কবিতার বই

ফারুক ওয়াসিফ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০১৮

প্রথমে ভেবেছিলাম, নাম হবে তমোহা ডুমুর। যে ডুমুর অন্ধকার শুষে নিয়ে তার গর্ভে ফুল ফোটায়। তারপর ভাবলাম, নাম হওয়া উচিত মরিয়ম পাথর, যার ওপর যিশুর জন্ম হয়েছিল। যে পাথর অন্ধকার শুষে নেয়, মানে হাজরে আসওয়াদ। শেষে যা হলো তা এই, তমোহা পাথর বইটা এবারো বেরুচ্ছে না। গতবারো এই সার্কাস করেছি। আসলে আমার জীবনের ওই দশা নিয়ে আমি আজো নিশ্চিত নই, তাহলে সে সময়ে নিমজ্জিত কবিতাগুলিরে কেমনে অপ্রস্তুত অবস্থায় ভাসাই? বরং কবিতার এই বইটা বেরুক এবার।
কিন্তু এর নামই বা কী দেব? গদ্যকবিতা সব; নামহীন, সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত। এ তো বেনামা। পরে আবার ভাবলাম, জীবন এক জ্ঞানভয় নাম হোক। গন্ধম থেকে শুরু করে আজ অবধি জানার ভয়ে তটস্থ থাকি না কি? মনস্থ আর হতে পারলাম কই?
আপাতত জীবন এক জ্ঞানভয়ই থাকুক, দুদিন পর, পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে গেলে নাহয় কোনো না কোনো নামের জামাইয়ের হাতে বইটা সোপর্দ করা যাবে। পৃথিবীতে নামের আড়াল এক কৌশল। এ এড়াতে পারলে ভাল হতো বোধহয়।
যাহোক, আসন্ন সেই কবিতার বইয়ের প্রথম কবিতা হিসেবে একে সাব্যস্ত করেছি।

এক.
রক্তের কপাট খুলে আমি না হয় আর না থাকি। অভঞ্জনীয় আলোয় জেগে না উঠি নগরীর মতো। আমার সত্তার সুর নিশিন্দারা, এ পাখায় মাটিডালি ও পাখায় শান্তাহার— রোদের কুচন্দন মাখা কপাল আমার। আমি এক অহেতুক বিরাজ করা নাম— আধচেতা বন। নিখিলের হাপর থেকে বয়ে আসে বায়ু, ডেকে ওঠে পাখ আমার ভেতর।
এখানে বৃক্ষ ও বাতাসের থিতি। সামুদ্রিক শ্বাসের শেষ বন্দর। আকাশের দিকে উন্মুখ পাহাড়ের মতো আমিও বিস্তারিত সন্ধ্যাদেশে।
এ দেহ অনেক বাতির বাসনায় জর্জরিত এক শহর। মন এক গ্রাম। শিয়রে রেখে ক্ষয়শীলা চাঁদ, ঘুমাতে পারে সে বর্ষণে ক্ষতবিক্ষত আকাশের নিচে। আমি জেগে থাকি না এ বিশ্বে; রাজধানীগুলির মতো ভয়ে ও প্রতাপে। আমি চুপচাপ ভাষার মতো অশরীরী হয়ে যাব। মান্ধাতার কোনো এক ভাষায় খুলব মূক ও বধির শ্রেণীর বালিকাদের ইস্কুল। সে ভাষার ছায়াপথে ঢেউকাঞ্চনের ফেনা। নদীর থরে থরে পোনা মাছেদের তুরন্ত ঝাঁক, হেমন্তের মেঘেদের থইথই ছায়া। তার পিঠ ছুঁয়ে নেচে যায় কোনো কোনো পাখি।
সে ভাষার চেতনজ্বরা সইবে বাক্য আমার ।
ক্ষতমুখের মতো আমি আর না জেগে থাকি। এক গ্রামীণ রাত্রি নামুক আমার ভাষায়।