কবি মোস্তফা মীর স্মরণে (১৯৫২-২০১৮)

শশী হক

প্রকাশিত : মে ২৮, ২০১৮

মীর ভাই মানুষটা কিন্তু খারাপ না, একটু বেখাপ্পা ধরনের, ক্ষ্যাপা, তার ছিঁড়া। বাট আই লাইক দিজ ক্যারেক্টার। সবাই ভাবে, পয়লা বউ ভেগে যাওয়াতে বা উল্টাপাল্টা জীবনযাপনে বা লাগাতার দারিদ্রে এই দশা। তা কিন্তু না। ক্রাইসিস্‌টা অন্যখানে।

মোস্তফা মীর লেখক হতে চেয়েছিল, যারে কয় সিরিয়াস লেখক, এবং সত্তুরের সেরা কবি। তয় প্রকাশকরা শেষমেশ তারে তা হইতে দেয় নাই। লোভাইয়া ভুলাইয়া ফুলটাইম অনুবাদক বানাইছে। তার ছিঁড়া বানাইছে। বানাইছে জিব্রান, পুরাণ আর ক্লাসিক-সেক্স বিশেষজ্ঞ। ট্র্যাজেডিটা এইখানে।

জিব্রান ক্যান? কারণ উহা আরবি বিভাগগুলিতে পাঠ্য, প্রতিবছর বেচাকেনা চলে দেদার। এখন আর জিব্রানের কোনও লেখা নাই যা মীর অনুবাদ করে নাই। চিঠিপত্রও, চিরকুটও, অনুবাদ করতাছে।... পুরাণের ফ্যান্টাসির তো একটা কন্সট্যান্ট মার্কেট আছেই, তবে রমরমা ব্যবসা অই পলিশড সেক্স-বুকের।

কামসুত্রকলা, পারফিউমড গার্ডেন, অনঙ্গ রঙ্গ, আন্ডারস্ট্যান্ডিং সেক্স কিংবা চীনা পৌরাণিক যৌন গল্প— এই জাতীয় লেখালেখির চাহিদা ব্যাপক। মীর নিষ্ঠার সাথে সেইসব অনুবাদ করে আর প্রকাশকের চাহিদা মেটায়। বাঁচতে তো হইব!

লেখক-সত্তা বলতে যা বোঝায় তা আর এখন মীরের মধ্যে নাই, একটা কঙ্কাল বেঁচেবর্তে আছে, শুধু এটুকুই। ভোরে ওঠেন নামাজ পড়েন, কাশেন, রুটি খান, তারপর একটা স্টিক ফাটায়ে বইসা যান অনুবাদ করতে। করলেই তো পয়সা, পার ফর্মা দুই হাজার, কম কী? সংসারটা তো টিকা আছে, নাকি? কিন্তু মুস্তফা মীর লেখক হইতে চাইছিল, সিরিয়াস লেখক। এই দুনিয়া তারে তা হইতে দিল না। তাই দিনভর দুনিয়ারে গাইল্লায়, মানুষের গুষ্ঠি উদ্ধারে— সব চোর-বাটপার, ছোটলোক সততা বলে কিছু নাই, সব বোগাস... পড়ে কে? সাহিত্য বোঝার লোক কই?... এখন যারা লেখে তারা তো শুদ্ধ কইরা বাংলাও লিখতে জানে না, কবিতা লিখব কী?… কইতে কইতে ঠোঁটে কষ জমে, হাঁপায়, তবু মেশিন থামে না। পাবলিক মজা লয়, বিরক্ত হয়, মায়া করে। আফটার অল লেখক তো। কবি তো।

জিব্রান অনুবাদ করতে করতে মীর ভাই এখন নিজেই যেন জিব্রান, আর আমি জিব্রানের জিনটারে দেখি তার কঙ্কালে। মীর এখন যাই ভাবে যাই লেখে জিব্রানের বাইরে যাইতে পারে না, জিব্রানের আত্মা যেন মীরের লেখক সত্তারে আছর করছে— যার মাস্টার প্ল্যানার ওই বাইনচত প্রকাশক। শালারপো এইটা কিন্তু ভালো বোঝে যে, লেখকটারে পুরাপুরি মাইরা ফেলন যাইব না, তাইলে ডিম পারব কেডা? তাই অনুবাদের ফাঁকে ফাঁকে ঝলক দেয় কিছু মৌলিক গ্রন্থ। শালায় মীর ভাইরে বুঝায়, বাংলা সাহিত্যে যৌন-মনস্তাত্ত্বিক লেখা নাই, আপ্নিই পারবেন। উত্তেজিত মীর তাইতে লেখে ‘আমার শয্যা সঙ্গিনীরা’ আর ‘শ্রীমতী নগর’ উপন্যাস। খানকির পোলা কয়, রাজনৈতিক দর্শনের উপন্যাস লেখেন, কয়জন পারে? ফ্রিডম কিন্তু আপনার। ফলে মীর ভাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎসর্গ করে রচে ‘এখানে স্বপ্ন বিক্রি হয়’— যেখানে নায়ক স্বপ্ন ও সততার প্রেস্কিপশন, নববিপ্লবী, প্রেমী, এবং জিব্রানের প্রফেটিক ভাষায় কথা বলা এক তরুণ দার্শনিক… লেখকটারে তো বাঁচায়ে রাখতে হবে।

বুঝলেন সরকার, বাজারি অনুবাদ একটা ভয়ানক জিনিশ, একেবারে চাক্ষুষ দেখাইল মালিক। এই ধরেন এখন হয়ত মীর ভাইয়ের লুইচ পাবলিশার ফুওয়াং ক্লাবে টুং টাং হুইস্কি আর পার্টি-গার্ল লইয়া ফুর্তি মারতাছে, আর ওইদিকে দেখেন গিয়া লেখক মীর স্যাতস্যাতা ঘরটায় বইসা মশা তাড়াইতেছে, আর ভাবতাছে, এই সপ্তাহে ত অনুবাদের আড়াই ফর্মাও শেষ হয় নাই, বাড়ি ভাড়া বাকি, কারেন্টটা কখন আইব, একটা স্টিক ধরাইলে মন্দ হয় না, লিখলেই তো পয়সা, আহ্‌ শরীর যে চলে না, লিভার নষ্ট, আলসার ,পাইলস, কত কী কষ্ট…. মীর ভাই, বুঝলেন সরকার, আসলে লেখক হইতে চাইছিল, অনুবাদক না, কিন্তু প্রকাশকরা তা হইতে দেয় নাই। চুইসা নিয়া গেছে সব। কিচ্ছু রাখে নাই, কিচ্ছু না। তাই শূন্যতা বাজে, অল্পতেই বাজতেই থাকে। আই লাইক দিজ ক্যারেকটার। আই লাভ হিম।

তা, সত্তুরে কিছু সিরিয়াস কবিতা ত মীর লিখছে, ‘কুকুরকুঞ্জ’, ‘দানববংশ’ বা ‘ঈশ্বরের ঘ্রাণ’-এর মতো মৌলিক উপন্যাস ত তার আছে। বুঝলেন সরকার, আপনার লেখা কিন্তু মীর ভাই খুব লাইক করে, আপনার উপর লিখবও বলছে, আর আপনিও নাকি লিখবেন? তয় কে আগে কে পরে এইটাই সমস্যা! কী কন, হা হা হা হা ... চলুন পার্কে যাওয়া যাক্‌।