কাকলীদের আমি ভুলি না

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : অক্টোবর ২২, ২০১৮

কৈশোরের স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত হয়ে বসে আছি। মনে হচ্ছে, সারাটা দিন আমি এই দুনিয়ার কোথাও ছিলাম না। কেউ আমাকে দ্যাখেনি, আমিও দেখিনি কাউকে। এভাবেই যেন আমার হৃদয়ে কাকলীরা বেঁচে থাকছে বছরের পর বছর ধরে। কাকলী গার্ডেনে আজো একটি গাঢ় ডালিয়া উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে, আমারই দিকে। হারিয়ে ফেলা এমনই কোনো কার্তিকের বিকেলবেলা আমি টুকরো টুকরো হয়ে যেন ঝরে যাচ্ছি জয়পাড়ার পথেঘাটে, আনাচে-কানাচে।

তখনো কাউকে ঘিরে আমার সবটুকু ভালোবাসা ছিল না। ভালো ছাত্র হওয়ায় অহংকার ছিল খুব। বন্ধুরা ভালোবাসার গল্প শুনাতো আর আমি ভাবতাম, এমন ভালোবাসা বাসিতে আমি নাই, যেখানে নিজের অস্তিত্ব বেঁচে থাকে। মনে মনে আমি খুঁজতাম এমন কাউকে যার কাছে গিয়ে নির্ভয়ে সম্পূর্ণ হারায়ে যাওয়া যায়। সেই কৈশোরে নিজেকে ভুলে যাবার মতো আমার কিছুই ছিল না গান ছাড়া। ছিল রাত জেগে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাবার বাজে অভ্যাস।

একদিন ভালো রেজাল্ট নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে। এরপর আরো একদিন জানলাম, কাকলী গার্ডেনের কাকলীর একটা প্রেম হয়েছে। জীবনে সেই প্রথম নিরানন্দের ঢাকায় একলা বারান্দায় আবেগের কান্না আমাকে ছুঁয়ে ফেললো। বড় ভাই ছুটে আসলেন কাছে কিন্তু কিছুতেই আমি আর কান্না থামাতে পারলাম না। সেই কান্না আজো কি থামাতে পেরেছি?

ছুটে গেলাম জয়পাড়ায়। সময়টা এমন ছিল যে অপরিচিত কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা মানে সর্বনাশ হয়ে যাওয়া। মনের ভেতর আয়ুব বাচ্চুর গান বাজতেছে, ‘সেই তারাভরা রাতে আমি পারিনি বোঝাতে, তোমাকে আমার মনের ব্যথা...’ সারারাত কাকলীদের বাসার আশেপাশে ঘুরেছি যদি একবার সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়!

পরের দিন স্কুলের রিইউনিয়ন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ অনেক বড় আয়োজন। সেই অনুষ্ঠানে কাকলীর হাত ধরলাম জীবনের প্রথম ও শেষবার। হাতটা ছাড়ায়ে নিলো সে। এরপর থেকে ‘তুমি কেন বোঝো না/তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়/আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমায় ঘিরে...’ এমন ফিলিংস নিয়ে ‘চলো বদলে যাই... চলো বদলে যাই‘ করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর রাজশাহীর সেই ঘটনাটা...

ব্যাগভর্তি বই। ইশ্বর গুপ্ত, মান্নান সৈয়দ, মিলান কুন্দেরা, বিষ্ণু দে, বিনয়, জীবনানন্দ, ইলিয়াস, কায়েস আহমেদসহ প্রায় ১৫-২০টা বই সাথে নিয়ে রাজশাহীর এক হোটেলে গিয়ে উঠেছি। বই পড়বো আর পদ্মার পারে তোলপাড় প্রেম করবো। প্রেমিকাকে দেখাতে হবে আমি অনেক পড়ুয়া টাইপ এবং বোঝাতে হবে আমি বিরাট স্কলার মানুষ। প্রেমিকার কাজিনের নাম লিসা। তার অনেক ছেলে বন্ধু। সবার সাথেই একে একে পরিচয় হলো শুধু একজন ছাড়া। যার সাথে পরিচয় হলো না তার গল্পই আমাকে বেশি টানলো। জানলাম তার সেই বন্ধুটা গান করে, গীটার বাজায়। অনেক অপেক্ষার পর তার সাথেও আমার পরিচয় হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জায়গাটায় রেশম গুটির চাষ হয় তারই পাশে একটা নিরালা ছায়ায় আমরা দল বেধেঁ বসেছিলাম। ছেলেটা গীটার বাজিয়ে গান করলো অনেকগুলো। আড্ডা শেষ হলো আমাকে একটা গান উৎসর্গ করে। ছেলেটা গাইলো এলআরবির...

গগনের তারাগুলো নিভে যাওয়া একরাতে
এলোমেলো জীবনের পথ হারানো ভুল পথে
হঠাৎ দেখা তোমার সাথে
তুমি কে? তুমি কে?
হবে কি বন্ধু আমার
তুমি কে? তুমি কে?

দুঃখের সাগরে আমার অনেক স্বপ্ন ভেঙে গেছে
বেলা ফুরানোর বেলা ডেকে যায়
কেউ নাই আমার পাশে।
যদি গো দেখা দিলেই তবে
একটু না হয় এসো কাছে।

কত না মায়ায় এখনও আমার
কষ্ট নিশি জাগে
ফেলে আশা স্মৃতি ব্যথাভরা সুরে
বাতাসের মন কাঁদে।
দিয়েছ দেখা বলেই স্মৃতি
কষ্টে আমায় এত বাঁধে।

ছেলেটার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। হয়তো আর হবেও না। তবু ছেলেটার কথা আমি ভুলিনি, কাকলীদের আমি ভুলি না। এমনই এক কাকলীর নাম আয়ুব বাচ্চু।