কবিতা কেন লিখি

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০১৮

কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলিতে এই প্রশ্নের জবাব দেয়া সহজ ছিল। কিন্তু যতেই দিন যাচ্ছে, যতেই জড়িয়ে যাচ্ছি কবিতার সঙ্গে, ততেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর। কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলিতে শুধু কি কবিতা লিখতাম? প্রেম করা, গান গাওয়া, এরকম আরেও কত কাজে ছড়িয়ে পড়েছিল আমার হৃদয়। যৌবনের অফুরন্ত শক্তির প্রতাপে তখন যাতেই হাত দেই, তাতেই সোনা ফলে। আর কী দৃপ্ত সব প্রতিজ্ঞার দল!
তারপর গড়াতে থাকা দিনগুলির সাথে সাথে ঝরে গেছে অনেক কিছু। আর তাতে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হতে হতে যা থেকে গেল, অর্থাৎ কবিতা, সেই-ই হয়ে উঠল প্রগাঢ়তম বন্ধু। কিন্তু কবিতা কেন থাকে? কবিতাকে যে ভালোবেসেছে, কবিতার সঙ্গের স্বাদ যে পেয়েছে, সে আসলে কবিতাকেই বিয়ে করে ফেলে শেষপর্যন্ত। আর কবিতাও ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে, জানে যুগ্ম হয়ে জীবন কাটাতে। তাই এই জুটির বিচ্ছেদ হয় না সচরাচর।
এখন দীর্ঘদিন দাম্পত্য জীবন কাটানো কোনও জুটির কাউকে যদি বলা হয়, সঙ্গীর জন্য এতকিছু করেন কেন? মনে হয় না কোনও জুটিই এর স্পষ্ট কোনও উত্তর দিতে পারবে। পরস্পরের জন্য মমতা, প্রেম, ভালোবাসায় মাখা এরকম জুটি বোকার মতো হেসে হয়তো বলে বসবে, জানি না তো। কবিতা কেন লিখি, এর উত্তরও আমার কাছে এই জানি না তো`র মতো।
আসলে কবিতা লিখি বিভিন্ন কারণে। আর এইসব কারণ মিলে মিশে এমন একটা কারণসমূহের দলা তৈরি করেছে, যাদের আলাদা করতে গেলে কেঁচি, চিমটা, এসব নিয়ে বসেও কূল পাওয়া যাবে না। কিন্তু সারমর্ম বলা যাবে। সেই চেষ্টায় নামার পর দেখা গেল, কবিতা মূলত দুই কারণে লিখি। এক নম্বর কারণ হলো, আমার কবিতাকে আমার পছন্দ মতো সাজাতে চাই। কে না তার সঙ্গীকে, তার বন্ধুকে, তার একেবারে নিজের করে নেয়া জনকে নিজের মতো করে সাজাতে ভালোবাসে? এজন্য আমিও আমার কবিতাকে সাজাই নিজের ভাবনায়, নিজের শব্দে, নিজের বৈশিষ্টে যেন নিজের কবিতার মুখোমুখি হলে আমি চোখের আরাম পাই। ঘনিষ্ঠ হবার আকাঙ্ক্ষায় ডুবে যাই। মনে করি যুগ্ম জীবনটা তো বেশ ভালোই। অবশ্য এটা কবিতা লেখার একেবারেই শারীরিক কারণ। কিন্তু শরীরে তো কবিতা থেমে থাকে না। কেননা সময় বলে একটা বিষয় আছে। সে বেচারা সব শরীরকেই পুরানো করে ফেলে। ব্যবহৃত হওয়ার ভাঁজের জন্ম দেয়। আয়ু ফুরিয়ে যাওয়া মানুষের দুঃশ্চিন্তার মতো কবিতারও এই দুঃশ্চিন্তা আছে। সেও ভাঁজ ভালোবাসে না, থাকতে চায় টানটান, পরিপাটি। তাই সঙ্গীকে শারীরিকভাবে সবসময় যৌবনের রঙ মাখিয়ে রাখতে সৌন্দর্য চর্চার সাম্প্রতিকতম কৌশলগুলিকেও শিখে নিতে হয় আমাকে। নইলে যে নিজেই নিজেকে বিরক্ত করে ফেলবো।
শরীরের পরে আরেকটা মোটা কারণে কবিতা লিখি আমি। সেটা হলো, বস্তুপুন্জের আর্তনাদের শব্দ বোধগম্যতায় অনুবাদ করতে। এই বিপুল মহাবিশ্বে অজস্র শব্দ হচ্ছে প্রতিমূহূর্তে। জ্বলে যাবার, ভেঙে যাবার, যুক্ত হবার এইসব শব্দস্তূপের প্রায় কিছুই কোনও কর্ণকুহরেই পৌঁছায় না, কেননা মাধ্যম ছাড়া শব্দ অচল। কিন্তু মহাবিশ্বে মাধ্যম পাবে কোথায়? পৃথিবীতে বাতাস আছে বলে যেমন আমরা শুনতে পাই, তেমনি মহাবিশ্বের শব্দ শোনার কাজটা আমি করি আমার কবিতা দিয়ে। অর্থাৎ আমার কবিতাও একটা মাধ্যম। জীবন কি এবং এর অর্থই বা কি, তার কিন্চিত আভাস আমি পেয়েছি আমার কবিতার ভিতর দিয়েই।
জীবন জড়জগতের অটোমেশন। যে জগত চলতে পারে না, ছড়াতে পারে না, বাসনায় ঝলসাতে পারে না, তার আকাঙ্খা থেকে তৈরি একটা চলনক্ষম, অনুলিপি তৈরিতে সক্ষম এবং বাসনায় জর্জরিত হওয়া মূর্ততার নামই জীবন। জড় তার সব আকাঙ্খার পরিতৃপ্তি ঘটায় এই জীবন দিয়ে। ফলে জীবনকে জড় সমাজের মেম্বার অফ পার্লামেন্ট বলা যায় সহজেই। বলা যায়, জড়ের রুদ্ধবাকের মুক্তি। কবিতাও মূলত এই মুক্তিই। জীবনানন্দ যে বলেছিলেন, কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুই উৎসারণ। সেটা তো আর এমনি এমনি না। এই কবিও টের পেয়েছিলেন জীবনের মৌলিক সংজ্ঞাটিকে। কবিরা প্রত্যেকেই টের পায়। আর এটা টের পাওয়ার পরেই কবির হৃদয়ে ভাষার জন্ম হয়, সেই ভাষার, যা বিগ ব্যাংয়ের মহাবিস্ফোরণের বর্ণমালায় গাঁথা জড়ের আর্তনাদ। আইনস্টাইনের অঙ্কে এই ভাষার প্রতিধ্বনি ধরা পড়েছিল। মানমন্দিরের যন্ত্রে ধরা পড়েছে তার প্রতিলিপি। বড় একা, বড় নিঃসঙ্গ এই ভাষা। আর তারই অনুকরণে মানুষ যে কতরকম ভাষা তৈরি করেছে, চেষ্টা করেছে ওই আর্তনাদের সবচেয়ে কাছাকাছি অনুবাদটিকে শব্দের কম্পাঙ্কে ধরতে! কবিরাও সেই চেষ্টাই করে, আমিও করি। তারপরেও কি ধরতে পারি? আর এই না পারার ব্যর্থতার যন্ত্রণা সইতে সইতেই একদিন বুঝেছিলাম, এই ডিকশনারি রচনা আসলে সম্পাদকমণ্ডলির মতো কবিমণ্ডলির কাজ। আয়ুর খর্বতায় একা কেউই সামলে ঊঠতে পারে না এর গ্রন্থনা। একা কোনও সময়ও না, কেননা সময়ও লাগাম পরা ঘোড়াই শেষপর্যন্ত। তাই এর জন্য চাই সময়গ্রন্থির সকল কবির সমাবেশ। এবং আমার কাজ আমার সময়ের কম্পাঙ্ক মাপা। মোটা দাগের যে কারণের কথা আমি বলেছিলাম সারমর্মের খাতিরে, সেটা এটাই।
কবিতা শব্দ শোষার লিটমাস। ছাপাখানায় যে বইয়ের ভিতরে সে জায়গা করে নেয়, সেখানেও যুক্ত হয় ছাপার মেসিনের শব্দ। ফলে কবিতার বইয়ের মলাট খুললেই ঝনঝন করে ঝরে পড়তে থাকে তার গিলে নেয়া শব্দগুলির হাড়গোর। বোন মিউজিক। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আমার মৃত বন্ধু আহমেদ মুজিবের প্রেসের কবিতার কথা। কত লোক যে এই শব্দযুগলকে ভেবেছে প্রেমের কবিতা! আর মুজিব কেবল যন্ত্রণা সয়েছে। অবশ্য কবিকে এই যন্ত্রণা সইতেই হয়, কেননা কবিতা তো কম্পাঙ্ক নিয়েই খেলে। এই খেলায় নেচে বেড়ায় তাল আর লয়ের বিট। যেন হাতি খেদাতে নেমেছে একদল মানুষ। ক্যানেস্তারা বাজছে আর হাতি ছটফট করছে অস্থিরতায়।
কোলাহল, গণ্ডগোল, হট্টগোল- সবই আমার প্রিয়। কারণ এরা সবাই শব্দের কারখানা, শব্দের জাগলার। এদের সামনে আমি কেবল কান পেতে থাকি আর লিটমাসের মতো শুষে নেই এদের রস, আনন্দ আর ক্লান্তির।