কবিদের নিয়া বড় বিপদ

কামরুল আহসান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৮

কবিদের নিয়া বড় বিপদ। এরা খুব বিভ্রান্ত করে মানুষকে। বিভ্রান্ত করে কারণ এদের ভাষাজ্ঞান খুব কম। অনেকে শুনলে আশ্চর্য হতে পারে, কবিদের ভাষাজ্ঞান কম! ভাষা নিয়েই তো তার কারবার। আসলে ভাষা না, তার কাজ শব্দ নিয়ে, দৃশ্য নিয়ে, অনুভূতি নিয়ে। তিনি জানেন কোন দৃশ্যের সাথে কোন অনুভূতি মিলিয়ে কোন শব্দ ব্যবহার করলে তা মানুষের মনে ঝংকার তুলবে। তার শব্দ ব্যবহারে চিন্তা খুব কম। বরং বিশৃঙ্খলতা বেশি। এ কথাও সত্য যে মানুষের চিন্তার জগতও খুব বিশৃঙ্খল। তবু সেই বিশৃঙ্খল চিন্তার জগতকে একটু শৃঙ্খলা দিয়ে মানুষ বাঁচতে চেষ্টা করে। সুশৃঙ্খল হয়তো তাতে হয় না, তবু ওই চেষ্টাটাও একটা বড় ব্যাপার, টিকে থাকার জন্য।

আমার মনে হয় এই জন্য সাধারণ মানুষ কবিদের খুব পছন্দ করে না, পছন্দ করে না মানে তার কাছে ভিড়ে না, তাকে পড়ে না। কবিদের হাতে পড়ে তাদের শৃঙ্খলা ভাঙতে চায় না। আর কবিদের প্রধাণ প্রবণতাই হচ্ছে শৃঙ্খলা ভাঙ্গা। রাষ্ট্রও এই জন্য কবিদের খুব পছন্দ করে না, কারণ কবির আলটিমেট লক্ষ্যই হচ্ছে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা তছনছ করে দেয়া। এই জনং স্বয়ং প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের বাদ দিয়েছিলেন।

কবিরা খুব শিশু, তাই প্রবল অনুভূতিপ্রবণ, শিশুদের মানুষ ভালোবাসে কারণ প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই একটা শিশু বাস করে, কবিদের কাছে মানুষ যায় শিশু হতে, কিন্তু, সমাজে চলার জন্য তার কিছু বৈষ্যিক বোধবুদ্ধি দরকার, তখন ওই শিশুত্ব, কবিত্ব তাকে লুকাতে হয়। শিশুরা যতোই সুন্দর হোক, কোমল হোক, তাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ সময় কাটানো যায় না। শিশুদের সাথে বড়দের সম্পর্ক বড় একপাক্ষিক। শিশুদের শুধু আদর করা যায়, তাদের সাথে কথাবার্তা বেশিদূর আগানো যায় না। শিশুরাও খুব অন্ধ দাবি করে। যা তার লাগবে তা তাকে দিতেই হবে। যুক্তির কোনো বালাই নাই। কিন্তু, সাধারণ মানুষ, সে যতোই সামান্য হোক, একটা যুক্তিশীল সময় সে পার করতে চায়। শেষ পর্যন্ত আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কথা চালাচালারিই প্রক্রিয়া। যার সাথে আলাপ চালানো যায় না তার পাশে বেশিক্ষণ থাকতেও ইচ্ছা করে না। কবিদের নিয়া দ্বিতীয় বড় বিপদ তার সঙ্গে বেশিক্ষণ আলাপ চালানো যায় না।

কবিরাও যে তাতে অসহায়ত্ব বোধ করেন না, তা না। এতে করেই আস্তে আস্তে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, নিঃসঙ্গ হয়ে যান। সমাজকে গাল দেন, সমাজকে ভাঙতেও চান জ্বালাময়ী শব্দ ব্যবহারে, কিন্তু, শুধু শব্দ দিয়ে সমাজকে বদলানো যায় অল্পই।

আর যে-সমাজকে তারা গাল দেন সেই সমাজ আসলে কারা? কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে আমরা বলতে পারি যে এটা একটা পরিপূর্ণ সমাজ? সমাজকে একসাথে কোনোভাবেই চোখের সামনে হাজির করা যায় না। প্রত্যেকটা ব্যক্তি মিলেই তো সমাজ এবং ওই কবিও সেই সমাজের অংশ, যার সাথে সে খাপ খাওয়াতে পারছে না, তখন তা আসলে কিছুই করার থাকে না, নিজেকে সরিয়ে ফেলা ছাড়া। রাষ্ট্রকে তিনি গাল দেন, কিন্তু, রাষ্ট্রই-বা কী, কে? কারা চালায় রাষ্ট্র? রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির ভূমিকা কী? কীভাবে বদলাতে পারে এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, তা নিয়ে কবির কোনো দার্শনিক বোঝাপড়াও নাই। রাষ্ট্রের প্রবল শক্তিকে তিনি ভাঙতে পারেন না, কারণ, তিনি নিজেই তো যুক্ত না বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে, তিনি তো বিচ্ছিন্ন, হতাশগ্রস্ত। সাধারণ মানুষকেও তিনি তখন শত্রু মনে করেন, যে, তারা তাকে বুঝলো না, ওগুলো সব নির্বোধ, গরু-ছাগলের দল।

আর কবিদের ইগোও থাকে প্রবল। এই ইগো জেগে ওঠে তার সততা ও আদর্শবোধের জায়গা থেকেই। আদর্শও একটা বিপদ। কারণ সমাজে আদতে কোনো আদর্শ নাই। বেঁচে থাকার জন্য যে আদর্শ খুব দরকার তাও আমার মনে হয় না। এসব ধর্মীয় ও নীতিবোধের ব্যাপার। যা মানুষকে মানুষ থেকে, পশু থেকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। এ এক প্রবল ইগো। এ কারণে মানুষ ঈশ্বর পর্যন্ত হতে চায়। ঈশ্বর যেমন একা, কবিরাও নিজেকে একলা মনে করেন। যে তিনিই সব। যা করার তিনি একাই করে ফেলবেন। কবিরা খুব রোমাঞ্চে আর রোমান্টিকতায় ভোগেন। সাধারণ মানুষও এইসব আদর্শ কিছু কিছু বোধ করেন বটে, তা নিয়ে তারা কষ্টও পান, কারণ, শেষ পর্যন্ত তো আর আদর্শ রাখতে পারেন না। আদর্শ খুব দরকার নাই, এ কথা এ জন্য বললাম যে মানুষ একটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা, এখানে আমাদের অনেকেরই অনেক অপূরণীয় ব্যাপার আছে, আমরা নানারকম সামাজিক অসুস্থতা নিয়ে বেড়ে উঠছি, টিকে থাকার জন্য আমাদের পারস্পরিক যে সহযোগিতা তার নাম আমি আদর্শ বা নৈতিকতা না দিয়ে একটা উপায় বা প্রক্রিয়া দিলাম। এ নিয়ে আমার কিছু আগ্রুমেন্ট আছে। সে অনেক কথা। পরে কখনো বলা যাবে।

কবিদের আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে তারা তাদের বেশির ভাগ অনুভূতি কল্পনায় সেরে ফেলেন। অদৃশ্য অনেকগুলো রঙ তারা দেখতে পান, যা আমরা সাধারণ মানুষরা দেখি না। কিন্তু, সেই রঙেরও তো একটা শেষ আছে। যখন সেই রঙ ফুরিয়ে যায় কবিরও জীবন ফুরিয়ে যায়। বহু কবিই আত্মহত্যা করেছেন। সাধারণ মানুষের আত্মহত্যা আর কবির আত্মহত্যা অবশ্য এক না। সাধারণ মানুষকে আত্মহত্যা থেকে ঠেকানো যায়, কবিদের ঠেকাবে কে!

কবিদের নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। এটা একটা দুঃসাহসিক ব্যাপার। অভিজ্ঞতা থেকে জানি কিছু কবি এতোটা গভীর হোন তাদের নাগাল পাওয়াটা ভয়াবহ ব্যাপার। তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে, তার চেয়ে বেশি আছে মায়া। করুণাও বোধহয় কিছুটা। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমি বেশি মিশতে চাই না। দুতিনজন পাগলা কবি আমার বন্ধু ছিল এবং তারা আমার জীবন ঝালাপালা করে ফেলেছিল।

এখন অবশ্য ভাবপ্রবণ কবির দিন শেষ, কবিরাও এখন চালাক হয়ে গেছে, চিন্তাবিদ হয়ে উঠছে। সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলার কিছু তরিকা তারা আবিষ্কার করে ফেলেছে।

কবিরা আমার সঙ্গী না, আমার কিছু নিঃসঙ্গ সময়ের ওষুধ দিয়েছেন তারা। এখন কবিতা আমি খুব বেশি পড়িও না। আমি চাই সুষ্ঠু চিন্তা, শৃঙ্খলা, দার্শনিকতা। দার্শনিকদেরও এক সময় বিশৃঙ্খল বলে গাল দিয়েছে মানুষেরা। কিন্তু, আমার যেটা মনে হয় দার্শনিকরাই সমাজের সবকিছুর মধ্যে একটা সুন্দর ব্যালেন্স আনতে পারেন। হয়তো একে অনেকে সমন্বয়বাদিতা বলবেন, দালালিও বলতে পারেন, কিন্তু, এই নশ্বর পৃথিবীতে আমাদের টিকে থাকার জন্য জীবনের ভারসাম্য ঠিক রাখা ছাড়া গতি কী!

আমি খুব সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি কোনোদিন কবি হবো না। প্রতিভার কারণে না, ভয়ে। আমি এই সাধারণ ক্লেদাক্ত জীবন থেকে একলা বাঁচতে পারব না। আমি নিজেকে কেনোভাবেই হারাতে পারব না। কবিরা হারিয়ে যান। তিনি বড় একা। তোমাদের এই বেশ্যাবৃত্তির সমাজে আমাকে যদি কুকুর হয়ে বাঁচতে হয় তাও আমি বাঁচবো, কারণ জীবনের চেয়ে বেশি আমি আর কিছু ভালোবাসি নাই।

মানুষদের মধ্যে যাদের আমি শ্রেষ্ঠতম মানুষ মনে করি তারা হলেন কবি। যে কোনো মহৎ কবির জুতার তলা আমি জিভ দিয়ে চেটে পরিষ্কার করে দিতে প্রস্তুত।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার