ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

কাকে ভোট দেব

মোহাম্মদ আলী

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৯, ২০১৮

কাকে ভোট দেব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে? কোন দল বা জোটকে ভোট দেয়া উচিৎ? কিন্তু কোনো অসাম্প্রদায়িক বা স্বৈরচারমুক্ত জোট আছে? যে জোটকে কোনো অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ব্যক্তি তার ভোটটি দেবেন। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে প্রকৃত অর্থেই যারা লালন ও ধারণ করেন? মহাজোট বা যুক্তফ্রন্ট দু`মেরুর দুই জোট। মহাজোটের প্রধান শরীক আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেও পরবর্তীকালে সেই চেতনা পরিত্যাগ করে চলেছে। মহাজোটভুক্ত রয়েছেন বহু বিতর্কিত পতিত স্বৈরাচার এরশাদ! যার সব কিছুই ভণ্ডামিতে ভরপুর। যিনি নূর হোসেন, ডা. শামস উল আলম খান মিলন, শাহজাহান সিরাজ, জিহাদসহ অসংখ্য নেতা-কর্মীকে হত্যা করে রাজপথ রঞ্জিত করেছেন। অগণিত মায়ের বুক খালি করেছেন। আবার মহাজোটে না থাকলেও হেফাজত এখন আওয়ামী লীগের বড় বন্ধু। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য যে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ভবিষ্যতে বড় বিষফোঁড়া হয়ে উঠবে। যার প্রধান `তেঁতুল হুজুর` নামে খ্যাত। যিনি `৭১ মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি শাহবাগের গণজারণের চরম বিরোধী। আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যেই হেফাজতের বেশ কিছু অযৌক্তিক ও সাম্প্রদায়িক দাবি মেনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে পিছু হটে এসেছে। যাদের প্রতিষ্ঠিত কওমী মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া নিষিদ্ধ। ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহিদ মিনারে ফুল দেয়া যাদের কাছে হারাম। ১৬ ডিসেম্বরকে যারা বিজয় দিবস হিসেবে মানেন না। ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গ্রহণ করেননি।

`তেঁতুল হুজুর` তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে নারী-জাতিকে অপমান করেছেন। নারীরা নাকি টু-থ্রি পর্যন্ত পড়লেই যথেষ্ট। নারীদের শিক্ষার প্রয়োজন নেই বলে `কওমী নেতা` মনে করেন। শেখ হাসিনা সরকার কওমীদের দাওরা পাসকে এমএ পাসের সমমানের ডিগ্রি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কওমী মাদ্রাসার ছাত্রের পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচ এসসি পাস করা লাগে না। তাহলে তারা কিভাবে এমএ পাস করবেন? এমএ ডিগ্রি কি টিআর কাবিখা`র মতো হাতের মোয়া? নিতান্ত তুঘলকি কারবার?

২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে তারা বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। পেয়েছিলেন প্রশংসা। অথচ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করে দল ও জোটে কালিমা লেপন করেছেন। তার খেশারত একদিন তাঁকে কড়ায়গুণ্ডায় দিতে হবে। `৫২, `৭১ ও `৯০ আমাদের দেশের রাজনীতির বড় অর্জন। `৫২-তে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভাষার স্বাধীনতা পেয়েছি। `৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দিয়েছে স্বাধীনতা। ৯০-এ আমরা পেয়েছিলাম স্বৈরচারমুক্ত দেশ।

এ তিন সময় আমরা হয়ে উঠেছিলাম অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছি। মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ধরে রাখতে পারিনি। এটা জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্য। অথচ দীর্ঘদিন গণ-আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও `৭১ সালে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লক্ষ মানুষকে বুকের রক্ত এবং দু`লক্ষ মা-বোনকে সম্ভ্রম দিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ভারত ও রাশিয়া সহযোগিতায় আমরা দেশকে হানাদারমুক্ত করতে সক্ষম হই। পাকিস্তানি নরঘাতক জেনারেল নিয়াজি বাধ্য হন আত্মসমর্পন করতে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যুদ্ধের পর ৯৪ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে বিনা বিচারে ছেড়ে দিতে হয়। কারণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধী-পাকিস্তানি সেন্যদের মুক্তির বিনিময়ে ভারত পাক সরকারকে দিয়ে সিমলা-চুক্তি করে সুবিধা নেয়। যা ছিল বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করতে পারার পেছনের প্রধান কারণ।

এদিকে পাক-বাহিনীর দোসররা বাংলাদেশে থেকে যায়। তাদের বিচার স্বাধীনতার স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেটা খুব গুরুত্ব সহকারে দ্রুত করা হয়নি। ১৫ আগস্ট `৭৫ সালে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। হত্যাকারীরা আওয়ামী লীগের ভেতরে লুকিয়ে থাকা দানব মোশতাকচক্র ও সামরিক বাহিনীর কতিপয় অফিসার। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। `৭৫-এর পর সেই ভয়াল দিনে শুরু হয় সামরিক ক্যু পাল্টা ক্যু। খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেন। পাল্টা ক্যুতে খালেদ নিহত হন। জিয়াউর রহমান মুক্ত হন কর্নেল আবু তাহেরেরর সহযোগিতায়। কিন্তু তিনি মুক্ত হয়েই কর্নেল আবু তাহের ও সিপাহীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সিপাহীদের ১২ দফা দাবিকে পদদলিত করেন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীদের কারাগারে বন্দি করেন। কর্নেল তাহেরকে প্রহসনমূলক বিচারে হত্যা করেন। মুক্তিযোদ্ধা সিপাহীদের রাতের অন্ধকারে বিনা বিচারে ক্যান্টনমেন্টে হত্যা ও গুম করেন।

স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে শুরু করেন রাজনীতি। যা ছিল একজন সেনা অফিসারের জন্য সম্পূর্ণ অবৈধ। জেল থেকে মুক্তি দান এবং বিভিন্ন দলের নেতাদের মন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে জিয়া তাদেরকে দলে ভিড়ান। কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করেন। নিষিদ্ধ জামাতকে রাজনীতি করার অধিকার দেন। গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরাপুরি উল্টো দিকে যাত্রা করে। জিয়াউর রহমানের ছাত্রছায়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামাত ও যুদ্ধাপরাধীরা ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে। তিনি সংবিধানের চার মূলনীতি হত্যা করেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন। রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র হনন করেন। সাংবাদিক, লেখক, কবি ও বুদ্ধিজীবীদের দলে ভেড়ান। তার শাসনামলে ২১বার সামরিক ক্যু পাল্টা ক্যু হয়। তিনি চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। একজন সামরিক-জান্তা ক্যুতে মারা যাবার পর তাকে `শহিদ` বলে বিএনপি আখ্যায়িত করে! তার মৃত্যর পর তিনি স্বাধীনতার ঘোষক এ তত্ত্বও বিএনপির সুযোগ সন্ধানী কতিপয় বুদ্ধিজীবী আবিষ্কার করেন! ৮২-৯০ পর্যন্ত স্বৈর-শাসক এরশাদ রাজত্ব করেন। বাংলাদেশের রাজনীতি তখন ছিল চরম বিভক্ত ও বিভীষিকাময়। জিয়াউর রহমানের `বিসমল্লাহ` তত্ত্বের ওপর এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাপান।

তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ৯ বছরে ধরে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। বহু নেতা ও কর্মীকে যেতে হয় জেলে। রক্ত দেন অসংখ্য সংগ্রামী। বহু উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে এরশাদীয় যুগের অবসান হয়। `৯০-এর পর ৮ দল, ৭ দল ও পাঁচ দল ঐক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। তিনজোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন দূরের কথা, বড় দুটি দল বিশ্বাসভঙ্গ করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ দফা পদদলিত করা হয়। সংগ্রামীশক্তি ক্ষয়ে যেতে থাকে। পেশিশক্তি রাজনীতিতে শক্তিশালী হতে থাকে। এরশাদের পতনের পর ঐক্য ধরে রাখতে না পারায় `৯০ উত্তরকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে। রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনেরর সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায়। রাজনীতিতে শুরু হয় বাণিজ্যিকীকরণ। গুনগত পরিবর্তন না হওয়া রাজনীতির অঙ্গনে চরম হতাশা দেখা দেয়।

এরপর ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী জঙ্গি দমনের নামে হামলা করে। বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে জঙ্গী তৎপরতা শুরু হয়। এদেশে জন্ম হয় বাংলা ভাই ও আব্দুর রহমানের মতো বড় জঙ্গি। জঙ্গিরা ছায়ানট ও উদীচীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা করেছে। বিরোধী দলের নেতৃ শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা করা হয়। হলি আর্টিজানে ১৯জন বিদেশিকে হত্যা করা হয়। রাজনীতির চরম অস্থিরতা বিরাজ করে।

সাংসদদের কাজ আইন প্রনয়ন করা। তারা উন্নয়ন কাজে জড়িয়ে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। রাজনীতি হয়ে উঠেছে ব্যবসার হাতিয়ার। সাংসদদের উন্নয়ন কাজ থেকে দূর রাখা জরুরি। শুল্কমুক্ত গাড়ি প্রদান রীতি বাতিল করা জরুরি। সংসদ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মধ্য আনা প্রয়োজন। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা উচিত। নির্বাচনী ব্যয় কমানো ও কালো ব্যবহার প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ভোটের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন অসম্ভব। যুব সমাজকে পরিবর্তনের রাজনীতির কথা চিন্তা করতে হবে। কথিত রাজনীতি কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। সমাজ রূপান্তর জরুরি।

নেপালের যুব সেই দেশে পরিবর্তন এনেছে। ভুটানেও পরিবর্তন এসেছে। আমরা কাউকে অনুকরণ করব না। কিন্তু পরিবর্তন চাইব, নিজের মতো করে। শোষণের অবসান চাই। আমরা রুশপন্থী বা চীনাপন্থী নই। আমরা বাংলাদেশপন্থী। তারুণ্যই পারে, সমস্যার সমাধান করতে। তাদেরকে জাতীয় রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তন আনতে হবে। দেশকে করতে হবে শোষণমুক্ত। শোষণ মুক্তি না হলে জনগণের মুক্তি আসবে না। বামফ্রন্ট কি যুব সমাজকে সেই পথ দেখাতে পারবেন? তারা কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন না! ঐক্যবদ্ধ না হতে পারলে রাজনীতি হবে অর্থহীন। যুবসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে, পথ খুঁজে নিতে হবে। তারুণ্যই পারে যে কোনো জাতিকে শৃংঙ্খলমুক্ত করতে।

সমাজতন্ত্রের পথেই জনগণের মুক্তি আসবে। তবে কাউকে ছাতা ধরার মতো অনুকরণ যেন আমরা না করি। বাংলাদেশের বিপ্লব হতে হবে, নিজের মতো করে। কোনো অন্ধ অনুকরণ করে নয়।