমূহকে বর্তমানের জাদুবাস্তববাদী দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলেও এটি আসলে যুক্তিযুক্ত নয়। সেসবে আমরা জাদুবাস্তবতার লক্ষণ পেতে পারি মাত্র, কিন্তু সেগুলো জাদুবাস্তববাদী সাহিত্য নয়।
: রূপকথা ও জাদুবাস্তববাদের ফারাকটা কোথায়, ব্যাখ্যা দেবেন?
হামীম : রূপকথায় জাদুর ভেতরে প্রসঙ্গত বাস্তব পরিস্থিতি হাজির হয়, আর জাদুবাস্তববাদে বাস্তবতার ভেতরে জাদু তৈরি হয়। রূপকথা অসম্ভবকে সম্ভব করে, আর জাদুবাস্তববাদ সম্ভবকেই অসম্ভব করে, কিন্তু সেটা সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবের দিকেই ফিরে আসে। কারণ এর অন্তর্নিহিত সত্যের কারণে তা প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
: বেশ বলেছেন। রূপকথা যদি জাদুবাস্তববাদ হতো, তাহলে তো ঠাকুরমার ঝুলি আর ভৌতিক কল্পকাহিনিগুলোতেও জাদুবাস্তববাদ রয়েছে। যাই হোক, বোঝা গেল যে, আপনি আমার সঙ্গে কিংবা আপনার সঙ্গে আমি একমত। রূপকথা ও ম্যাজিক রিয়েলিজমে বিস্তর ফারাক।