কাজুও ইশিগুরোর সঙ্গে সু্ইডিশ একাডেমির ফোনালাপ

সুশান্ত বর্মন

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবার খবরটা সুইডিশ একাডেমির পক্ষ থেকে লেখককে জানানোর দায়িত্ব পান প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মি. অ্যাডাম স্মিথ। ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর ইংল্যান্ডবাসী জাপানী বংশদ্ভূত লেখক কাজুও ইশিগুরোকে খবরটি দেবার জন্য ফোন করেন জনাব স্মিথ। ইশিগুরো ব্যস্ত ছিলেন। তাই ফোনের অপরপ্রান্তে  স্মিথকে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। এরপর তাদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথোপকথন হয়। লেখককে পুরস্কার পাবার খবর জানানোর সময় ভাল-মন্দ খবরাখবর জানতে চান স্মিথ, ইশিগুরোও কম যান না । কাজুও ইশিগুরো ও অ্যাডাম স্মিথের মধ্যে ঘটিত ফোনালাপটির বাংলা অনুবাদ করেছেন সুশান্ত বর্মন।কাজুও ইশিগুরোঃ হাই, হ্যালো মি. স্মিথ, কেমন আছেন?
অ্যাডাম স্মিথঃ খুব ভালো। ফোন রিসিভ করার জন্য আপনাকে অবশ্যই অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই। আপনি সহৃদয়। নোবেল পুরস্কার পাবার জন্য আপনাকে অনেক অভিনন্দন।
ইশিগুরোঃ হ্যাঁ, আপনাকেও ধন্যবাদ। আমি দুঃখিত যে আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখানে চারপাশে খুব হট্টগোল হচ্ছে। হঠাৎ করে অসংখ্য সংবাদকর্মী চলে এলো, তারা রাস্তায় জমায়েত হয়ে ভীড় করে ফেলেছে।
স্মিথঃ আমি কল্পনা করতে পারছি। তো, হ্যাঁ আপনার দিনটার শুরু এক্কেবারে ভিন্নরকম হয়ে গেল। কীভাবে এই খবরটা শুনলেন?
ইশিগুরোঃ আচ্ছা, আমি রান্নাঘরে বসেছিলাম, বন্ধুকে একটা ইমেইল লিখছি এবং তখন একটা ফোন এল। ততোটা সুনিশ্চিতভাবে এটা শুরু হয়নি। আমার লেখার এজেন্টরা টিভিতে ঘোষণাটি সরাসরি দেখতেছিল। তারা এটা প্রত্যাশা করছিলো বলে মনে করি না। এই বছরের নোবেল পুরস্কারটা কে পেলো তা জানার জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। আর তারপর আমি পরপর ফোন পেতে থাকলাম। সবসময়ই আমরা এটা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলাম যে, এটা হয়তো একটা ধাপ্পাবাজি অথবা ভুল খবর অথবা অন্যকিছু। এবং এরপর আরও বেশি বেশি নিশ্চিত হতে লাগলাম। এসময় বিবিসি ফোন করেছিল। আমি বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নিতে থাকলাম। কিন্তু তবুও বিশ্বাস করা শুরু করিনি। এটা কিছুটা ভৌতিক ব্যাপারের মতো। ১১টা বাজার আগে অথবা যখনই হোক, সম্পূর্ণভাবে শুরু হওয়ার আগে সবকিছু যেমন ছিল, ঠিক তেমনই আছে। আর এখন অসংখ্য মানুষ রাস্তায় গিজগিজ করে ভীড় করছে আমার সাক্ষাৎকার নেবার জন্য।
স্মিথঃ হই-হল্লার মধ্যে ডুবে গেছেন নাকি?
ইশিগুরোঃ না! না! এটা বেশিদিন থাকবে বলে মনে হয় না। আমি মনে করি এটা একটা অবিশ্বাস্য সম্মানজনক পুরস্কার। এই বিষয়ের ক্ষেত্রে যত বড় হওয়া সম্ভব। নোবেল পুরস্কারের চাইতে বড় পুরস্কার আছে বলে মনে করি না।  মন্তব্য হিসেবে আমি হয়তো বলবো, মানে, একটাই হলো, অনেক সম্মান এই ঘটনার সাথে আসবে যে সুইডিশ একাডেমি অবশেষে সাফল্যের সঙ্গে , আমি মনে করি, দলবাজি, রাজনীতি এবং অন্য কিছুর বিতর্ক থেকে অনেক উর্ধ্বে উঠতে পেরেছে। খুব অল্প কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যাকে এখনও শ্রদ্ধা করা হয়। যার দৃঢ়তাকে এখনও পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ সম্মান করে এবং এমনভাবে, আমি মনে করি অনেক সম্মান মূলত সুইডিশ একাডেমির সত্যিকারের মর্যাদা থেকে আসবে। এবং আমি মনে করি এই বিশাল অর্জন আসলে তার নিজের মধ্যেই। মূলত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জীবনের বিভিন্ন পথ যেগুলোকে তারা সম্মান করে সে বিষয়ে সুইডিশ একাডেমি নিজেদের উচ্চ অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। আর আমার জন্য সবচাইতে উত্তেজনাকর বিষয় হলো, আপনি জানেন, আমি আমার হিরোদের, বিশেষ করে লেখকদের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেলাম। ইতিহাসের মহানতম লেখকরা এই পুরস্কার পেয়ে থাকেন। এবং আমি বলতে চাই, আপনি জানেন বব ডিলানের এক বছর পরে আসাটা আরও সম্মানের। আমার ১৩ বৎসর বয়স থেকে তিনি আমার আদর্শ ব্যক্তিত্বদের একজন। তিনি আমার কাছে হয়তো সবচেয়ে মহান ব্যক্তি।
স্মিথঃ আপনার সঙ্গ উপভোগ করছি।
ইশিগুরোঃ হ্যাঁ, আমি বব ডিলানের ভালো অনুকরণ করতে পারি। কিন্তু আপনার জন্য এখন আমি করবো না।
স্মিথঃ কী মজা হতো তাহলে, আমি খুব পছন্দ করতাম। ডিসেম্বরে যখন স্টকহোমে আসবেন, তখন, মিনতি করছি।
ইশিগুরোঃ আচ্ছা, আমি চেষ্টা করে দেখবো।
স্মিথঃ আপনাকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। ব্রিটেনে এই সময়টা বেশ মধুর। এই পুরস্কার পাবার সময়টাতে জায়গাটার কোন তাৎপর্য আছে কী?
ইশিগুরোঃ আমার ধারণা আছে। আমি মনে করি, আসলে আপনার সঙ্গে কথা বলার আগে আমি এক ধরণের প্রেস রিলিজ লিখছিলাম। তিন লাইনের মধ্যে আমি কি বলতে পারি, তা ভাবতেছিলাম। আমার জন্য সঠিক সময়কাল বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমি অনুভব করি, আমি প্রায় ৬৩ বৎসর বয়সী, পশ্চিমা মূল্যবোধের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছি, এমন কোন সময়ের কথা মনে পড়ে না। আপনি জানেন, আমি মনে করি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের নেতৃত্ব এক বিশাল অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আমি প্রত্যাশা করি যে, নোবেল পুরস্কারের মতো বিষয় পৃথিবীতে ইতিবাচক কিছু ঘটনোর কাজে অংশগ্রহণ করবে। পৃথিবীর সভ্য মূল্যবোধের কাছে এবং ধারাবাহিকতা ও পরিমিতিবোধের অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলায় সহায়তা করবে।
স্মিথঃ আমার ধারণা আপনি সারা সময় ধরে যা লিখে আসছেন, এভাবে যে, পৃথিবীতে অামাদের অবস্থান নিয়ে, পরস্পরের সঙ্গে আমাদের সংযুক্তি নিয়ে, পৃথিবীর সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন করে। হয়তো এভাবে আপনি মূলভাবকে আবিষ্কার করতে পেরেছেন। আপনি কী মনে করেন?
ইশিগুরোঃ হ্যাঁ, আমিও তাই বলবো। আমি মনে করি, আমার ধারণা, এটাকে তার চাইতে আরও সংকীর্ণ কোন অবস্থানে রাখতে গেলে, আমার ধারণা, এটা সম্ভবত যা কিছু আমাকে আকৃষ্ট করেছে, তার মধ্যে একটি যে কীভাবে আমরা একই সময় ছোট পৃথিবী ও বড় পৃথিবীর মধ্যে বাস করি? যেখানে আমাদের ব্যক্তিগত এক জায়গা আছে, আমরা পরিপূর্ণতা ও ভালোবাসা খুঁজে বেড়াই। কিন্তু সেটা বৃহত্তর পৃথিবীর সাথে বিভক্ত করে। যেখানে রাজনীতি অথবা এমনকি দুর্ভাগ্যময় বিশ্বজগত টিকে যেতে পারে। অতএব আমি মনে করি আমি এই বিষয়টাতে সবসময়ই আগ্রহী ছিলাম। আমরা ছোট জগত  ও বড় জগতের মধ্যে একই সময়ে বাস করি এবং আমরা পারি না, আপনি জানেন, একটা অথবা অন্যটা ভুলে যান।
স্মিথঃ আপনাকে ধন্যবাদ। এই বিষয়গুলো আরেকদিন আলোচনা করা যেতে পারে। এই মুহূর্তে আপনি সাংবাদিকদের এই বিশাল জমায়েতকে কীভাবে সামলাচ্ছেন? আর শেষ একটা ভাবনা আগামী দিনে আপনি মনোযোগের যে প্লাবনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?
ইশিগুরোঃ আচ্ছা, আমি এসবকে খুব ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করি। আমার ধারণা, যখন কোনরকম প্রস্তুতি থাকবে না, কারণ আপনি জানেন না, যখন আপনি এই সকালে জেগে উঠবেন যে অন্য সাধারণ দিনের মতো আজকের দিনটিও কাটবে। এটা একটা বিরাট বিষয় যে প্রেস, মিডিয়া সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টাকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখে। সেইদিন আমি আতংকিত হবো যেদিন কেউ একজন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলো, কিন্তু কেউ উৎসাহী হলো না। পৃথিবীর খুব খারাপ কিছু ঘটেছে এটাই তখন বোঝা যাবে।
স্মিথঃ সাহিত্যের জন্য উৎসব উদযাপনের দিনটি ভালো হওয়া উচিত।
ইশিগুরোঃ হ্যাঁ, আমি মনে করি সাহিত্য মহৎ কিছু হয়ে উঠতে পারে। খারাপের পক্ষেও এটা শক্তিমান হয়ে উঠতে পারে। আপনি জানেন, ভালোর পক্ষে শক্তিমানতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পাবার মতো জিনিস আছে।
স্মিথঃ বেশ ভালো। আচ্ছা, ধন্যবাদ আপনাকে, আগামী ডিসেম্বরে আপনাকে স্টকহোমে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছি।
ইশিগুরোঃ হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। সত্যিই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছি। আচ্ছা, আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগল।
স্মিথঃ সত্যিই আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।