অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

কবিতা রান্নার রেসিপি

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮

দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছি। আর লিখতে লিখতে অভিজ্ঞ শেফের মতো আমিও শিখেছি কবিতা রান্নার বিভিন্ন কৌশল। ফলে এখন আমি একটা কবিতা রান্নার বই লিখে ফেলতেই পারি- এই কথা মনে হয় মাঝেমাঝে।

কবিতা যে রান্নার মতোই একটা শিল্প, সেটা আমার মাথায় প্রথম ঢুকিয়েছিলেন বিনয় মজুমদার। সেই থেকে যখনই কবিতা লিখি- ভাবি, ব্যাপারটা কি করে হলো। সেই ভাবনাগুলিই জড়ো হতে হতে এবং তাদের সাধারণীকরণ হতে হতে কয়েকটা মূল বিষয় বুঝতে পেরেছি আমি। সেগুলি হলো হৃদয়ের তাপ, আবেগের মশলাপাতি আর বোধের লবণ- এরাই কবিতাকে স্বাদু খাবারে পরিণত করে। এই বিষয়গুলির ওপর ভিত্তি করেই আমি এই কথা বলবার অধিকার অর্জন করেছি যে, আমি দুইভাবে কবিতা লিখতে বা রান্না করতে পারি।

একভাবে কবিতা লেখার জন্য আমাকে বাজার করতে হয় পৃথিবীর বস্তুজগত থেকে। বস্তুজগতের এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে অণু পরমাণু থেকে মানুষের সম্পর্ক পর্যন্ত সবকিছু মেলে। আমার রেসিপির ধরণ অনুযায়ী যা যা দরকার- ব্যাগভরে কিনে নেই। আর কিনি তাদের জন্য প্রয়োজনীয় মশলাপাতিও। শুধু এসব কেনাকাটার আগে বস্তুজগতের মধ্যে ভেসে বেড়ানো দৃশ্যসমূহের কোনও একটা আমার চোখে ময়লার মতো ঢুকে যায়, চোখ কড়কড়াতে থাকে আর আমাকে বলতে থাকে- আমাকে দেখ, আমাকে দেখ। আর সেই দৃশ্যটাকে দেখার পরই আমি বুঝতে পারি- আজ আমার কি খেতে এবং খাওয়াতে ইচ্ছা করছে। এটা অনেকটা বৃষ্টির দিনে খিচুরি খাওয়ার ইচ্ছা জাগার মতোই।

এরপর ইচ্ছা ও বাজারসদাই নিয়ে বাসায় ফিরে আমি রান্নাঘরে ঢুকি এবং প্রস্তুতি নেই দৃশ্যটাকে রান্না করার কাজে নামার। তারপর একটা সময় কাটে চরম ব্যস্ততার মধ্যে। সেসময় আমার মস্তিষ্কের কোষগুলি তৎপর হয়ে ওঠে গোয়েন্দাদের মতো, রক্তে তৈরি হয় নতুন নদীর স্রোত আর আমার চোখ চঞ্চল হয়ে খুঁজতে থাকে সিঁড়ির ধাপের ধারাবাহিকতা। তখন আমি দৃশ্যের শরীরে মাখি আবেগের মশলাপাতি আর বোধের লবণ এবং তাকে বসিয়ে দেই হৃদয়ের তাপে উষ্ণ হয়ে পড়া আমার কবিতার খাতায়। এখন সে পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত।

খুব সহজ ও সাধারণ আমার এই রন্ধন প্রক্রিয়া। যে কেউ এটা চেষ্টা করে দেখতে পারে। তাহলে হয়তো হোটেলে আর যেতেই হবে না খাবার কিনতে। তবে মাত্রাজ্ঞান থাকতে হবে টনটনে, নইলে রান্নার সময় পুড়ে যেতে পারে দৃশ্যের মাংস। তাহলে নিজের খাওয়াতো হবেই না, পুড়ে যাওয়ার সেই ঝাঁঝালো ও উৎকট গন্ধ বাড়ির লোকদের এবং পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনকেও অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে গালিগালাজ তো শুনতে হবেই, ব্যর্থতার হতাশাও ভোগাবে নিশ্চয়ই। তবে পরাজয়ে ডরে না বীর- তাই আরেকদিন আরেকবার আরেকটা কোনও দৃশ্য নিয়ে রান্না করতে বসাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অতি পাকা রাঁধুনিও মাঝেমাঝে প্রত্যাশামাফিক রান্না করতে পারে না। আর কবিতার বেলায় তো এটা সর্বৈব সত্যি যে, ব্যর্থতাতেই ভরা থাকে অধিকাংশ দিন। তারপরও চর্চা ছাড়া যাবে না- ব্যায়ামেই পুষ্ট হয় সব মাংসপেশী।

এবার বলি আমার দ্বিতীয় কৌশলটার কথা। এই কৌশলের উপাদান থেকে প্রক্রিয়া- সবকিছুই তৈরি হয় আমার মস্তিষ্কে। তাই বলে এরা কেউই কিন্তু আকাশকুসুম না। সেটা সম্ভবও না- কেননা মানুষ যা কিছু ভাবে, যা কিছু চিন্তা বা কল্পনা করে- সবকিছুর ভিত্তিই বস্তুজগত থেকে ধার করা। এছাড়া সে আর পাবেই বা কিভাবে কল্পনার উপাদানগুলি। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন- পক্ষীরাজের বস্তুগত ভিত্তি কি? খুবই সদাশয় প্রশ্ন, কিন্তু মনে রাখতে হবে পক্ষীরাজ যা দিয়ে তৈরি, অর্থাৎ ঘোড়া এবং পাখা- দুইই কিন্তু বহাল তবিয়তে বস্তুজগতে আছে। আমাদের কল্পনা কেবল তাদের যুক্ত করে আকস্মিকতার সাথেসাথে নিজের প্রতিভারও পরিচয় দিয়েছে। আমার দ্বিতীয় কৌশলটাও এই রকমই। বস্তুজগতের আপাত সামঞ্জস্যহীন বিভিন্ন টুকরাকে জোড়া দিয়ে একটা নতুন অর্থের, নতুন প্রায়োগিক ক্ষমতার এক নতুন প্রতিনিধি তৈরি করি আমি। হয়তো পৃথিবীর প্রচলিত কোন ডিকশনারি তাকে চেনেনা, হয়তো কোন ভাষাই তার অন্তঃপুরে ঢুকতে দিতে চায় না এই বিধর্মীকে- কিন্তু আমার পাকস্থলী, জিহ্বা তার স্বাদ এবং পুষ্টিগ্রহণে ভয় পায় না একটুও। পাকপ্রণালীতে ছেপে দেয়া নতুন রান্নার মজাটাইতো এখানে। পৃথিবীর সব প্রচলিতকে আরেকটু বেশি ব্যাসার্ধ দেয়া, তার কারিকুলামে আরেকটু বেশি অভিজ্ঞতা যোগ করাই এই নতুনের কাজ। আর এই নতুনের স্বাদটা যদি ভালো লেগে যায় অন্যদের কাছেও, তাহলে তো কথাই নেই। কল্পনার ফ্ল্যাট থেকে সে নেমে আসার সুযোগ পায় বস্তুজগতের বস্তিতে। এতে রাঁধুনিরও জোটে আত্মতৃপ্তির আনন্দ। কে না চায় তার রান্নাঘরের ছোট্ট পরিধি থেকে আরো আরো রান্নাঘরের বিস্তীর্ণতায় ছড়িয়ে পড়তে!

তবে আমার এই দ্বিতীয় কৌশলে হৃদয়ের তাপ, আবেগের মশলপাতি আর বোধের লবন কিন্তু ঠিকই যোগ করতে হয় রান্নার সময়। কোনও কিছুকে রান্না করা মানে তাকে তার অন্তর্গত থেকে বের করে এনে পরিবেশনের উপযোগী করে পরিপাকের সহায়ক করে তোলা। এটা করতে গেলে ওই তাপ, মশলা আর লবণ ছাড়া চলবে না। ফলে মহাশূন্যের হিমশীতল ডিপফ্রিজ থেকে জমাট বাঁধা বস্তুসমূহের টুকরাগুলিকে বের করে এনে মানসের গোচরীভূত করতে আমাকে হৃদয়, আবেগ আর বোধের সহায়তা নিতেই হয়। তখন বস্তুজগতের টুকরাগুলি আবেগে ছটফট করে ওঠে, উষ্ণতা পেয়ে খুলে ফেলে শীতের কঠোর পোশাক আর শরীরে লবণ মেখে নোনতা হয়। পৃথিবীতে জীবন কাটানো প্রাণগুলিতো এই চেহারাটাকেই চেনে। মনে করে তাদের পড়শী। কবিতার চেয়ে ঘনিষ্ট পড়শী প্রাণের আর কি আছে!

কবিতা রান্নায় আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমি নিজে। যেকোনও রান্নায় রাঁধুনি একটা বড় বিষয়। তার চরিত্রই ঠিক করে দেয় রান্নাটা কেমন হবে। কবি মূলত জনতার কাতারের মানুষ। পৃথিবীতে থেকে যাওয়া সর্বাতীত কালের সব কবিতাই জনতার স্মৃতির মাচায় বড় হয়, বেঁচে থাকে। কিন্তু সময়গ্রন্থির কোথাও কোথাও নিজের প্রতিভার ক্ষমতা টের পাওয়া কোন কোন কবি রাজন্য মনোরন্জনে লিপ্ত হয় জনতার সামান্য দানে তুষ্ট হতে পারে না বলে। আরে, জনতাতো উপার্জনই করে সামান্য, ফলে তার দান আসলে তার হৃদয় থেকে ছিঁড়ে নেয়া একেক টুকরা মাংসের মতো- যেখানে কাউকে দান করা মানেই অন্যকে বন্চিত করা। যে কবির চিন্তা থাকে সঞ্চয়ের, তাকে তো এই দান তুষ্ট করতে পারবেই না। ফলে তার পথ বেঁকে যায় রাজসভার দিকে।

আমি মানি, রাজন্যের রান্নাঘরে পাচকের চাকরিটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রাজারা অনেক কিছু খায়, স্বাদ জানে অনেক কিছুর। অথচ জনতার রান্নাঘরে প্রতিদিন বাজে একঘেঁয়ে পথ্যের সুর। ফলে রাজাদের রান্নাঘরে রেঁধেও সুখ। সেখানে চমক তৈরির মতো মজা আর কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু যাই রাঁধি না কেন- রাজারা কি বিস্মিত হয়? তাদের জিহ্বা এতো রকমের স্বাদের সঙ্গে পরিচিত যে, কোনও রাঁধুনির পক্ষে বিস্ময়ের জন্ম দেয়া আসলেই কঠিন। অথচ যারা প্রতিদিনই একই খাবার খেতে খেতে ভুলে গেছে অন্য সব কিছুর কথা, তারাই তো বিস্ময়ের অর্থ জানে, জানে মুখের স্বাদ মনে রাখার সরলতম উপায়।
লাভক্ষতির হিসাবে রাজন্যের চুলার তাপে নিজেকে তামাটে করতে চাই না আমি। চাই ফেলে দেয়া এবং অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলি দিয়ে নতুন কোন রান্না আবিষ্কার করতে। আমি নিশ্চিত, আমার মা লাউয়ের চোকলা ভাজার রান্নাটা জানতোই না, যদি আমার বাবা রাজন্যের রান্নাঘরের দিকে হাঁটতো। সামান্য কালোজিরার প্রয়োগে এই লাউয়ের চোকলা ভাজা যে কতটা সুস্বাদু- সেটা আমিও জানতাম না আমার বাবার সন্তান না হলে। কী আশ্চর্য! পৃথিবীর শত শত রাজা এই খাবারের নামই শোনেনি।

কবিতার মজাও এইখানেই। কবি স্বধর্মচ্যুত না হলে একেকটা নতুনত্বে ভরা দিনের সে মুখামুখি হয়। আর স্বধর্মচ্যুত কবি একলা বসে থাকে সোনার পিঞ্জিরায়। সেখানে সুখ হয়তো আছে, কিন্তু বিস্ময়ের বড়ই অভাব। আমি ভাই মৃত্যুকেও বিস্ময়ের চোখেই দেখতে চাই।